বিজ্ঞানবিশ্ব ৬৫তম পর্ব
2024-04-08 19:32:59

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৬৫তম পর্বে যা থাকছে:

 

* থাইল্যান্ডে হাইড্রো-ফ্লোটিং সোলার প্রকল্প নির্মাণ করলো চীন

* টেন্ডন ও হাড়ের চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন চীনা গবেষকরা

* গ্র্যাভিটনের অস্তিত্বের প্রমাণ পেলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

 

 

থাইল্যান্ডে হাইড্রো-ফ্লোটিং সোলার প্রকল্প নির্মাণ করলো চীন

পরিবেশবান্ধব জ্বালানী নির্ভর হতে থাইল্যান্ডকে সহযোগিতা করছে চীন। দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে একটি হাইড্রো-ফ্লোটিং সোলার প্রকল্প। ইতোমধ্যেই এ প্রকল্পের আওতায় দেশটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন সরঞ্জাম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তোংফাং ইলেকট্রিক ইন্টার ন্যাশনাল কর্পোরেশন থাই অংশীদারদের সঙ্গে এই প্রকল্পটি নির্মাণ করেছে। উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডের খোন কায়েন প্রদেশের উবোলরাতনা বাঁধে হাইড্রো-ফ্লোটিং সোলার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। হাইব্রিড এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে রয়েছে ভাসমান সোলার প্যানেল, জলবিদ্যুৎ, জ্বালানী সংরক্ষণে অধিক সাশ্রয়ী ব্যবস্থা এবং স্মার্ট এনার্জি ব্যবস্থাপনা।

থাইল্যান্ডের বিদ্যুৎ জেনারেটিং অথরিটির উপ-গভর্নর জিরাপর্ন সিরিকুম জানান, থাইল্যান্ডের পরিবেশবান্ধব জ্বালানীর উৎপাদন এবং বিদ্যুৎ স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ফ্লোটিং সোলার হাইব্রিড বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। ভাসমান সোলার প্যানেলগুলো স্থানীয় অর্থনীতি এবং সমাজের জন্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানী উন্নীত করতে সহায়তা করবে।

খোন কায়েনে চীনের কনসাল জেনারেল লিউ হংমেই জানান, প্রকল্পটি পুরোপুরি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করলে উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং অঞ্চলটিতে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করবে।

খোন কায়েন প্রদেশের উবোলরাতনা বাঁধে হাইড্রো-ফ্লোটিং সোলার প্রকল্পটি এ ধরনের দ্বিতীয় প্রকল্প।

হাইড্রো-ফ্লোটিং সোলার হলো এক ধরণের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা, যা একই সঙ্গে সূর্য এবং পানির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। জলাধারের উপরে ভাসমান প্ল্যাটফর্মে সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়। দিনের বেলায়, সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।

এছাড়াও, জলাধারের জলপ্রবাহের সাহায্যে টার্বাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এই ব্যবস্থাটি বিশেষভাবে উপকারী কারণ এটি জলাধারের জলের বাষ্পীভবন হ্রাস করে এবং জমির ব্যবহার কমিয়ে দেয়।

চীন-থাইল্যান্ড বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অধীনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা প্রকল্প। এর মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে পরিবেশবান্ধব জ্বালানীর ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

 

টেন্ডন ও হাড়ের চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন চীনা গবেষকরা

রোগীদের দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা এবং অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে টেন্ডন ও হাড়ের আঘাতের চিকিৎসায় নতুন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি আবষ্কার করেছেন চীনা গবেষকরা। প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতির চেয়ে নতুন এ পদ্ধতিটি অনেক বেশি কার্যকর। এ পদ্ধতিতে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু মেরামত করতে থ্রি-ডি বা ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

টেন্ডন হলো শক্ত, তন্তুযুক্ত টিস্যু যা পেশীকে হাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এগুলি ঘন কোলাজেন দিয়ে তৈরি, যা একটি শক্তিশালী এবং নমনীয় প্রোটিন।

এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নেচার জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। চীনা গবেষণা দল তারা মূলত কৃত্রিম হাড়ের উপর ভিত্তি করে মাল্টিসেলূলার স্ক্যাফোল্ড তৈরি করেছে। প্রাকৃতিক গঠন হারানোর ফলে কার্যকলাপে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় টেন্ডন-টু-হাড়ের জখমে আক্রান্ত রোগীদের প্রাণহানি ঘটে।

গবেষকরা এ সংক্রান্ত গবেষণাটি ইঁদুরের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে থ্রি-ডি প্রিন্টেড টেন্ডন এবং হাড়ের গ্রাফ্টগুলো প্রথাগত চিকিৎসার চেয়ে অনেক দ্রুত এবং আরও কার্যকরভাবে টিস্যু পুনর্গঠন করতে পারে।

চীনের বিজ্ঞান একাডেমির শাংহাই ইনস্টিটিউট অব সিরামিক্সের গবেষণা দলটি টেন্ডন/হাড় সম্পর্কিত কোষের সঙ্গে ম্যাঙ্গানিজ সিলিকেট ন্যানোপার্টিকেলগুলোকে একত্রিত করে ইমিউনোমডুলেটরি মাল্টিসেলুলার স্ক্যাফোল্ড তৈরি করেছেন, যা সম্মিলিতভাবে টেন্ডন-টু-হাড় পুনর্জন্মাতে সাহায্য করবে।

প্রাণী পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এই স্ক্যাফোল্ডটি টেন্ডন এবং হাড়ের টিস্যু পুনরুত্পাদন করতে এবং আঘাতের কারণে হারিয়ে যাওয়া কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করতে পারে। স্ক্যাফোল্ডটি শুধুমাত্র পরীক্ষাগারের বিভিন্ন জৈবিক কার্যকলাপ প্রদর্শন করে এমন নয়। এটি ইমিউন নিয়ন্ত্রণ, বহু-টিস্যু একত্রীকরণ এবং পুনরুদ্ধারও কাজ করে।

এই স্ক্যাফোল্ডগুলো জৈব উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয় যা শরীরে মিশে যায়। স্ক্যাফোল্ডটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় স্থাপন করা হয়, যা একটি নতুন কোষের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে এবং টিস্যুর পুনর্গঠনে সহায়তা করে।

টেন্ডনের আঘাত বা ক্ষতি খেলাধুলা, বয়স বা অবক্ষয়ের কারণে হতে পারে। টেন্ডনের চিকিৎসা ঐতিহ্যগতভাবে অস্ত্রোপচার বা ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে করা হয়।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

 

 

গ্র্যাভিটনের অস্তিত্বের প্রমাণ পেলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

১৯৩০ সালে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি ব্লখিনৎসেভ প্রথম বলেছিলেন, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির নেপথ্যে থাকতে পারে গ্র্যাভিটন মানের একটি মৌলিক কণা। যা থাকলে অতিকায় বস্তু নিয়ে কাজ জেনারেল থিউরি অব রিলেটিভিটি নামের যে শাখাটি আছে সেটার সঙ্গে অতিক্ষুদ্র কণা নিয়ে কাজ করা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা যোগসূত্র তৈরি করা সম্ভব হবে। যে শক্তির উৎস বের করতে পারলে প্রকৃতির চারটি শক্তিকে বাঁধা যাবে এক সুতোয়। বেরিয়ে আসবে বিজ্ঞানের পরম আরাধ্য তথা থিউরি অব এভরিথিং।

চীনের নানচিং ইউনিভার্সিটির গবেষক তু লিংচিয়ের নেতৃত্বাধীন একদল বিজ্ঞানী সম্প্রতি একটি পরীক্ষায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বাহক গ্র্যাভিটনের অস্তিত্বের স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ পেয়েছেন। এই সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে নেচার জার্নালে।

যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির গবেষকরাও ছিলেন এ দলে। এই বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ ধরনের বস্তু নিয়ে গবেষণা করে পেয়েছেন গ্র্যাভিটনের মতো একটি কণার অস্তিত্বের প্রমাণ।

বিশেষ ওই বস্তু এবং এ পরীক্ষার নানা ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করতেই বিজ্ঞানী তু লিংচিয়ে ও তার দলের লেগেছে তিন বছর। বস্তুটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ফ্র্যাকশনাল কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট লিকুইড। চরম শীতল তাপমাত্রা ও উচ্চমাত্রার চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে একটি দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠতলে ইলেকট্রনের বিশেষ কিছু আচরণ দেখা যায় ওই কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট লিকুইডের ভেতর।

চরম শীতল তাপ ও শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্রের ভেতর থাকা ওই বস্তুতে বিশেষভাবে তৈরি পোলারাইজড আলোর কণা তথা পোলারাইজড ফোটন নিক্ষেপ করতেই গবেষকরা দেখলেন ইলেকট্রনগুলো এমন সুশৃঙ্খল আচরণ করছে যা কেবল স্পিন-২ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একটি নির্দিষ্ট কণার উপস্থিতিতেই সম্ভব। আর সেই পরিস্থিতিকেই বিজ্ঞানীরা বলছেন কাইরাল গ্র্যাভিটন মোডস, সংক্ষেপে সিজিএম ওরফে মাধ্যাকর্ষণের কণা গ্র্যাভিটন।

অর্থাৎ সরাসরি এই গ্র্যাভিটন ডিটেক্টরে ধরা না পড়লেও গবেষকরা এটা দেখেছেন যে ওই গ্র্যাভিটন জাতীয় স্পিন-২ কণার কারণেই মূলত ইলেকট্রনগুলো সুশৃঙ্খলভাবে বিশেষ দিকে ঘুরছে।

সহজভাবে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, যদি কোথাও কোনো কম্পাস উল্টোপাল্টা আচরণ করতে থাকে, তখন সরাসরি না দেখেও বলা যায় যে, ওই কম্পাসের আশপাশে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। ঠিক এভাবেই সারিবদ্ধভাবে ইলেকট্রনের বিশেষ আচরণ দেখেই গবেষকরা বুঝতে পেরেছেন, এমনটা শুধু গ্র্যাভিটন বা এ জাতীয় কোনো কণার উপস্থিতিতেই সম্ভব।

অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা নিয়ে বিজ্ঞানের যে শাখায় গবেষণা হয় তার নাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আমাদের চোখে দেখা নৈমিত্যিক প্রকৃতির প্রচলিত নিয়মকানুন যেখানে কাজ করে না। ওই ক্ষুদ্র জগতে একটি কণা একইসঙ্গে কণা ও একইসঙ্গে তরঙ্গের মতো আচরণ দেখাতে পারে। প্রচলিত কোনো সূত্রেই ওই ক্ষুদ্র জগতে টেনে আনা যাচ্ছিল না মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তথা গ্র্যাভিটিকে।

তবে চীনা গবেষকের নেতৃত্বে এবার যে গ্র্যাভিটন জাতীয় কণার অস্তিত্ব পাওয়া গেল, তাতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতেও মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে নতুন করে গবেষণার একটা পথ খুলে গেছে। কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট লিকুইড বস্তুতে পোলারাইজড ফোটন নিক্ষেপের এই প্রযুক্তির হাত ধরে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি পদার্থবিজ্ঞানে লেখা হবে নতুন এক অধ্যায়।

 

|| প্রতিবেদন: ফয়সল আবদুল্লাহ

|| সম্পাদনা: শুভ আনোয়ার

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী