‘ঘুরে বেড়াই’ পর্ব- ৬৭
2024-04-23 21:38:33

 


এবারের পর্ব সাজানো হয়েছে   

  

১। চীনের একটি রাস্তাকে ভালোবেসে ২৪ বার চীন ভ্রমণ করেছেন মার্কিন লেখক 

২। ঘুড়ির শহরে শিহু গার্ডেন


বিশ্বব্যাপী অপরূপ সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়ে রেখেছে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। কতো-শতো দেশ, কতো সংস্কৃতি, কতো ভাষা, কতো পেশা,.... কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা সময়ের টানাটানিতে দেখা হয় না, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’  

‘একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু...’সেই অদেখাকে দেখাতেই আমাদের আয়োজন "ঘুরে বেড়াই"। 

দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান, সেখানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, এবং সেই স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান ‘ঘুরে বেড়াই’।     

ঘুড়ে বেড়াই অনুষ্ঠানের ৬৭তম পর্ব আজ। আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি, আফরিন মিম।      

  

১। চীনের একটি রাস্তাকে ভালোবেসে ২৪ বার চীন ভ্রমণ করেছেন মার্কিন লেখক 

“আমি পথের টানেই পথ চলি, পথের গ্লানি অঙ্গে মাখি

পথে পথে স্বপ্ন দেখি, পথ ফুরোলেই শিউরে উঠি” 

কবিতার মত কিছু কিছু পথ আঁকড়ে থাকে সকলের মনে। স্মৃতির কুঠুরিতে। কিন্তু শুধু একটি পথকে ভালোবেসে সাত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে সেই পথকে আলিঙ্গন করতে কেউ ছুটে আসছেন, এমন কথা শুনেছেন কখনো?

৮১ বছর বয়সে এসেও আমেরিকান নাগরিক হোপ জাস্টম্যান একটি পথের জন্য প্রকাশ করেছেন নিজের ভালোবাসা। তার সে ভালোবাসার পথের নাম "শু রোড"। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ২০০০ বছরেরও পুরনো এই রাস্তার প্রেমে পড়েছেন তিনি।  

 

১০০০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, শুদাও রাস্তাটি শু রাজ্যের আমলে নির্মিত। যা এখন শায়ানসিকে সিচুয়ান প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করে। একসময় প্রাচীন চীনের প্রাণকেন্দ্র ছিল এটি। এই রাস্তাটি অন্য এক কারণেও বিখ্যাত। চীনের শ্রদ্ধেয় কবি লি পাই-এর ক্লাসিক রচনাতে রাস্তাটি পরিচিত “শু দাও নান” মানে “শু রাস্তার অসুবিধা” নামে। এখানে কবি শুদাওকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ পথ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তার মতে, যে রাস্তা যা পাড়ি দেওয়া ছিল আকাশ জয়ের সমতুল্য।  

 

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় বসবাসকারী লেখক জাস্টম্যানের কাছে  শু রোড  ভ্রমণ করা মানেই একঝাঁক বিশুদ্ধ আনন্দ। ২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত  তিনি এ রাস্তা ভ্রমণ করেছেন ২৪ বার। 

গেল ১৫ মার্চ, প্রাচীন এ রাস্তা ধরে যাত্রা শুরু করে আবার কুয়াং ইয়ুয়ানে ফিরে আসেন। সুবিশাল পাহাড় এবং সবুজ গাছ থেকে স্ফটিক-স্বচ্ছ স্রোত এবং পাহাড় ঘেঁষা কাঠের রাস্তা; সব কিছুতেই মুগ্ধ তিনি।

 

মার্কিন লেখক জাস্টম্যান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে এত পুরনো রাস্তা নেই। আমাদের খুব বিখ্যাত রাস্তা আছে, সবচেয়ে পুরনোটি ৩০০ বছর আগের। কিন্তু এই শুদাও রাস্তা দুই হাজার বছর আগেকার। আমি এখানে আমার বন্ধুদের নিয়ে এসেছিলাম। তারাও খুব খুশি হয়েছিল। কারণ তারা চীনে এত সুন্দর রাস্তা দেখবে এমনটা আশা করেনি।’

