চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৬৮তম পর্বে যা থাকছে:
* বিদ্যুৎ সঞ্চয়ে সক্ষম বিশেষ পোশাক তৈরি
* পৃথিবীতে আনা হবে মঙ্গলগ্রহের মাটি
* পানি বিশুদ্ধিকরণ প্রযুক্তি উদ্ধাবন
বিদ্যুৎ সঞ্চয়ে সক্ষম বিশেষ পোশাক তৈরি
একটি বিশেষ ধরনের পোশাক তৈরি করেছেন এক দল চীনা বিজ্ঞানী। পোশাকটি নমনীয় ও বাতাস চলাচল উপযোগী। পাশাপাশি এটি দিনের বেলায় সূর্যের আলো থেকে শক্তি সঞ্চয় করে তৈরি করবে বিদ্যুৎ। যে বিদ্যুতে চলবে স্মার্টফোন, ঘড়ি এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস।
সম্প্রতি জার্নাল নেচার জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গবেষণাটি করেছেন। অভাবনীয় আবিষ্কারটি পোশাক শিল্পে এবং নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
পোশাকটি তৈরি করা হয়েছে এমন এক ন্যানো ফাইবার দিয়ে যা লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির কাজ করবে। সেই সঙ্গে সোলার প্যানেলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি সূক্ষ্ম সোলার সেল লাগানো আছে এতে। গতানুগতিক তরল ইলেক্ট্রোলাইটকে পলিমার জেল ইলেক্ট্রোলাইট দিয়ে প্রতিস্থাপন করে এই পরিধানযোগ্য ব্যাটারিকে করা হয়েছে নমনীয়।
পোশাকটিতে ব্যবহৃত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিটি অধিক পরিমাণে শক্তি সঞ্চয়ে করে রাখতে সক্ষম। এই পরিমাণ শক্তি দিয়ে ড্রোনের মতো বৈদ্যুতিক ডিভাইসে শক্তি সরবরাহ করা যাবে।
গবেষণা পত্রের লেখক পেং হুইশং জানান, বর্তমানে তারা পরীক্ষামূলকভাবে এর উৎপাদন শুরু করেছেন এবং প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ ওয়াট-ঘণ্টা উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছেন। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে এক সঙ্গে ২০টি মোবাইল ফোন চার্জ করা যাবে। এই ফাইবার ব্যাটারি অগ্নি নির্বাপণ, দুর্যোগে সহায়তা, মেরু অভিযান এবং মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যাবে।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, যারা ক্যাম্পিং, ট্র্যাকিং বা অন্যান্য আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার করতে পছন্দ করেন তাদের জন্য এই পোশাক অত্যন্ত উপকারী কারণ এটি বিদ্যুতের উৎসের প্রয়োজনীয়তা দূর করে। পাশাপাশি এই পোশাকটি বাহিরে কাজ করা কর্মীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে, যারা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহের বাইরে থাকে। এছাড়াও, এটি পরিবেশবান্ধব পোশাক হিসেবেও পরিচিত হতে পারে কারণ এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করে না।
এই পোশাকটি বাজারে কখন আসবে এবং এর দাম কত হবে তা এখনও অজানা। তবে, বিজ্ঞানীরা আশা করছেন অচিরেই সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যাবে এই পোশাকটি।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
পৃথিবীতে আনা হবে মঙ্গলগ্রহের মাটি
পৃথিবীতে মঙ্গলগ্রহের মাটি আনার ক্ষেত্রে প্রথম দেশ হতে পারে চীন। চাইনিজ একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষাবিদ এবং চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসনের নেতৃস্থানীয় মহাকাশ বিজ্ঞানী উ ওয়েরেন সম্প্রতি হুবেই প্রদেশের উহানে এ তথ্য জানিয়েছেন।
উ জানান, ২০৩০ সালে থিয়ানওয়েন-৩ নামের একটি ঐতিহাসিক মিশনের মাধ্যমে মঙ্গলগ্রহের নমুনা পৃথিবীতে আনা পরিকল্পনা চলছে। পাশাপাশি বিশ্বের প্রথম মঙ্গলগ্রহের নমুনা পরীক্ষাগার স্থাপনও করতে শুরু করেছে দেশটি।
চীনের জাতীয় মহাকাশ এজেন্সি সিএনএসএ-এর মিশন পরিকল্পনাকারীদের মতে, থিয়ানওয়েন-৩ রোবোটিক মহাকাশযানের চারটি অংশ থাকবে—একটি ল্যান্ডার, একটি অ্যাসেন্ডার, অরবিটার এবং একটি রিএন্ট্রি মডিউল। হাইনান প্রদেশের ওয়েনচাং মহাকাশ উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে দুটি লং মার্চ-৫ রকেটে করে এটি যাত্রা শুরু করবে।
ল্যান্ডার এবং অ্যাসেন্ডার মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করবে এবং মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশের আগে প্রয়োজনীয় কক্ষপথ সংশোধন চালাবে। পরে একটি সফট ল্যান্ডিং সম্পন্ন করবে এই অংশটি।
