‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং ভেষজের গুণ নিয়ে আলোচনা ‘হারবাল হিলিং’।
#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা
মৃগীরোগের টিসিএম চিকিৎসা
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি স্নায়ুর এক ধরনের ক্ষতি, যা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে ঘটে। রক্তে উচ্চমাত্রায় গ্লুকোজ সারা শরীরের স্নায়ুকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি সাধারণত পায়ের স্নায়ুগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
মৃগীরোগ বা এপিলেপসি মস্তিষ্কের একটি দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগ, যা যে কোনও বয়সের মানুষেরই হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মৃগীরোগ রয়েছে। এটি সবচেয়ে বিস্তৃতভাবে বিরাজমান স্নায়বিক রোগগুলোর একটি।
মৃগীরোগের প্রায় ৪০ ধরন রয়েছে। রোগীদের সাধারণত যেসব লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায়, সেগুলো হলো হঠাৎ শরীরের কোনও অংশে খিঁচুনি শুরু হওয়া এবং পর্যায়ক্রমে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া; হঠাৎ ঢলে পড়া; শরীর শক্ত হয়ে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যাওয়া; হঠাৎ মাথা, পিঠ বা পুরো শরীর সামনে ঝুঁকে আসা; জ্ঞান হারানো; এবং প্রায় কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া।
মৃগীরোগের চিকিৎসার জন্য প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা মূলত ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে তবে টিসিএম রোগটিকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখে এবং সেভাবে উপশমের চেষ্টা করে। মৃগীরোগের টিসিএম চিকিৎসার লক্ষ্য থাকে শরীরের মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে উপসর্গ উপশম করা।
টিসিএমে মনে করা হয়, মৃগীরোগ হয় শরীরের অত্যাবশ্যক শক্তি বা ‘ছি’ এবং রক্ত সঞ্চালনের ভারসাম্যের ব্যাঘাতের কারণে। এ ভারসাম্যের ফলে শরীরে অভ্যন্তরে তাপ বেড়ে যায়, কফ জমে কিংবা ‘ছি’ প্রবাহে স্থবিরতা আসে। টিসিএম তত্ত্ব মতে, যখন এই ভারসাম্যহীনতা শরীরের অভ্যন্তরে শক্তি ও রক্ত প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, তখন বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে লিভার ও প্লীহার কার্যকারিতা ব্যাহত হয় এবং খিঁচুনি দেখা দেয়।
মৃগীরোগের টিসিএম চিকিৎসায় সাধারণত ভেষজ ওষুধ, আকুপাংচার, ডায়েটারি থেরাপি এবং প্রতিটি রোগীর শারীরিক গঠন অনুসারে জীবনযাত্রার পরিবর্তন সম্পর্কিত থাকে।
ভেষজ ওষুধ: মৃগীরোগের টিসিএম চিকিৎসার কেন্দ্রবিন্দুই হলো ভেষজ ওষুধ। প্রতিটি রোগীর লক্ষণ ও উপসর্গ বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসকরা তার জন্য টিসিএম ফর্মুলেশন নির্ধারণ করেন। তবে ভেষজগুলোর মধ্যে সাধারণত থাকে আনকারিয়া রাইঙ্কোফিলা (কোউ থ্যং), পোরিয়া কোকোস (ফু লিং), অ্যাকোরাস গ্রামিনাস (শি ছ্যং ফু) এবং পলিগালা টেনুইফোলিয়া (ইউয়ান চি)। মনে করা হয়, এই ভেষজগুলোর শান্ত ও নিউরোপ্রোটেক্টিভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ‘ছি’ এবং রক্তের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং স্নায়ুকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে।
আকুপাংচার: আকুপাংচার টিসিএমের একটি মূল উপাদান। মৃগীরোগের আকুপাংচার চিকিৎসায় যকৃত ও প্লীহার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেরিডিয়ান বিন্দুগুলোতে আকুপাংচার সুঁই ফোটানো হয় এর মধ্য দিযে ‘ছি’ ও রক্তের প্রবাহে ভারসাম্য আসে। ফলে খিঁচুনি কমে।
ডায়েটার থেরাপি: টিসিএমে মনে করা হয়, মৃগীরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য বজায় রাখা এবং রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে খাদ্য। এ রোগের চিকিৎসায় এমন খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়, যা তাপ ও কফ জমায়, যেমন মশলাদার ও চর্বিযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল এবং অতিরিক্ত পরিমাণে মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার। এর বদলে, শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে এবং ভারসাম্যকে উন্নীত করে এমন খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, যেমন ফল, শাকসবজি ও ভেষজ চা।
জীবনধারা পরিবর্তন: ভেষজ ওষুধ, আকুপাংচার ও ডায়েটারি থেরাপির পাশাপাশি, টিসিএম সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে সমর্থন করার জন্য মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল যেমন ছিকং, থাই চি, ধ্যান, নিয়মিত ব্যায়াম, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
#চিকিৎসার_খোঁজ
বহু বিভাগে খ্যাতি ইয়ুন নান বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত হাসপাতালের
ইয়ুন নান বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত হাসপাতাল চীনের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় খুনমিং শহরের প্রাচীনতম চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম। প্রায় ১শ বছর আগে ১৯২৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সোসাইটির কুনমিং শাখা হাসপাতাল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল। ১৯৩৮ সালে, জাপানবিরোধী যুদ্ধের সময় এটি শাংহাই থংচি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের শিক্ষণ হাসপাতাল হিসাবে কাজ করছিল এবং চীনা সৈন্যদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
হাসপাতালটি ‘মানবতা, ভ্রাতৃত্ব ও উৎসর্গ’ এই মূল্যবোধকে ধারণ করে এবং ‘সবার আগে রোগীর যত্ন’কে মূল মন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করেছে। ছিয়ানব্বই বছরের উত্থান-পতনের পর এটি এখন প্রাদেশিক-স্তরের সর্বোচ্চ-পর্যায়ের সামগ্রিক হাসপাতালে পরিণত হয়েছে, যেখানে চিকিৎসা, শিক্ষাদান, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং স্বাস্থ্যরক্ষা সেবা একীভূত হয়েছে।
ইয়ুন নান বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত হাসপাতালটি ইয়ুন নান দ্বিতীয় গণহাসপাতাল নামেও পরিচতি। বাহান্ন একর এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ১২শ শয্যার এ হাসপাতালে বর্তমানে কর্মরত ২ হাজার ৪শর বেশি শিক্ষণ ও নার্সিং কর্মী এবং শতাধিক জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদ।
বর্তমানে দুটি জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিকাল বিশেষত্ব রয়েছে এ হাসপাতালে। সেগুলো হলো জেনারেল সার্জারি এবং পুনর্বাসন মেডিসিন। এখানে একটি জাতীয় পর্যায়ের ওষুধের ক্লিনিকাল পরীক্ষাগার এবং ৪টি জাতীয়-স্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও রয়েছে।
ইয়ুন নান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হাসপাতাল হিসাবে, প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় একাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, পাঁচ বছরের স্নাতক মেডিকেল কোর্সের পাঠ্যপুস্তকে ‘সার্জারি’ এবং ‘সংক্রামক রোগ’ শিক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।
দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় হাসপাতালটি দুটি প্রধান জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রকল্প, ১৩ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় দুটি প্রধান জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রকল্প, ২১টি জাতীয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ফাউন্ডেশন প্রকল্প এবং ১৫৫টি প্রাদেশিক প্রকল্প গ্রহণ করে। ইয়ুন নান প্রাদেশিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অগ্রগতি পুরস্কারের মধ্যে ৪টি দ্বিতীয় পুরস্কার এবং ১৫টি তৃতীয় পুরস্কার জিতেছে এই হাসপাতাল।
চক্ষুবিদ্যা, এন্ডোক্রাইনোলজি, ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিন, ট্রমা সার্জারি, নিউরোলজি সার্জারি ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে ইয়ুন নান বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত হাসপাতাল।
#হারবাল_হিলিং
হরিতকীর হরেক গুণ
অনেক অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাব্যবস্থায় হরিতকীকে খুবই মূল্যবান একটি ভেষজ বলে মনে করা হয়। নানা গুণের কারণে হরিতকীর ব্যবহার অসীম। এতে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, আয়রন, সেলেনিয়াম, ম্যাংগানিজ ও কপারের মতো খনিজ উপাদান। জানিয়ে দিচ্ছি হরিতকীর নানা গুণ সম্পর্কে:
হজমশক্তি বাড়ায়: হজমে সমস্যা হয় যখন খাবারের মধ্যে থাকা পুষ্টি ভালভাবে শরীরে মেশে না। অন্যকথায়, যখন ভালভাবে পাকস্থলী খাবার পরিপাক করতে পারে না। তাই হজমের সমস্যা সমাধানের জন্য পাকস্থলীর যাবতীয় কাজ ঠিকভাবে হওয়া দরকার। হরিতকী এই কাজটি করে। দুপুরে আর রাতে খাবারের পর হরিতকী গুঁড়ো উষ্ণ গরম পানিতে মিশিয়ে খেলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়।
সর্দি-কাশি দূর করে: হরিতকীর মধ্যে শরীরের কফ উপাদান ব্যাল্যান্স করার ক্ষমতা থাকে। সেজন্য এ ফল গ্রহণ করলে সর্দি-কাশি দূরে থাকে। তুলসী ও মধুর মিশিয়ে হরিতকী গুঁড়ো খেলে এ ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে: ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাব্যবস্থায় মনে করা হয়, হরিতকী রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। এই ভেষজের মধ্যে থাকা হাইপোগ্লাইকেমিক উপাদান শরীরে অতিরিক্ত গ্লুকোজ তৈরি হতে দেয় না। ফলে ডায়াবেটি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ওজন কমায়: হরিতকী মেটাবলিজম ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে খাবার ভালো করে হজম হয় এবং শরীরে ফ্যাট জমে যায় না। এতে করে চর্বিও কম হয়। ভালো ফলাফলের জন্য হরিতকীর গুঁড়ো রোজ খাবার পর অল্প পরিমাণে খাওয়া যায়।
ত্বকের সমস্যা দূর করে: হরিতকী রক্ত পরিশুদ্ধ করে আবার পেট পরিষ্কার রাখে। এই দুটি দিক ঠিক থাকলে ত্বকের প্রাথমিক সমস্যাগুলো এমনিতেই আশি শতাংশ কমে যায় ভিতর থেকে। সকালে খালি পেটে গরম পানিতে মিশিয়ে নিয়মিত হরিতকী চূর্ণ খেলে ত্বকের অনেক সমস্যা দূর হয়।
আর্থ্রারাইটিসের সমস্যা কমায়: হরিতকীর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে। আর ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করতে, টিস্যু মজবুত করতে সাহায্য করে। টিস্যু ও হাড় মজবুত হলে অস্থিসন্ধিতে ব্যাথা কমবেই। আর্থ্রারাইটিসের সমস্যা কমাতে হরিতকীর গুঁড়ো খাওয়ার পাশাপাশি হরিতকীর তেল মালিশ করা যায় গিঁটের ব্যাথার স্থানে।
‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।