চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
৬৩তম পর্বে যা থাকছে:
* টেপওয়ার্মের জীবাশ্ম আবিষ্কার
* মস্তিষ্ক-প্রযুক্তির বাণিজ্যিকীকরণে এগিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান
* টিউমারের চিকিৎসায় ফ্রিজ-ড্রাইং প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন চীনা গবেষকরা
টেপওয়ার্মের জীবাশ্ম আবিষ্কার
চীনা বিজ্ঞানীদের একটি দল মধ্য ক্রিটেসিয়াস যুগের কাচিন অ্যাম্বারে একটি টেপওয়ার্মের দেহের জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছেন। এই জীবাশ্মটি প্রায় ১০ কোটি বছরের পুরনো বলে ধারণা করছেন তারা। দেশটির বিজ্ঞান একাডেমি এসব তথ্য জানিয়েছে।
নানচিং ইন্সটিটিউট অব জিওলজি অ্যান্ড প্যালিওন্টোলজির বিজ্ঞানীরা জীবাশ্মটি খুঁজে পেয়েছেন। এই জীবাশ্মটির এমন কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা বর্তমান ট্রাইপ্যানোরিনচ টেপওয়ার্মের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ট্রাইপ্যানোরিনচ টেপওয়ার্ম হলো সামুদ্রিক ইলাসমোব্রাঙ্ক মাছের পরজীবী।
এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল জিওলজি জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। চীন ছাড়াও জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশের বিজ্ঞানীরা পরিচালনা করেছিলেন এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।
নানচিং ইন্সটিটিউট অব জিওলজি অ্যান্ড প্যালিওন্টোলজির গবেষক ওয়াং বো জানান, এই জীবাশ্মটি কেবল টেপওয়ার্মের দেহের জীবাশ্মের খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেনি বরং বিশ্বব্যাপী ফ্ল্যাটওয়ার্মের দেহের জীবাশ্মও এটিই, যা তাদের প্রাথমিক বিবর্তনের বিষয়ে তথ্য দেয়।
টেপওয়ার্ম হলো এক ধরণের পরজীবী ফ্ল্যাটওয়ার্ম, যারা অন্য প্রাণীর দেহে বাস করে। এদের সমতল, খণ্ড খণ্ড দেহ থাকে এবং এরা অন্ত্রের ভেতরে বাস করে। টেপওয়ার্ম বিভিন্ন আকারের হতে পারে। টেপওয়ার্মের জীবনচক্র জটিল এবং এতে একাধিক পর্যায় থাকে। এরা সকল ধরনের মেরুদণ্ডী প্রাণীদের সংক্রমিত করতে পারে। এদের ডিম থেকে লার্ভা বেরিয়ে আসে এবং মাছ, শুকর, গরুর মাংসের মতো মধ্যবর্তী হোস্টের দেহে প্রবেশ করে।
টেপওয়ার্ম ডিম মাটিতে দীর্ঘ সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। তাই, দূষিত মাটিতে খেলাধুলা করলে বা দূষিত পানি খেলে টেপওয়ার্ম সংক্রমণ হতে পারে।
এই আবিষ্কারটি জীববিজ্ঞান এবং জীবাশ্মবিদ্যার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি টেপওয়ার্মের বিবর্তন সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে সাহায্য করবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
মস্তিষ্ক-প্রযুক্তির বাণিজ্যিকীকরণে এগিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান
মস্তিষ্ক বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি মস্তিষ্কের অনুকরণে বুদ্ধিমান প্রযুক্তির বিকাশে কাজ করছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। আর এ প্রযুক্তি শুধু গবেষণাগারে আটকে রাখতে চান না তারা। পৌঁছে দিতে চান, জনমানুষের দরবারে। সে কারণে মস্তিষ্ককে ঘিরে তৈরি করা নানা ধরনের প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার কী করে বাড়ানো যায় তা নিয়েও কাজ করছে চীনা গবেষণা সংস্থাগুলো।
মস্তিষ্কের দেখাদেখি বুদ্ধিমান প্রযুক্তির বিকাশেও বেশ অগ্রগতি করেছে চীনের শেনচেন ইন্সস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড টেকনোলজি তথা এসআইএটি।
নিজেদের গবেষণালব্ধ ফলাফলের বাস্তবিক প্রয়োগ এবং বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশের এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
মস্তিষ্কের নিউরাল মেকানিজম বিশ্লেষণ করে কিছু রোগ নির্ণয় ও এ সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়েও কাজ করছে সংস্থাটির গবেষকরা।
প্রতিষ্ঠানটির ব্রেইন কগনিশন ও মস্তিষ্কের রোগ সংক্রান্ত ইন্সস্টিটিউটের প্রধান ওয়াং লিপিং বলেছেন, সম্প্রতি তাদের এ সংস্থা বিশ্বে প্রথমবারের মতো বানরের মস্তিষ্কের নিউরাল সংযোগের একটি মানচিত্র তৈরি করতে পেরেছে।
ওয়াং লিপিং আরও বললেন, এই মানচিত্রটি দেখায় যে, কীভাবে এই নিউরাল নেটওয়ার্কগুলো মস্তিষ্কের একটি অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যোগাযোগ তৈরি করে। এটা অনেকটা আমাদের বিভিন্ন শহরের মধ্যে পরিবহন নেটওয়ার্কের মতোই। মানচিত্রটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণার জন্য অনেক মৌলিক তথ্য সরবরাহ করছে।
মানচিত্রটি মানুষের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণার জন্যও অনেক তথ্য দিচ্ছে বলে জানান ওয়াং।
তার মতে, চীনে তৈরি নতুন প্রযুক্তি ছাড়া এসব অগ্রগতি সম্ভব ছিল না।
তিনি বললেন, ‘প্রকৃতপক্ষে, আমাদের অনেক গবেষকই আশা করছেন কিছু নতুন প্রযুক্তিকে অচিরেই পণ্যের রূপ দেওয়া যাবে। তাই প্রযুক্তিগুলোর প্রায়োগিক ব্যবহারের জন্য এবং প্রক্রিয়াটিকে আরও সংক্ষিপ্ত করতে অনেক বিজ্ঞানী নিজেরাই কিছু কম্পনি চালু করতে শুরু করেছেন।’
গবেষকরা জানালেন, ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে প্রাণীর মস্তিষ্কের মাইক্রোস্কোপিক মানচিত্র পেতে গবেষকদের দশ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। কিন্তু চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে কাজটি দ্রুত করা গেছে। এর মাধ্যমে অচিরেই মানব মস্তিষ্কের একটি বিশদ মানচিত্র পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেও জানান তিনি।
এসআইএটি’র গবেষণায় বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের কিছু অঞ্চল সম্পর্কেও বিশদ জানতে পেরেছেন। মানব মস্তিষ্কের কোন অংশটি ভয়ের প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী আবার কোন অংশটি আত্মরক্ষা নিয়ে তৎপর থাকে সেটাও বের করেছেন ওয়াং ও তার দল। আবার সংস্থাটির গবেষকরা নতুন প্রযুক্তিতে মাত্র তিন মাসেই তৈরি করতে পারছেন ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস।
শেনচেন ইন্সস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড টেকনোলজির অধীনে শেনচেনে এখন ১৪টি মস্তিষ্ক সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যাদের সম্মিলিত বাজারমূল্য ২২০ কোটি ইউয়ান।
|| প্রতিবেদন ও সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
টিউমারের চিকিৎসায় ফ্রিজ-ড্রাইং প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন চীনা গবেষকরা
ফ্রিজ-ড্রাইং প্রযুক্তি ব্যবহার করে অ্যান্টি-টিউমার ওষুধের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে একটি নতুন উপায় আবিষ্কার করেছেন চীনের গবেষকরা। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নেচার জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।
যৌথভাবে এ গবেষণাটি করেছেন চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিকাল সায়েন্স কলেজ এবং মেডিকেল স্কুলের গবেষকরা।
এতে দেখা গেছে, ফ্রিজ-ড্রাইং প্রযুক্তিটি ক্রায়োঅ্যাবলেশন নামেও পরিচিত। এটি একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি, যেখানে টিউমার ধ্বংস করার জন্য তীব্র ঠাণ্ডা ব্যবহার করা হয়।
এই প্রক্রিয়ায় তরল নাইট্রোজেন ব্যবহার করে টিউমার কোষগুলোকে -১৯৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দ্রুত ঠাণ্ডা করা হয়। তীব্র ঠাণ্ডায় টিউমার কোষের ভেতরে বরফের স্ফটিক তৈরি হয়, যা কোষের ঝিল্লিকে ছিঁড়ে ফেলে এবং সেগুলোকে ধ্বংস করে। এই প্রক্রিয়াটি অধিক কার্যকর এবং রোগীর জন্য কম বেদনাদায়ক।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিউমার-টার্গেটেড থেরাপি হিসেবে সেল ভিত্তিক ওষুধগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্যান্সার কোষগুলোকে সঠিকভাবে সনাক্ত এবং নির্মূল করতে সক্ষম কাইমেরিক এন্টিজেন রিসেপ্টর (সিএআর)। টি কোষগুলো রক্তকণিকার ক্যানসারের চিকিৎসায় ক্লিনিকালি ব্যবহৃত হয়।
তবে সলিড টিউমারের ক্ষেত্রে কাইমেরিক এন্টিজেন রিসেপ্টর তৈরি করে ‘টি কোষগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী এবং কার্যকরভাবে কাজ করানো একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গবেষকরা টিউমার আক্রান্ত একটি ইঁদুরের মধ্যে নতুন এ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করে পরীক্ষা করেছেন এবং দেখেছেন যে ফ্রিজ-ড্রাইং লিম্ফ নোড ব্যবহার করে চিকিৎসা করা ইঁদুরদের টিউমারের আকার এবং বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
ত্বক, প্রোস্টেট, লিভার, কিডনি, ফুসফুস, ঘাড়, জরায়ুর ক্যান্সারে এ পদ্ধতিটি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এমনকি একই টিউমারে একাধিকবার ব্যবহার করা যেতে পারে।
গবেষণাটি টিউমারের চিকিৎসার জন্য একটি নতুন এবং সম্ভাব্য কার্যকর পদ্ধতি হবে বলেও মনে করছেন গবেষক দল।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী