‘তারুণ্যের অগ্রযাত্রা’ পর্ব ৬৫
2024-04-20 20:34:26


‘’আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।” 

হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সাম্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে আবার এলো খুশির ঈদ।  ঈদ মোবারক। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা। 


‘তারুণ্যের অগযাত্রা’ অনুষ্ঠানে স্বাগত জানাচ্ছি আমি রওজায়ে জাবিদা ঐশী। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান হাতিয়ার তারুণ্য। তরুণরা চাইলেই পারে সমাজকে বদলে দিতে। এজন্য দরকার তাদের চিন্তা ও মেধার সমন্বয়। চীন ও বাংলাদেশের তরুণদের অফুরান সম্ভাবনার কথা তুলে ধরবো এই অনুষ্ঠানে। তরুণদের সৃজনশীলতার গল্পগাঁথা নিয়েই সাজানো হয়েছে আমাদের তারুণ্যের অগ্রযাত্রা। 

১. চীনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ঈদ কেমন  

তারুণ্যের অগ্রযাত্রা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা চীন ও বাংলাদেশের তরুণদের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরি। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় আমরা আপনাদের কাছে তুলে ধরেছি চীনে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার। এ পর্বে , চীনে ঈদ কীভাবে উদযাপন করেন বাঙালি শিক্ষার্থীরা চলুন জানা যাক তাদের কাছ থেকেই। 

 

মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান রিফাত। চীনের হ্যানান প্রদেশের চংচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার বায়োলজি অ্যান্ড বায়োক্যামিস্ট্রি বিভাগের পিএচডি রিসার্চ ফেলো তিনি। এর আগে তিনি সিছুয়ান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্লান্ট ব্রিডিং এবং জেনেটিক্সের উপর এম এস সি করেন। তিনি ৫ বছর ধরে চীনে ঈদ করছেন। সেখানে তার ঈদ কেমন কাটে তা জানিয়েছেন চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে। 


ঈদে রিফাত মসজিদে নামাজ আদায় করেন। বিভিন্ন দেশের সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। বন্ধুদের সঙ্গে অথবা নিজে রান্না করেন বাঙালি খাবার। সুযোগ পেলে বাইরে ঘুরতে যান এবং  প্রিয়জনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তারপরও দিনশেষে প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকায় মন খারাপ হয় রিফাতের। তবে সব মিলিয়ে ভালোভাবেই এতো বছর ঈদ উদযাপন করেছেন বলে জানান রিফাত।

 


সাবরিনা লিজা। পড়াশোনা করেছেন চীনের হুয়াইন ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ফার্মাসিউটিক্যালস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তিনিও বেশ কয়েকটা ঈদ চীনে করেছেন। বিশেষ করে কোভিডের সময়ের ঈদগুলো ছিলো তার কাছে বেশি চ্যালেঞ্জিং। চীনে ঈদ উদযাপন কেমন জানতে চাইলে সাবরিনা লিজা চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে জানান,  ঈদের দিন সকালে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন তিনি। 

 

বিদেশি মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেন এবং কুশলবিনিময় করেন। তারপর বন্ধুরা মিলে বাঙালি খাবার রান্না করেন এবং একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেন। বিকেলে বাইক রাইডে বের হয়ে ছবি তুলেন বন্ধুদের সঙ্গে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক কোনো আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন। আপনজনদের থেকে দূরে হলেও ভিনদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ব্যাপারটিকে লিজা খুব উপভোগ করেন। সবমিলিয়ে লিজার চীনে কাটানো ঈদের রয়েছে সুন্দর অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি। 

 

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : রওজায়ে জাবিদা ঐশী 


২. পাঁচ বছর প্রতিবন্ধী সহপাঠীর যত্ন নিচ্ছেন পরোপকারী বন্ধু

  


পূর্ব চীনের চিয়াংসি প্রদেশের ইছুয়ান শহরে গেলে শোনা যাবে হৃদয় নিংড়ানো এক বন্ধুত্বের গল্প। ছিচিয়ান বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। পূর্ব চীনের চিয়াংসি প্রদেশের ইছুয়ান শহরে তার বাস। জন্মগতভাবে কিছু সমস্যার কারণে তার বুদ্ধিমত্তা, ভাষা এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দেয়। ছোটবেলা থেকেই তাকে পড়তে হয় নানা  চ্যালেঞ্জের মুখে। 


১১ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়ির গণ্ডিতেই আটকে ছিল ছিচিয়ানের শৈশব। পরে তার পরিবার তাকে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং থংকুই কাউন্টির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। ৫ বছর ধরে ছিচিয়ান এই স্কুলেই পড়ছে।


 

যদিও স্কুলটি ছিচিয়ানকে সাদরে গ্রহণ করেছিল, তবু নতুন ছাত্রের আগমন নিয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল উদ্বেগ।

ছিচিয়ানের নিরাপত্তা এবং স্কুলের পরিবেশে তার খাপ খাওয়ানো ছিল চ্যালেঞ্জের কাজ। এমনটা জানালেন ডেপুটি স্কুলমাস্টার লিউ হংহাই। 

তিনি আরও বলেন, এই উদ্বেগ সত্ত্বেও স্কুলটি ছিচিয়ানকে সাদরে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ তারা বিশ্বাস করে প্রতিটি শিশু ন্যায্য শিক্ষা পাওয়ার যোগ্য। 


স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা জানান, ছিচিয়ান যখন প্রথম স্কুলে ঢোকে তখন সে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। সে তার শ্রেণিকক্ষ খুঁজে পেত না। বেল বাজানোর মানে বুঝতে পারতো না। এমনকি ছেলে ও মেয়েদের বিশ্রামাগার যে আলাদা সেটাও ধরতে পারতো না।


সিয়ং ওয়েইহং, ছিচিয়ানের চীনা শিক্ষক 

"তার এসব সমস্যা দেখে প্রধান শিক্ষক একটি ক্লাস মিটিং করেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিচিয়ানের পরিচয় করিয়ে দেন। শিক্ষককে অবাক করে, ইয়াচুন নামের আরেক সহপাঠী তার হাত তোলে এবং বলে, সে ছিচিয়ানের যত্ন নিতে ইচ্ছুক।  

    

যখন থেকে ইয়াচুন ছিচিয়ানের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, তখন থেকে দুই বন্ধু যেন এক আত্মায় পরিণত হয়েছে। একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকেই না। 


শিক্ষকরা আরও জানালেন, দুপুরের খাবারের সময়, ইয়াচুন ছিচিয়ানের হাত ধরে ক্যান্টিনে নিয়ে যায়। দুজন একসঙ্গে বসে খাবার ভাগাভাগি করে খায়। অবাক করার বিষয় হলো ছোট্ট ইয়াচুন পাহাড়সম ধৈর্য নিয়ে তার প্রতিবন্ধী বন্ধুটিকে শেখাচ্ছে কীভাবে খেতে হয়, কীভাবে থালা-বাসন পরিষ্কার করতে হয়।

 

"আমরা ভালো বন্ধু। এত বছর ধরে আমি তার যত্ন নিয়েছি কিন্তু আমার কখনও কিছু মনেই হয় না।‘’  


৫ বছর ধরে দুই বন্ধু একসঙ্গে পড়ছে। ইয়াচুনের কারণে ছিচিয়ানের অনেক অভ্যাসও বদলে গেছে। সে ধীরে ধীরে শিক্ষক ও সহপাঠীদের ভয় কাটিয়ে উঠেছে। ডেস্কে চুপচাপ বসে পুরো ক্লাস মনোযোগ দিয়ে শেষ করতেও শিখেছে। এখন আর সে ভুল বিশ্রামাগারেও ঢুকে পড়ে না। প্রায়ই, ছিচিয়ান সন্তুষ্টের হাসি দিয়ে ইয়াচুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। 


"আমি পাঁচ বছর ধরে তাকে সঙ্গ দিচ্ছি। নানা কাজে সাহায্য করছি। আমার প্রতি তার গভীর বিশ্বাস। সে সম্ভবত আমাকে তার পরিবারের সদস্য হিসেবেই দেখে। 

 

ইয়াচুনের উদাহরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, অনেক সহপাঠী এখন তাকে অনুসরণ করতে শুরু করেছে। এখন অটিজমে আক্রান্ত ছিচিয়ানকে তারাও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে।  

কোনো শিক্ষকই আশা করেননি যে ইয়াচুন ছিচিয়ানকে এভাবে টানা পাঁচ বছর আগলে রাখবে।

 

স্কুলটিতে এখন মোট ৯ জন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু আছে। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, মমতাময়ী সহপাঠীদের সমর্থন ও সহায়তায়, তারা পড়াশোনা ও ব্যক্তিজীবন দুটোতেই এগিয়ে যাচ্ছে বাধাহীনভাবে।


প্রতিবেদক : রওজায়ে জাবিদা ঐশী

সম্পাদক: ফয়সল আবদুল্লাহ 

   

আমাদের ‘তারুণ্যের অগযাত্রা’ আজ এই পর্যন্তই। ঈদের মাহাত্ন্য, আনন্দ আর খুশি ছড়িয়ে পড়ুক প্রত্যেকের ঘরে ঘরে। 

পরবর্তী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানিয়ে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি রওজায়ে জাবিদা ঐশী। শুভকামনা সবার জন্য। আল্লাহ হাফেজ।

  

পরিকল্পনা ,পরিচালনা ও সঞ্চালনা : রওজায়ে জাবিদা ঐশী  

অডিও সম্পাদনা: রফিক বিপুল/ রওজায়ে জাবিদা ঐশী  

সার্বিক সম্পাদনা: ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী