হ্য চোংইয়াও এবং তাঁর চলচ্চিত্র জাদুঘর
2024-05-16 11:16:42

চলচ্চিত্র এমন একটি পেশা, যাতে ৭৪ বছর বয়সী হ্য চোং ইয়াও তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। প্রথমে সিনেমা দেখানো থেকে শুরু করে, সিনেমা-সম্পর্কিত পুরানো বস্তু সংগ্রহ করা এবং তারপর একটি চলচ্চিত্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা পর্যন্ত, হ্য চোং ইয়াও মোট ৫০ বছর ধরে চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত আছে। আজকের অনুষ্ঠানে চলুন দেখে নেওয়া যাক এই গ্রামীণ চলচ্চিত্র প্রজেকশনিস্টের ‘আলো ও ছায়া’-র জীবন।

১৬ বছর বয়সে হ্য চোং ইয়াও তাঁর জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র ‘দা হোয়াইট হেয়ার্ড গার্ল’ দেখেন। চলচ্চিত্রটি তাঁর মনে দারুণ প্রভাব ফেলে। ১৯৭৩ সালে স্থানীয় কমিউন চলচ্চিত্র দল প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভালো লিখতে ও আঁকতে পারার কারণে, তাকে চলচ্চিত্র দলের একজন চলচ্চিত্র প্রজেকশনিস্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হন। তখন থেকে তার জীবনের দীর্ঘ ৫০ বছর কেটেছে ‘আলো ও ছায়া’র মধ্যে।

হুপেই প্রদেশের তাং ইয়াং শহরের ইউ সি থানার চলচ্চিত্র জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা হ্য চোং ইয়াও,একটি যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘১৯৭৩ সালে যখন আমি প্রথম চলচ্চিত্র দলে যোগ দেই, তখন এই যন্ত্রটি ব্যবহার করেছিলাম। চলচ্চিত্র দলে যোগ দেওয়ার পর, সংশ্লিষ্ট নেতারা আমাদেরকে প্রজেক্টর ও জেনারেটরসহ একটি সম্পূর্ণ সেট সরবরাহ করেন এবং আমাদেরকে এই মর্মে নির্দেশনা দেন যে, এসব যন্ত্রের খুব ভালো করে যত্ন নিতে হবে, যেমন আমরা আমাদের নিজেদের জীবনের যত্ন নেই। সেই সময় আমরা সত্যিই উত্তেজিত ছিলাম। এটা বলা যেতে পারে যে, আমরা দিনরাত এসব যন্ত্র নিয়ে পড়ে থাকতাম।”

সেই যুগে, সিনেমা দেখানো একটি সুন্দর অথচ কঠিন কাজ  ছিল। বেশিরভাগ স্ক্রিনিং সাইটগুলো পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত ছিলো। হ্য চোং ইয়াও তার দলের সঙ্গীকে নিয়ে, ২০০ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম বহন করতে, একটি কাঁধের খুঁটি ও দুটি ঝুড়ি ব্যবহার করতেন। বৃষ্টি না-থাকলে তাঁরা প্রায় প্রতিদিনই সিনেমা দেখাতেন।

হ্য চোং ইয়াও বলেন, ‘একবার পাহাড়ে সিনেমা দেখানোর দায়িত্ব পাওয়ার পর, আমি মূলত বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন আমার দুটি সন্তানের জন্ম হয়, তখনও আমি সেখানে ছিলাম। বড় ছেলের জন্মের সপ্তাহ খানেক পর আমি জানতে পারি যে, আমি বাবা হয়েছি।’

যদিও কাজটি সহজ ছিল না, একজন প্রজেকশনিস্ট হিসাবে, তিনি যেখানেই যান, সেখানকার বাসিন্দারা তাকে স্বাগত জানান। কমিউন মোট ৭টি চলচ্চিত্র দল প্রতিষ্ঠা করেছিল। যারা বছরে ১৫০০টিরও বেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতো। হ্য চোং ইয়াও একসময় প্রজেকশন দলের দলনেতা হন। যখনই সূর্য অস্ত যায়, গ্রামবাসীরা চারপাশে জড়ো হয়ে সিনেমা শুরুর অপেক্ষায় থাকেন, তখনই হ্য চোং ইয়াওয়ের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত।

হ্য চোং ইয়াও বলেন, “আমাদের চলচ্চিত্র দলের সদসরা আজকালকার তারকার মতো। যেখানে আমরা যাই, সেখানে শিশুরা চিত্কার করে বলে, ‘আপনারা এখানে সিনেমা দেখাতে এসেছেন!’ সেই সময় তুলনামূলকভাবে কম সিনেমাহল ছিল। এটা বলা যেতে পারে যে, সিনেমা দেখা ছিল বসন্ত উত্সব উদযাপনের মতো। কৃষকরা এর জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন।”

তবে, গত শতাব্দীর ৮০ ও ৯০-এর দশকে টেলিভিশন সহজলভ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্র দেখানোর কাজটা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। প্রজেকশনিস্টরা একের পর এক পেশা পরিবর্তন করা শুরু করেন। অনেক চলচ্চিত্র দল ভেঙেও দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও, হ্য চোং ইয়াও তাঁর প্রিয় চলচ্চিত্র পেশা ছেড়ে দেননি, বরং নতুন পথ খুঁজতে শুরু করেন।

২০০৭ সালে, গ্রামীণ ফিল্ম প্রজেকশন টিমের উন্নয়নে সহায়তার জন্য, গ্রামীণ জনকল্যাণমূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা শুরু হয়। হ্য চোংইয়াও-এর কর্মজীবনও আবার উন্নতির সূচনা করে। তিনি একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পর, নিজের টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কেনেন। সেই গাড়ি সিনেমার প্রজেকশন বাহন হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করেন। বছরে ২৭০টিরও বেশি প্রজেকশনের কাজ এই পুরানো প্রজেকশনিস্টের জীবনকে আবার পরিপূর্ণ করে তোলে।

বিখ্যাত হওয়া থেকে উপেক্ষিত হওয়া পর্যন্ত, এবং তারপর আবার নতুন যাত্রা শুরু করা, হ্য চোং ইয়াওয়ের ফিল্ম প্রদর্শনের যাত্রায়, গত কয়েক দশকে সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের পরিবর্তনও প্রতিফলিত করে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে হ্য চোং ইয়াও-এর প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলো অতীতের মুভিগুলো থেকে আরও পোর্টেবল এবং পরিষ্কার ডিজিটাল চলচ্চিত্রে পরিবর্তিত হয়েছে। একবার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের প্রক্রিয়ায় একজন পুরানো দর্শক বলে ওঠেন, “সিনেমা দেখার সময় প্রজেক্টরের ‘ক্লিক-ক্লিক’ শব্দটি আর শোনা যায় না কেন?’ এই কথাটি হ্য চোং ইয়াওকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল।

তার মতে, ওপেন-এয়ার সিনেমা হল চীনা জনগণের প্রজন্মের সম্মিলিত স্মৃতি; মুভি প্রজেক্টর ও ফিল্মসহ এসব পুরানো জিনিস সময়ের পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছে এবং এগুলো সংরক্ষণ করা উচিত। ২০০৯ সালে, তিনি ও তাঁর বন্ধুদের সিনেমা প্রদর্শনের সাথে সম্পর্কিত ‘পুরানো জিনিসগুলো’ সংগ্রহ করতে শুরু করেন এবং পরে সেগুলো কেনার জন্য অর্থ ব্যয় করতে শুরু করেন। তবে, শুরুতে তাঁর পরিবার এর বিরোধিতা করে।

হ্য চোং ইয়াওয়ের স্ত্রী বলেন, ‘সকল জিনিস একটি রুমে ফেলে রাখা হয়। অনেকটা ধাতুর স্ক্র্যাপের মতো। আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলাম। তবে, তাঁর মনে হতো, এগুলো মূল্যবান জিনিস।’

মুভি মেশিন, জেনারেটর, রেকর্ড প্লেয়ার—এ সরঞ্জামগুলো অন্যদের চোখে আবর্জনা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু তিনি  এগুলোকে ধন হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। তাঁর যত্নে, পুরানো সরঞ্জামগুলো নতুন প্রাণ পায় এবং এগুলোর কয়েকটি এখনও ব্যবহার করা যেতে পারে। শহরের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহায়তায়, হ্য হোং ইয়াও, নিজের সংগৃহীত জিনিসগুলো ইউসি থানার প্রেক্ষাগৃহের ড্রেসিং রুমে বিনামূল্যে প্রদর্শন করেন এবং অপ্রত্যাশিতভাবে দর্শকদের কাছ থেকে বিপুল স্বীকৃতি পান।

প্রজেক্টরের মতো বড় বা প্রজেক্টরের আলোর বাল্বের মতো ছোট, হ্য চোং ইয়াওয়ের সংগ্রহের যাত্রা ধীরে ধীরে প্রদেশ থেকে পুরো দেশে বিস্তৃত হয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে, তিনি জানতে পারলেন যে, ইউননানের খুনমিং-এ এক বৃদ্ধ লোক প্রচুর প্রজেক্টর ও মুভি ম্যাগাজিন সংগ্রহ করেছেন। এ খবর জেনে তিনি ও তাঁর স্ত্রী তাদের সঞ্চয় নিয়ে দিনরাত ট্রেন ভ্রমণ করে ইউননানে পৌঁছে যান।

ইউননানের সেই যাত্রায় তার পরিবারের প্রায় সকল সঞ্চয় খরচ হয়েছিল। কিন্তু হ্য চোংইয়াও মনে করেন যে, সেই যাত্রা খুব ফলপ্রসূ ছিল। কারণ, তিনি তিন সেট পুরানো প্রজেক্টর সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন।

বছরের পর বছর ধরে, হ্য চোংইয়াও দেশজুড়ে বিরল মডেল খুঁজে বের করার জন্য ৫ লক্ষাধিক ইউয়ান খরচ করেন। প্রেক্ষাগৃহের মাত্র ১২ বর্গমিটার ড্রেসিং রুমে আর হচ্ছিল না। স্থানীয় সাংস্কৃতিক বিভাগের সহায়তায় হ্য চোংইয়াও-এর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হল ৪৪ বর্গমিটার থেকে ১০০ বর্গমিটারে দাঁড়ায়। ২০২২ সালে ৪০০ বর্গমিটারের চলচ্চিত্র জাদুঘরটি আনুষ্ঠানিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সবাই বিনামূল্যে তা পরিদর্শন করতে পারেন।

হ্য চোংইয়াও বলেন, ‘এসব জিনিস একসাথে প্রকৃতপক্ষে চীনা চলচ্চিত্রের বিকাশের প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি তুলে ধরে।’

আজ হ্য চোংইয়াওয়ের চলচ্চিত্র জাদুঘরে ৮০টিরও বেশি সেট পুরানো ফিল্ম সরঞ্জাম, দুই শতাধিক ফিল্ম রিল, এবং কয়েক হাজার ফিল্ম ম্যাগাজিন সংগৃহীত আছে। এই পুরানো বস্তুগুলো নতুনদের কাছে সময়ের গল্প বলে।

তিনি যখন একজন প্রজেকশনিস্ট ছিলেন, তখন প্রতিটি মুভি দেখানো ছিল হ্য চোংইয়াওয়ের ‘বড় ব্যাপার’। এখন, এই ফিল্ম মিউজিয়ামটি ভালোভাবে চালাতে এবং এই পুরানো জিনিসগুলো সংরক্ষণের জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করছেন।

যদিও জাদুঘরে একটি স্মার্ট জুকবক্স আছে, যা যেকোনো সময়ে এক হাজারেরও বেশি পুরানো সিনেমা প্রদর্শন করতে পারে, তবে হ্য চোংইয়াও প্রায়শই প্রজেক্টর ঘুরিয়ে দর্শকদের দেখান যে, আগের সময়ে কীভাবে সিনেমাগুলো প্রদর্শিত হতো। সরঞ্জামের যত্ন নেওয়া এবং ফিল্ম প্রদর্শন তাঁর কাছে এখনও  গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা করতে তিনি কখনই অবহেলা করেন না।

এখন হ্য চোংইয়াং জাদুঘরের পরিচালক ও গাইড। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জাদুঘর পরিষ্কার রাখার কাজ করেন।

জনসাধারণের জন্য বিনামূল্যে জাদুঘর খোলার পর থেকে এই ছোট গ্রামীণ চলচ্চিত্র জাদুঘরটি পরিদর্শনকারী পর্যটকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। প্রতিবছর তরুণদের জন্য ৫০টিরও বেশি দেশাত্মবোধক ও শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়  এখানে।

চলচ্চিত্র জাদুঘর নির্মিত হওয়ার পর, এটি সত্যিই সমাজের স্বীকৃতি পায়। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, তিনি এতো বছর ধরে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছেন এবং অবশেষে প্রাচীন চলচ্চিত্রের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করতে পারছেন। তাঁর হাত ধরে পুরাতন চলচ্চিত্র সংস্কৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে যাচ্ছে।

মুভির প্রজেক্টরের ক্লিং ক্লিং শব্দ যেন কয়েক প্রজন্মের মানুষের প্রতিধ্বনি। ফ্রেমের আলো ও ছায়া হলো সময়ের স্মৃতি, যা কখনও মুছে যায়নি। আজকাল চলচ্চিত্রের ছবিগুলো কালো ও সাদার পরিবর্তে রঙিন হয়েছে এবং শব্দ ও আলোর বিশেষ প্রভাবও আগের চেয়ে অধিক চিত্তাকর্ষক। সিনেমা দেখার স্থানটিও খোলা অঞ্চল থেকে আরামদায়ক প্রেক্ষাগৃহে পরিবর্তিত হয়েছে।  তবে, একসাথে চলচ্চিত্র উপভোগের আনন্দ একই রয়ে গেছে।

তরুণ থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত, সময় এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, চলচ্চিত্রের প্রজেকশনের প্রতি ভালোবাসা ও অধ্যবসায় অপরিবর্তিত রয়েছে। তাঁর চলচ্চিত্র জাদুঘর শুধু পুরনো যন্ত্রপাতিই নয়, পুরনো প্রজন্মের মূল্যবান চলচ্চিত্রের স্মৃতিও সংগ্রহ করে। একই সঙ্গে এটি অতীতের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা ও আনন্দময় অনুভূতি আজকের তরুণ ও শিশুদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে, পুরানো চলচ্চিত্রগুলোর নতুন মূল্য সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে। (লিলি/আলিম/স্বর্ণা)