প্রাচীন এই রাস্তার সঙ্গে জাস্টম্যানের হৃদ্যতা কলেজ জীবন থেকেই। চীনা সাহিত্য এবং শিল্পের একটি কোর্সের অংশ হিসেবে, তিনি বোস্টনে একটি প্রদর্শনী দেখেন, যেখানে সম্রাট মিনহুয়াং-এর সিচুয়ানে যাত্রা নামে একটি চিত্রকর্ম তার মনোযোগ কাড়ে। পেইন্টিংয়ে দেখানো একটি কাঠের রাস্তা দেখেও বেশ অবাক হন তিনি।  

 

২০০১ সালে, জাস্টম্যান একটি চীনা সংবাদপত্রের ইংরেজি সংস্করণে এরকমই একটি রাস্তার ছবি দেখেন। তারপরে তিনি বুঝতে পারলেন প্রাচীন এই রাস্তাটি এখনও আছে।  


চীনা পণ্ডিত চেন ইয়াং বলেন, ‘২০০১ সালের বসন্তের দিকে আমি কুয়াংইয়ুয়ান সিটি লাইব্রেরিতে কাজ করছিলাম। তখন এক বিদেশি আমার কাছে আসে এবং বলে, সে পত্রিকায় আমার ছবি দেখেছে। সে শু রোডের একটি ছবি আমাকে দেখায় এবং সেখানে যেতে চায়। তাকে নিয়ে যাই। সে ওই রাস্তায় হাঁটলো, উপভোগ করলো। তারপর চলে গেল। অবাক করা বিষয়টি হলো, সে পরের বছর এবং তার পরের বছরও আবার এখানে এসেছিল।’

 

এরপর থেকে, জাস্টম্যান শু প্রায় প্রতি বছর এখানে আসেন। স্থানীয় বাসিন্দা লি চিয়াওচুন এখন তার নিয়মিত ট্যুর গাইডদের একজন।

ট্যুর গাইড লি চিয়াওচুন বলেন,‘শু রোডের জন্য তার আবেগ ও অধ্যবসায় দেখেছি । তিনি ক্লান্তিকে ভয় পান না। যতবার আমি তার সঙ্গে হাঁটা শেষ করতাম, তিনি ক্যামেরায় অনেক তথ্য রেকর্ড করে নিতেন। মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভেঙে গেলে দেখি তিনি নোট লিখছেন।’  

 

২০০৩ সালে, জাস্টম্যান শু রোডের পরিচয় নিয়ে একটি বই লিখতে শুরু করেন। এটির বিস্তৃত   গবেষণার জন্য সে বছর চার থেকে পাঁচবার চীন ভ্রমণ করেন। ২০০৭ সালে, তিনি চেন ইয়াংকে তার বই "গাইড টু হাইকিং চায়না'স ওল্ড রোড টু শু” তৈরি করে পাঠান।


চীনা পণ্ডিত চেন ইয়াং বলেন, "প্রাচীন শু রোড, স্থানীয় রীতিনীতি এবং সাধারণ চীনাদের জীবন দেখানো এই বইয়ে । আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছি। একজন বিদেশির সঙ্গে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের এই যে ভালোবাসা, এই যে গবেষণা, তা আমাকে ভীষণ আলোড়িত করেছে।

 

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবার প্রাচীন সড়কে পা রাখলেন জাস্টম্যান। তার রোপণ করা তার ছোট সাইপ্রাস গাছটি এখন অনেক বড় হয়েছে। 

মার্কিন লেখক জাস্টম্যান বলেন, "এটা আমার গাছ। নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে রোপণ করেছিলাম। মনে হয় যেন আমার একটি অংশ শু রোডে রয়ে গেছে। গাছটিও বড় হতে হতে হাজার বছরের পুরনো শু রোডটি দেখবে।’

 

এ বছরের ১৮ মার্চ জাস্টম্যান তার বন্ধুদের পক্ষ থেকে রোডটিতে আরও দুটি চারা রোপণ করেন। এইভাবে চীনের প্রাচীন শু রোডে ভালবাসার নজির রেখে যান তিনি।  

২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, এই পথটি সম্পর্কে অনেক সুপরিচিত গল্প আছে।  হাইকিং এবং দর্শনীয় স্থানগুলির জন্য আজও  একটি বিখ্যাত রুট এটি।



প্রতিবেদন- হোসনে মোবারক সৌরভ

সম্পাদনা- আফরিন মিম 


২। ঘুড়ির শহরে শিহু গার্ডেন 

ওয়েইফাং সিটির অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান শিহু গার্ডেন। এখানে রয়েছে জলপ্রপাত, পুকুর, সেতু, পাহাড়ি এলাকা। ওয়েইছং জেলার হুচিয়াপাইফাং স্ট্রিটে শিহু গার্ডেন অবস্থিত। 

প্রাচীন চীনে ইয়াংজি নদীর উত্তরে ও  দক্ষিণে দুই রকম উদ্যান স্টাইল অনুসরণ করা হতো। । ইয়াংজি নদীর দক্ষিণে যেসব উদ্যান রয়েছে তারা একটা বিশেষ রীতি অনুসরণ করে। এই রীতিকে বলা হয় চিংনান স্টাইল। 

 

ওয়েইফাং ইয়াংজি নদীর উত্তরে অবস্থিত হলেও  শিহু গার্ডেনে চিংনান স্টাইলের চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে। এই উদ্যানকে বলা হয় উত্তরে অবস্থিত দক্ষিণ স্টাইলের উদ্যানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। উদ্যানটির রয়েছে প্রায় দেড়শো বছরের ঐতিহ্য। 

ছিং রাজবংশের (১৬১৬-১৯১১ অব্দ)সময়কার ওয়েইফাংয়ের একজন ধনী সামন্তপ্রভু তিং শানবাও এই উদ্যান গড়ে তোলেন। ১৮৮৫ সালে উদ্যানটি গড়ে তোলা হয়। তখন এটি তিং শানবাও ও তার পরিবারের ব্যক্তিরা ব্যবহার করতেন। তবে  সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৮৮ সালে এটি জাতীয় সুরক্ষার আওতায় আনা হয়। 

 

এখানে রয়েছে শিহু ভবন, প্যাভিলিয়ন, অদ্ভুত আকারের পাথরখণ্ড, কাঠের কোরিডর, কারুকার্য করা সেতু, রঙিন মাছ, দৃষ্টিনন্দন জলপ্রপাত ও বাগান। এখানে তিনশর বেশি কক্ষ ও হলরুম রয়েছে। ২১টি প্রাঙ্গণ আছে। এখানে সংগ্রহশালায় রয়েছে বিখ্যাত শিল্পীদের চমৎকার কিছু ক্যালিগ্রাফি ও পেইন্টিং। 

 

বসন্তে এই উদ্যান অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে ওঠে। পুরো উদ্যানটি ঘুরে দেখতে দুই থেকে তিনঘন্টা সময় লাগে। তবে চাইলে সারাদিনও এখানে কাটানো যায়।বসন্তের চমৎকার আবহাওয়া ও ফুলের দৃশ্য উপভোগ করতে হলে শিহু উদ্যান খুবই উপযোগী স্থান। উদ্যানের ভিতরে রয়েছে রেস্টুরেন্ট ও সুভ্যেনির শপ। 

 

ছিং রাজবংশের শেষদিককার একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও ক্যালিগ্রাফার  খাং ইয়ুওয়েই  এই বাগানের অনেক প্রশংসা করেছেন। ওয়েইফাং শহরে যারা ভ্রমণ করেছেন তারা এই স্থানটির সৌ্যন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একাধিকবার এই উদ্যানে গিয়েছেন। 


প্রতিবেদন- শান্তা মারিয়া 

সম্পাদনা- আফরিন মিম 




ঘুরে বেড়াই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও প্রযোজনা - আফরিন মিম 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী