ব্লুবেরি নিয়ে কৃষক শিল্প চেইনের কেন্দ্রে আসে
2024-04-17 14:31:51

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, চীনে উত্পাদিত ব্লুবেরি ফল তার বিশেষ স্বাদ ও উচ্চ পুষ্টিগুণের কারণে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং ব্লুবেরি চাষও কৃষির মধ্যে  একটি উচ্চ মূল্য সংযোজন শিল্পে পরিণত হয়েছে।

 

এবারের বসন্তে আমরা চলে এসেছি চীনের মূল ব্লুবেরি উত্পাদন এলাকা ইউননান প্রদেশের হংহ্য রাজ্যের মেং চি শহরে। সেখানে ব্লুবেরি দিয়ে কৃষক+গ্রামীণ কোম্পানি+বড় কোম্পানির সমন্বয়ে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। তার মাধ্যমে কৃষকরা এ শিল্প মূল্য চেইনের কেন্দ্রে চলে আসেন। পাশাপাশি কোম্পানির উত্পাদন  ব্যয় কমানো, গ্রাম পুনরুজ্জীবনের অর্থের সুব্যবহার এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি, গ্রামের দুর্বল অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা হয়। তাছাড়া, কৃষিক্ষেত খামারে পরিণত  হয় কৃষকরা খামারের মালিকে পরিণত হন।

 

এখন চীনে চলছে ব্লুবেরি ফুল ফোটার সময়, তবে এরইমধ্যে মেং চি শহরে প্রথম দফার ব্লুবেরি ফলনের সময় হয়েছে। গ্রিণহাউসে এক একটি ব্লুবেরি দেখতে নীলকান্তমণির মতো সুন্দর।

কৃষকরা ব্লুবেরি বেছে নিতে ব্যস্ত সময় পার করেন। মেং চি শহরের কৃষি ও গ্রাম বিভাগের প্রধান  ওয়াং চেং ইন জানিয়েছেন, চাও পা জেলার স্থানীয় পানি, জমি, রোদ ও আবহাওয়াসহ প্রকৃতি ব্লুবেরি চাষের জন্য উপযোগী। এখানে প্রতি বছরের নভেম্বর থেকে আগামি বছরের মে মাস পর্যন্ত ব্লুবেরির ফলন হতে পারে আর এ সময় চীনের অন্য ব্লুবেরি উত্পাদনকারী এলাকা বা বিদেশের ব্লুবেরি উত্পাদনকারী  এলাকায় ব্লুবেরি পাকার সময় হয়নি।

আবহাওয়া ও  ভৌগলিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে ২০১৮ সাল থেকে মেং চি শহর চীনের নানা বিখ্যাত কৃষি কোম্পানির বিনিয়োগ আকর্ষণ করে আর শহরটি এখন চীনে বৃহত্তম গ্রিণহাউস ব্লুবেরি উত্পাদন এলাকায় পরিণত হয়েছে।

 

ব্লুবেরি শিল্পের আকার ছোট থেকে বড় হবার পর নতুন সমস্যাও হাজির হয়। বিশেষ করে কৃষরা শিল্পের উন্নয়ন থেকে খুব বেশি লাভ করতে পারছিলেন না  এবং গ্রামের আয়ও বেশি বৃদ্ধি হয়নি। প্রতি মু (চীনা জমি পরিমাপের জন্য একটি চীনা ইউনিট, এক মু ৬৬৬.৭ বর্গমিটারের কাছাকাছি) ব্লুবেলি চাষের জন্য গ্রিণহাউস, জল ও সারের খরচ হাজার হাজার ইউয়ান লাগে এবং শুরু থেকে ফলন পর্যন্ত বেশ সময় লাগে। তাই অনেক কৃষক ব্লুবেরি চাষ করতে পারেন না এবং কোম্পানি গঠনের জন্য অর্থের অভাব ছিল। পাশাপাশি কৃষক নিজে ব্লুবেরি বিক্রয় করলে ব্র্যান্ড ও চ্যানেল ছাড়া বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন না। আর ব্লুবেরির মান অস্থিতিশীল হলে, কৃষকদের আয়ও অস্থিতিশীল হয়।

তাহলে গ্রাম ও কৃষক কীভাবে এ শিল্পের উন্নয়ন থেকে উপকৃত হতে পারে? কোম্পানির উত্পাদন ব্যয় কমানের পাশাপাশি চাষের ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন করা যায় কীভাবে?

 

সমস্যা হতে পারে সংস্কারের চালিকাশক্তি। স্থানীয় সরকার কৃষকদের নিয়েই শিল্প উন্নয়নের উপায় খুঁজে পাচ্ছে। চাও পা জেলার সিপিসি সম্পাদক ওয়ান খুই বলেন, তারা ৬২২ নামে একটি ব্যবস্থা আবিষ্কার করে। এখানে ৬২২ মানে তাদের লাভের ভাগাভাগির অনুপাত। অর্থাৎ মোট বিক্রয়ের ৬০ শতাংশ কৃষক, গ্রাম ২০ শতাংশ এবং কোম্পানি ২০ শতাংশ পাবে। ব্লুবেরি চাষের সময় অনুযায়ী ৫ বছর একবার এ ব্যবস্থা চালু হয়। কোম্পানি ব্লুবেরি চারা, প্রযুক্তি, ব্র্যান্ড তৈরি, বিক্রয় চ্যানেল  খোলার দায়িত্ব পালন করে। কৃষরা জমি, অবকাঠামো ও নিয়মিত ব্যবস্থাপনা করে। ১৪টি গ্রামের কমিটির উদ্যোগে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ কোম্পানি চারা কেনার ঋণ দেয়া, গ্রিণহাউস নির্মাণ, সার ও জলের ব্যবস্থা করে।

 

স্থানীয় বাসিন্দা সু চ্য ৬২২ ব্যবস্থার প্রথম অংগ্রহণকারী। তিনি ২০২১ সাল থেকে সাড়ে ৪ মু জমিতে ব্লুবেরি চাষ শুরু করেন এবং প্রথম বছরে তার নিট আয় ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ইউয়ান। ২০২৩ সালে তিনি ২২মু জমিতে ব্লুবেরি চাষ করেন এবং প্রথমবার ফলনের সময়ে তিনি ১০ লাখ ৮০ হাজার ইউয়ান লভ্যাংশ পেয়েছেন, এর মধ্যে নিট আয় ৬ লাখ ৪০ হাজার ইউয়ান। অনুমান অনুযাযী চলতি বছরে তার নিট আয় হতে পারবে ৬-৭ লাখ ইউয়ান। সু চ্যর সফলতা দেখে অন্য কৃষকরাও এতে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী। ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আরও বেশি মানুষ ৬২২ ব্যবস্থায় অংশ নেন।

ওয়াং চেং ইন জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে মেং চি শহরের ব্লুবেরি চাষের আয়তন ১৭ হাজার মু এবং উত্পাদনের মূল্য ২০৪ কোটি ইউয়ান। এতে ৩২টি গ্রামের ২০ হাজারের বেশি কৃষকের আয় বৃদ্ধি হয়। ৬২২ ব্যবস্থার অধীনে ৬২টি ব্লুবেরি পারিবারিক খামার ৬২ লাখ ইউয়ান আয় করে এবং সারা শহরে পারিবারিক খামারের সংখা ৮০টি।

 

যদিও কৃষি এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী শিল্প তবে এটিও নতুন মানের উত্পাদন শক্তির গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। ৬২২ ব্যবস্থার সাহায্যে কোম্পানি মানুষ নিয়োগ, জমি ভাড়ার খরচ কম হয়। কৃষক চাষ ও বিক্রয়ের সমস্যা সমাধান করে এবং গ্রামের অর্থের সু ব্যবহার বাস্তবায়ন হয়। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন কৃষক হাজির হয়।

 

চাও পা জেলার প্রধান ফেং মেই জানিয়েছেন, আগে কৃষকরা মূলত নিজের জমি কোম্পানিকে লিজ দেয়ার মাধ্যমে কিছু আয় করতো, পাশাপাশি কোম্পানিতে তারা একটি চাকরি এবং মাসিক বেতন পেতো। তবে এখন তারা কৃষকদেরকে খামার ব্যবস্থাপনার মধ্যমে  আয় করতে উত্সাহ দেয়। গ্রাম ও কোম্পানির  উদ্যোগে পারিবারিক খামার প্রতিষ্ঠা করে জমি ও শ্রম উত্পাদন উপাদান হিসেবে খামারের শেয়ারহোল্ডার হতে পারে কৃষকরা। ব্লুবেরির উত্পাদন তাদের আয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়। তাই তারা আরও সক্রিয়ভাবে ব্লুবেরির চাষ ও বিক্রয়ে অংশগ্রহণ করেন। প্রতি মু জমিতে প্রতি বছর তারা ৩০ হাজার ইউয়ান বা তার চেয়ে বেশি লভ্যাংশ পেতে পারেন, যা আগে জমি ভাড়া ও বেতন পাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি।

 

সু চ্য জানিয়েছেন, বড় কৃষি কোম্পানি নিয়মিতভাবে ব্লুবেরি চাষ, যত্ন, বেছে নেয়াসহ নানা প্রযুক্তি এবং বাজার সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ আয়োজন করে। কৃষক কোম্পানি নির্ধারিত চাষের উপায় অনুযায়ী  কাজ করে এবং ব্লুবেরির মান ভাল এবং স্থিতিশীল হয়। স্থনীয় বড় ব্লুবেরি চাষীরা চীনের সিআন, ছিং তাও এবং বিদেশে সফর করতে যান এবং তারা নতুন কৃষক হন।

কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করতে চাও পা জেলার সরকার, গ্রামের কোম্পানি ও বড় কৃষি কোম্পানি, এ তিন পক্ষ একটি অনলাইন ব্লুবেরি বিনিময় ও লেনদেন প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে কৃষকরা অনলাইনে ব্লুবেরির মান, পরিমাণ চেক করতে পারেন। প্রতি অর্ধ মাসে একবার বিক্রির দাম চেক করতে পারেন এবং প্রতি মাসে কত ব্যয় হয়, কত আয় হয় তাও দেখতে পারেন।

চাও পা জেলার প্রথম পরিপারিক খামার মালিক সু চ্য এখন একটি অঞ্চলের দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তিনি ৯টি পরিবার নিয়ে কাজ করেন। তার উদ্যোগে ওয়াং চিন নামে  একজন কৃষক ২০২২ সালে ৫ মু জমিতে ব্লুবেরি চাষ করেন এবং এক বছরের মধ্যে ২০ হাজার ইউয়ানের মুনাফা অর্জন করেন।

 

প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে কোম্পানি, কৃষক ও গ্রাম আসলে অভিন্ন স্বার্থে জড়িত আছে। এজন্য সহযোগিতা ও ঐক্য থাকতে হবে। কোম্পানি ব্র্যান্ড তৈরি করতে চাইলে ব্লুবেরির মান ভাল হতে হবে।  ব্লুবেরির প্রজাতি, ফলন ও প্যাকিংসহ নানা ক্ষেত্রে কোম্পানি কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ করে এবং কুষকদের অর্থের অভাব হলে কোম্পানি সাহায্য করতে পারে।

চাও পা জেলার সিপিসির সম্পাদক ওয়াং খুই মনে করেন, ব্লুবেরি একটি উচ্চ মূল্যসংযোজন শিল্প এবং ৬২২ একটি অভিন্ন স্বার্থ সংযুক্ত ব্যবস্থা। ভবিষ্যতে বাজারের পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বার্থ ভাগাভাগির অনুপাত পরিবর্তন হতে পারে। তবে উত্পাদন কার্যকারিতা উন্নয়ন এবং জয়-জয়ের মতো নতুন কিছু ব্যবস্থা আসবে বলে বিশ্বাস করা যায়। (শিশির/হাশিম)