চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈশিষ্ট্যময় ভ্রমণ প্রসঙ্গ
2024-05-06 14:55:23

গত বছর থেকে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যটকদের জন্য পরিদর্শনের সুযোগ দেওয়া আবার শুরু করে। এমন উদ্যোগের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করে পারছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্যময় পরিদর্শন এলাকার তথ্য তুলে ধরবো। যদি আপনারা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহী হন, তাহলে সুযোগ পেলেই আবেদন করতে পারেন।

 

চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম ক্যাম্পাসে একটি পোকা জাদুঘর নির্মিত হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটকদের জন্য খোলা হয়েছে। জাদুঘরটি বিশেষ করে বেইজিংয়ের বাসিন্দাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাদুঘরের গাইড চাং চি ইয়ু একবার ২০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী এবং তাদের পিতামাতার সামনে পোকাবিদ্যার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার চেষ্টা করেন। অনেক পিতামাতা বাচ্চাদের নিয়ে এ জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে কয়েকবার চেষ্টার পর সফল হয়েছেন, পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছেন।

 

গাইড চাং চি ইয়ু একজন যুবকর্মী। গত বছর তিনি মাত্র চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে, পোকা নিয়ে টানা ৯ বছর ধরে গবেষণার কাজ করেছেন তিনি। একবার পর্যটকদের মধ্যে কয়েকজন ছোট বন্ধু পোকাবিদ্যার প্রতি অনেক আগ্রহ দেখায়। তাই তাঁরা আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে গাইড চাংয়ের কথা শোনে। পিতামাতারাও মনোযোগ দিয়ে গাইড চাংয়ের কথা শুনলেন। জাদুঘরের স্বেচ্ছাসেবকের কাছ থেকে জানা গেছে যে, ইউচ্যাটের মাধ্যমে চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোকা জাদুঘরের অ্যাকাউন্ট থেকে পরিদর্শনের সুযোগের জন্য আবেদন করা যায়। প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও রোববার দু’দিন খোলা থাকে জাদুঘরটি। প্রতিদিন চার বার গাইডের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দর্শকরা এক মাস আগে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শনের সময় বুকিং করতে পারেন।

 

বস্তুত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরগুলো চীনের জাদুঘরব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত হবার পাশাপাশি, বৈশিষ্ট্যময় অন্যান্য জাদুঘর পরিদর্শনের সুযোগও পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এটিও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের জ্ঞান অর্জনের ভালো প্ল্যাটফর্ম।

 

বেইজিং বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিদেশি ভাষা জাদুঘর’ গড়ে তোলা হয়েছে। জাদুঘরের বাইরে দেওয়ালে বিভিন্ন ভাষার শব্দ দেখা যায়। চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় এ জাদুঘর নিয়েও বেশ আলোচনা চলে। জাদুঘরে বিভিন্ন ভাষার উত্স, লেখা, উচ্চারণ, শিক্ষা, সম্প্রচারসহ আলাদা প্রদর্শনী এলাকা রয়েছে। এ জাদুঘর পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন ভাষার রূপান্তর ও উন্নয়নের ইতিহাস জানা সম্ভব।

 

বিশ্বে মোট ৭০০০ ধরনেরও বেশি ভাষা রয়েছে, এর মধ্যে লিখিত ভাষার ধরন প্রায় ৪০০০টি। একটি ছেলে এ তথ্য জেনে অনেক অবাক হয়। গত বছর থেকে বেইজিং বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর দশর্কদের জন্য খোলা হয়। শুধু আইডি কার্ড দিয়ে অনলাইনে পরিদর্শনের জন্য আবেদন করা যায়। প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার থেকে রোববার পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী জাদুঘরের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। যদি দর্শকের দলের সদস্যসংখ্যা ১০ জনের বেশি হয়, তখন আসার আগে বিশেষ গাইড পরিষেবার জন্য আবেদন করা যায়।

 

জাদুঘর ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোও নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। তবে, এখন চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলো শুধু ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের জন্য খোলা থাকে। এগুলো পাবলিক গ্রন্থাগারের মতো প্রত্যেকের জন্য খোলা থাকে না। তবে, এখন কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষামূলকভাবে ক্যাম্পাসের গ্রন্থাগার বাইরের মানুষের জন্যও উন্মুক্ত করার চেষ্টা করছে। যেমন, বেইজিং বৈদ্যুতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কারিগরি একাডেমির গ্রন্থাগার এখন সাময়িকভাবে বাইরের দর্শকদের জন্য খোলা থাকে। শুধু আইডি কার্ড ও মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে পারেন তাঁরা। এখানকার গ্রন্থাগার বিশাল, মোট ৫ তলা নিয়ে গঠিত এ ভবনে আরামদায়ক সোফা ও বিশাল টেবিল আছে। পড়াশোনার বেশ আরামদায়ক পরিবেশ। রাত ৯টা পর্যন্ত গ্রন্থাগার খোলা থাকে। তাই, পাঠকরা যথেষ্ঠ সময় নিয়ে এখানে থাকতে পারেন।

 

একজন প্রকৌশলী নিয়মিত এখানে আসা-যাওয়া করেন। তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের পরিবেশ বেশ শান্ত এবং কফি দোকানের চেয়ে অনেক ভালো। তিনি মনোযোগ দিয়ে এখানে কাজ করতে পারেন, পড়াশোনা করতে পারেন। গ্রন্থাগারের বিভিন্ন টেবিলের কাছে পাওয়ার সাপ্লাই আছে। পাঠকরা এখানে নিজেদের ল্যাপটপও ব্যবহার করতে পারেন।

 

একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে বেইজিংয়ের আরো কয়েকটি গ্রন্থাগার। পাঠকরা শুধু গ্রন্থাগারে বসে বই পড়ে না, বরং প্রয়োজন হলে বই বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারে। তবে, সময় মতো তা ফেরত দিতে হয়। আইডি কার্ড দিয়ে বই লেনদেনের কার্ডের জন্য আবেদন করতে হয়।

 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠগুলো আশেপাশের বাসিন্দাদের জন্য শরীরচর্চার গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মহামারীর সময় ক্যাম্পাসগুলো প্রায় বন্ধ ছিল। তখন ক্যাম্পাসের খেলার মাঠও বাইরের লোকদের জন্য খোলা ছিল না। তবে, গত বছর থেকে বেইজিংয়ের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের খেলার মাঠ ক্লাসের পর সাধারণ মানুষের জন্য খোলা থাকছে। যেমন, প্রতি সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৯টা এবং প্রতি শনি ও রোববারের সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টায় পর্যন্ত তা সাধারণ মানুষের জন্য খোলা থাকে।

 

যদি কোনো বিশেষ খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ঘন্টা অনুসারে ভাড়াও করা যায়। পিংপং, বাস্কেটবল বা সাঁতার কাটা—ইত্যাদি  বিভিন্ন খেলাধুলার ঘন্টার খরচ আলাদা। সাধারণত প্রতি ঘন্টায় প্রত্যেককে ২০ থেকে ৪০ ইউয়ানের মতো দিতে হয়।

 

চলতি বছর থেকে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত দৈনিক ২০০০ জন দর্শককে পরিদর্শনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। প্রতি শনিবার ও রোববার ১২ হাজার জনকে সুযোগ দেওয়া হয়। কেবল ক্যাম্পাস পরিদর্শন নয়, প্রদর্শনী হলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও দর্শকদের জন্য খোলা হয়েছে। যেমন, লাইভ শো, পিয়ানো কনসার্ট বা ফরাসি চারুকলার কনসার্টসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের লোকদের জন্য উন্মুক্ত, তবে টিকিট কাটতে হবে। যদি দর্শকরা প্রদর্শনী বা অনুষ্ঠানের টিকিট কাটেন, তাহলে ক্যাম্পাসে আসার সময় আবার বুকিংয়ের দরকার পরবে না। প্রদর্শনী উপভোগের পাশাপাশি ক্যাম্পাসও পরিদর্শন করতে পারবেন আপনি।

 

তৃণমূলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করতে উত্সাহ দিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে বিষয় নিয়েই পড়াশোনা করুক না কেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য পরিশ্রমের সাথে পড়াশোনা করা এবং  স্নাতক হওয়ার পর একটি ভালো চাকরি খুঁজে পাওয়া এবং এভাবে দেশের উন্নয়নে নিজ নিজ অবদান রাখা। এ প্রেক্ষাপটে, স্নাতক শিক্ষার্থীদের তৃণমূলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি করতে উত্সাহ দেয় চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেমন, ‘গ্রামীণ ডাক্তার পরিকল্পনা’, ‘চীনের অনুন্নত এলাকায় সহায়তা ও পরিষেবা প্রকল্প’ ইত্যাদিতে যোগ দিতে উত্সাহ দেওয়া হয়। এমন উদ্যোগের মাধ্যমে স্নাতক শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা যায় এবং বিভিন্ন এলাকার মধ্যে ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।

 

২০২৩ সালে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাব পেশ করে এবং তৃণমূলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নীতিমালাও একসাথে চালু করে।

যেমন, ‘গ্রামীণ ডাক্তার পরিকল্পনায়’ চীনের বিভিন্ন প্রদেশের চিকিত্সা বিভাগের স্নাতক শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যারা চিকিত্সক হিসেবে স্নাতক হয়েছেন, তাঁরা বিনা পরীক্ষায় বিভিন্ন গ্রামের হাসপাতাল বা চিকিত্সাকেন্দ্রের চাকরির জন্য আবেদন করতে পারেন। যদি দীর্ঘকাল ধরে গ্রামের হাসপাতালে কাজ করেন, তাহলে তাদের জন্য বিশেষ ভর্তুকিও দেওয়া হয়। বিভিন্ন পক্ষের যৌথ প্রয়াসে গ্রামীণ পুনরুজ্জীবন উদ্যোগের কাঠামোতে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামে মোট ৩৫ হাজারটি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

 

তৃণমূলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থীদের দক্ষতা চর্চার গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আঞ্চলিক সরকারের এই যৌথ উদ্যোগ এবং সংশ্লিষ্ট উত্সাহব্যঞ্জক নীতিমালা ইতিবাচক ভুমিকা রাখছে; শিক্ষার্থীদের কাজের আগ্রহও বাড়ছে।

 

তা ছাড়া, চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে চমত্কার কর্মী নির্বাচন’ ব্যবস্থা চালু করেছে। যারা তৃণমূলের প্রতিষ্ঠানে চমত্কার কাজ করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থীদের গ্রামে কাজ করার পরামর্শক শিক্ষক, তাদের জন্য বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। যারা চীনের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল, অনুন্নত এলাকা আর শিল্প ঘাঁটির জেলার তৃণমূল প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছে, এমন স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার খরচ বা পড়াশোনার ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থা আছে। যেমন, ইয়ুননান প্রদেশের জেলা ও উপজেলায় কর্মরত কর্মীদের জন্য প্রতি মাসে ৫০০ ইউয়ান ভর্তুকি দেওয়া হয়; উপকন্ঠ বা দূরবর্তী এলাকার জেলায় সরকারি অফিসের স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ২৩২০ ইউয়ানের ভর্তুকি দেওয়া হয়। চীনের চিয়াংসু প্রদেশে স্নাতক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচ ফেরত দেওয়ার নীতিমালা চালু হয়েছে। যেমন, টানা ৩৬ মাস ধরে চিয়াংসু প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের অনুন্নত এলাকায় কাজ করলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছরের পড়াশোনার খরচ সব ফেরত দেওয়া হবে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং অনুন্নত এলাকায় দক্ষ কর্মীর অভাবও অনেকটা মিটছে।

 (সুবর্ণা/আলিম/রুবি)