কক্ষপথের স্ট্যাক-অরবিটার ও রিএন্ট্রি মডিউলটি সিগন্যাল রিলে করতে মঙ্গল গ্রহের চারপাশে উড়বে এবং নমুনার জন্য অপেক্ষা করবে। নমুনা সংগ্রহের পর তা ভ্যাকুয়াম পাত্রে নেওয়া হবে এবং অ্যাসেন্ডারের মাধ্যমে তা কক্ষপথে থাকা রিএন্ট্রি মডিউলে যুক্ত হবে।
তবে এ মিশনে কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও জানান, আন্তর্জাতিক মহাকাশচারী ফেডারেশনের মহাকাশ পরিবহন কমিটির ভাইস-চেয়ার ইয়াং ইউকুয়াং। তার মতে, মঙ্গলের জটিল বায়ুমণ্ডলের কারণে নমুনা সংগ্রহের পর সেটাকে কক্ষপথে নিয়ে আসা বড় চ্যালেঞ্জ। আবার বড় একটি নভোযানকে মঙ্গলের মাটিতে ঠিকঠাকভাবে ল্যান্ড করাও বেশ জটিল কাজ।
২০২০ সালের জুলাইতে চীন প্রথম মঙ্গল অভিযানে থিয়ানওয়েন-১ পাঠায়। ২০২১ সালের মে’তে নভোযানটি মঙ্গলপৃষ্ঠে নামে ও এর ভেতর থেকে রোভার ‘ঝুরং’ বের হয়।
একটি গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করার রোবোটিক মিশন থিয়ানওয়েন-২। এটি ২০২৫ সালে উৎক্ষেপণ করা হবে এবং সব ঠিক থাকলে ২০২৭ সালে এটি নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবে।
|| প্রতিবেদন: ফয়সল আবদুল্লাহ
|| সম্পাদনা: শুভ আনোয়ার
পানি বিশুদ্ধিকরণ প্রযুক্তি উদ্ধাবন
পলিয়েস্টারের একটি নতুন পাতলা ফিল্ম তৈরি করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এর মাধ্যমে পাানি থেকে জীবাণু দূরীকরণ কিংবা সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে লবণসহ অপ্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানগুলো দূর করা এবং পানি বিশুদ্ধিকরণ প্রযুক্তি উন্নত করতে সক্ষম।
এর ফলে সমুদ্রের পানির লবণ অপসারণ করে তা সেচ, শিল্প কাজে ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের উপযোগী করা সম্ভব হবে।
বিশ্বের অনেক জাহাজ এবং সাবমেরিনে পানীয় জল তৈরির জন্যেও এমন উদ্ধাবন ব্যাপক কাজ দেব। তবে বর্তমানে বিলবণীকরণ পদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য হলো মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে খরচ কমিয়ে পানি সরবরাহ করা।
সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সায়েন্সে’ প্রকাশ করা হয়েছে।
নানচিং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চাং সুয়ানের নেতৃত্বাধীন একটি গবেষণা দল বাণিজ্যিক পলিমাইড মেমব্রেনের কয়েকটি সীমাবদ্ধতা দূর করে পলিয়েস্টার রিভার্স অসমোসিস মেমব্রেন তৈরি করেছে, যা সমুদ্রজল বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তির পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি নতুন সমাধান প্রদান করে।
রিভার্স অসমোসিস মেমব্রেনগুলো পানির বয়ে চলা এবং লবণ পৃথিকীকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করছে। তবে চাং জানান, জীবাণু দূরীকরণ কিংবা সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে লবণসহ অপ্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানগুলো দূর করা এবং পানি বিশুদ্ধিকরণ প্রযুক্তি উন্নত করতে পূর্ব-পরিশোধন প্রক্রিয়ায় সমুদ্রের পানিতে ক্লোরিনযুক্ত করতে হবে। যদিও ক্লোরিন পলিমাইড ফিল্মের রাসায়নিক গঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এমনকি সরাসরি একে ক্ষয় করে। সুতরাং, রিভার্স অসমোসিস ফিল্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করার আগে ক্লোরিনেশনের পরে সমুদ্রের জলকে ডিক্লোরিনেট করতে হবে।
এই গবেষণাটি বিশ্বব্যাপী পানির ঘাটতি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বিলবণীকরণ প্রযুক্তি সমুদ্রজলকে পানীয় জলে রূপান্তর করার একটি কার্যকর উপায় প্রদান করে, যা বিশ্বের অনেক অঞ্চলে একটি মূল্যবান সম্পদ। নতুন পলিয়েস্টার ঝিল্লি বিলবণীকরণ প্রক্রিয়াটিকে আরও দক্ষ এবং সাশ্রয়ী করে তুলতে সাহায্য করতে পারে, যা এটিকে আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব করে তুলতে পারে।
এই গবেষণার ফলাফলগুলি সম্ভবত বিশ্বব্যাপী জল নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- নাসরুল্লাহ রাসু
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী