চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৬৯তম পর্বে যা থাকছে:
* মানব ভ্রুণ নিয়ে গবেষণায় চীনা বিজ্ঞানীদের সাফল্য
* মহাকাশ থেকে ৩১ কেজি নমুনা নিয়ে আসলো শেনচৌ-১৭
* কৃষির প্রধান সমস্যা লবণাক্ত মাটির সমাধান করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা
মানব ভ্রুণ নিয়ে গবেষণায় চীনা বিজ্ঞানীদের সাফল্য
নিষিক্তকরণ বা ফার্টিলাইজেশনের মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহের পর একটি মানব ভ্রূণ কেমন হয় তা জানতে থ্রি-ডি মডেল তৈরি করেছেন একদল চীনা গবেষক। তাদের এমন গবেষণার মাধ্যমে মানব ভ্রূণ বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়গুলো আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
এ ছাড়া নতুন এ মডেলটি ভ্রুণের অস্বাভাবিক বিকাশ, গর্ভপাত এবং অন্যান্য প্রজনন সমস্যার চিকিৎসা ও প্রতিরোধের জন্য নতুন উপায় খুঁজে পেতে সাহায্য করবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
এ সংক্রান্ত গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে সেল জার্নালে। চীনা গবেষকদের তৈরি মডেলটি ভ্রূণের বিভিন্ন কোষের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে, যার মধ্যে রয়েছে স্টেম সেল, ভ্রূণীয় কোষ এবং ট্রফোব্লাস্ট।
পরীক্ষাগারে মানব ভ্রূণের বিকাশের প্রথম ১৪ দিনে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে নীতিগত বাধা রয়েছে। কারণ পরীক্ষাগারে ভ্রূণের এই প্রাথমিক পর্যায় পর্যবেক্ষণ করা জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এই সময়ে ভ্রূণে কী ঘটে সেই বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত এতদিন থেকে গেছে অন্ধকারেই।
চীনের বিজ্ঞান একাডেমির ইনস্টিটিউট অফ জুওলজি এবং চায়না এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা চ্যালেঞ্জটি কাটিয়ে উঠতে নতুন কৌশল ব্যবহার করেছেন। তারা একটি মানব ভ্রূণের ৩৮ হাজার ৫৬২টি জিনের তথ্য সংগ্রহ করে উচ্চ-রেজুলেশনের প্রোফাইলিং সম্পন্ন করেছেন।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই গবেষণা ভ্রূণের প্রাথমিক বিকাশ, গর্ভপাত এবং ভ্রূণ সম্পর্কিত রোগ বোঝার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
মহাকাশ থেকে ৩১ কেজি নমুনা নিয়ে আসলো শেনচৌ-১৭
সফলভাবে ছয় মাসের মহাকাশ মিশন শেষে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে চীনের মহাকাশযান শেনচৌ ১৭। পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় রিটার্ন ক্যাপসুলটিতে ৩১ দশমিক ৫ কেজি গবেষণা নমুনা নিয়ে আসা হয়েছে। এসব নমুনা বিজ্ঞানীদের মহাকাশ এবং সৌরজগত সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে সাহায্য করবে।
ইতোমধ্যেই এসব গবেষণা নমুনা বেইজিংয়ে চীনের বিজ্ঞান একাডেমির টেকনোলজি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টার ফর স্পেস ইউটিলাইজেশনে (টিএসইউ) হস্তান্তর করা হয়েছে।
নমুনাগুলো ২৩টি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষামূলক প্রকল্প থেকে এসেছে, যার মধ্যে রয়েছে ৩২ ধরনের জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত পরীক্ষামূলক নমুনা। নমুনাগুলোর মধ্যে রয়েছে মানব অস্থি কোষ, অস্থি মজ্জা মেসেনকাইমাল স্টেম সেল, প্রোটিন ক্রিস্টাল, লিভিং অরগানিক মলিকুল এবং বীজ। এছাড়া রয়েছে ১৮ ধরনের পদার্থের নমুনা। এর মধ্যে রয়েছে- কন্টেইনারলেস ম্যাটেরিয়াল, উচ্চ-তাপমাত্রার ম্যাটেরিয়াল এবং এক্সট্রা-কেবিন এক্সপোজার ম্যাটেরিয়াল।
জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত পরীক্ষামূলক নমুনাগুলো জীববিজ্ঞানীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
নমুনাগুলো নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন তারা। বিশেষ করে মাইক্রোগ্রাভিটি পরিবেশের মধ্যে জীব কোষগুলো কীভাবে কাজ করে কিংবা কীভাবে জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পাদিত হয় সে বিষয়গুলো নিয়ে অনুসন্ধান করবেন।
এছাড়াও, তারা ট্রান্সক্রিপটোম সিকোয়েন্সিং এবং প্রোটিওমিকস সনাক্তকরণের মতো জৈবিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করে রোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য নতুন সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন।
ওষুধ ও ভ্যাকসিন বিকাশের সম্ভাবনাও অন্বেষণ করা চীনা বিজ্ঞানীরা।
শেনচৌ ১৭ মিশনের সাফল্য মহাকাশ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা মহাকাশ এবং সৌরজগত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। এছাড়াও, শেনচৌ ১৭ মহাকাশের পরিবেশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই তথ্যগুলো মহাকাশযান নির্মাণ ও মহাকাশ ভ্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য ব্যবহার করা হবে। এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
|| প্রতিবেদন: ফয়সল আবদুল্লাহ
|| সম্পাদনা: আফরিন মিম
কৃষির প্রধান সমস্যা লবণাক্ত মাটির সমাধান করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা
সূর্যের আলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ ফলন কিংবা অনুর্বর ভূমি ও স্বল্প জমিতে অধিক ফলন দেবে এমন উদ্ভিদ উদ্ভাবনে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন একদল চীনা বিজ্ঞানী। দেশটির বিজ্ঞান একাডেমির অধিভুক্ত ইন্সটিটিউট অফ জেনেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজির গবেষক সিয়ে ছির নেতৃত্বে এই গবেষণাটি পরিচালিত হচ্ছে।
গত ২০ বছরে সিয়ে এবং তার গবেষণা দল লবণাক্ত-ক্ষারীয় মাটি সহ্য করে এমন গাছপালা নিয়ে গবেষণা করছেন।
চীনের কৃষিক্ষেত্রের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি হলো মাটির লবণাক্ততা ও মাটির ক্ষার। এই লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে চাষ করা খুবই জটিল কারণ এগুলো উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং ফসলের উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। দেশটিতে প্রায় ১০ কোটি হেক্টর লবণাক্ত-ক্ষারযুক্ত কৃষি জমি রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ হেক্টর জমি চাষের জন্য উপযোগী।
ফসলকে লবণাক্ত-ক্ষারীয় মাটি সহনশীল উপযোগী করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান খুঁজে বের করেছেন গবেষক সিয়ে এবং তার দলের সদস্যরা। গবেষক দলটি মূলত সরঘাম বা জোয়ার নামের এক জাতীয় খাদ্য শস্য নিয়ে গবেষণা করা এই উপাদানটি খুঁজে বের করেছেন।
বিশ্বের পঞ্চম সর্বাধিক উৎপাদিত খাদ্য শস্য জোয়ার, যা কঠিন পরিবেশ, খরা কিংবা লবণাক্ত-ক্ষার মাটিতেও বেঁচে থাকে এবং অধিক পরিমাণে ফলন দেয়।
সিয়ে এবং তার গবেষক দল জোয়ারের জিনোম অন্বেষণ করে লবণাক্ত-ক্ষারীয় মাটিতে এর সহনশীলতার জন্য সম্পৃক্ত কয়েকটি জিনকে চিহ্নিত করেছেন। তারা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিন আবিষ্কার করেছেন, যা লবণাক্ততা, খরা এবং তাপ সহনশীলতায় ভূমিকা পালন করে।
২০১৫ সাল থেকে সিয়ে এবং তার দল চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও নিংশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছেন। বিশ্বজুড়ে সংগ্রহ করা ৩৫০টিরও বেশি সরঘাম জাতের জিনোমের সিকোয়েন্সিং করেছেন।
এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল সায়েন্স এবং ন্যাশনাল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, AT1 (এটি১) নামক একটি জিন লবণাক্ত কিংবা ক্ষার মাটিতে উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং টিকে থাকার ক্ষমতাকে হ্রাস করে। জিনটি বাদ দিলে যে কোনও উদ্ভিদ লবণাক্ত পরিবেশে বেশি সহনশীল হয়ে উঠবে।
গবেষকরা দেখেছেন এই জিন বাদ দিলে নিংশিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং চিলিন প্রদেশের লবণাক্ত-ক্ষারীয় কৃষিজমিগুলোতে ধান, গম, ভুট্টা মতো ফসলের ফলন প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আবিষ্কারটি চীনের এবং সমগ্র বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ৬১ কোটি ৮০ লাখ হেক্টর পরিত্যক্ত কৃষিজমি রয়েছে - যা উচ্চ ক্ষারযুক্ত কৃষিভূমি। গবেষণায় বলা হয়েছে, এই পরিমাণ কৃষিজমির মাত্র ২০ শতাংশে যদি ফসল চাষ হয় তাহলে প্রতি বছর কমপক্ষে ২৫ কোটি টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন হবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- নাসরুল্লাহ রাসু
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ, আফরিন মিম
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী