ছিন লিং পাহাড়ের নীচে ওয়ে হ্য নদীর পাশে অবস্থিতি কান সু প্রদেশের থিয়ান সুই শহর। এ শহরটি স্থানীয় খাবার ‘মা লা থাং’য়ের কারণে দেশব্যাপী একটি জনপ্রিয় শহরে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম-উত্তর চীনের পুরাতন এ শহরে অবশ্য নানা পর্যটন সম্পদ রয়েছে। তবে বিশাল ও সাংস্কৃতিক-বৈচিত্র্যের চীন দেশে এমন শহর সহজে সবার কাছে পরিচিতি পায় না। তবে কেউও ভাবেনি স্থানীয় এক ধরনের খাবার হঠাৎ করে ইন্টারনেটে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এবং লাখ লাখ পর্যটক এ খাবারের জন্য নানা জায়গা থেকে থিয়ান সুই শহরে আসবেন।
থিয়ান সুই শহরের বাণিজ্যিক সড়কে ভিড় দেখা দেয়। মানুষ দোকান থেকে সড়ক পর্যন্ত লাইন করে দাঁড়িয়েছে। বাতাসে মরিচের ঝাল গন্ধ টের পাওয়া যায়। সবাই ‘ মা লা থাং’ খেতে আসে। থিয়ান সুই শহর, কান সু প্রদেশ, শায়ানসি প্রদেশ ও সি ছুয়ান প্রদেশের সীমান্তে অবস্থিত। হুয়া হ্য ও ইয়াংসি নদীর প্রবাহ এলাকা অতিক্রম করে থিয়ান সুই। তাই স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে চারপাশের প্রদেশের বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে গঠিত হয়। গত শতাব্দীর ৮০ ও ৯০-এর দশকে সি ছুয়ান প্রদেশের খাবার ‘মা লা থাং’ থিয়ান সুই শহরে জনপ্রিয়তা পায় এবং স্থানীয়রা অনেক এ খাবার নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তারা স্টল থেকে দোকান পর্যন্ত নিজের ব্যবসা ধাপে ধাপে প্রসারিত করেন।
হাই ইং নামে একটি মা লা থাং রেস্তোরাঁর মালিক হা হাই ইং জানিয়েছেন, তিনি ২৬ বছর ধরে এ ব্যবসা করছেন, তবে আগে শুধু স্থানীয় মানুষ মা লা থাং খেতে তার রেস্তোরাঁয় আসতেন। এখন প্রতিদিন ৭০০-৮০০ জন বাইরের মানুষ খেতে আসেন। তিনি কখনও এমন দৃশ্য দেখেননি। সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সারা পরিবারের সাহায্যে তিনি ব্যবসা করেন। ক্লান্ত হলেও তিনি এতে আনন্দ পান।
কেন থিয়ান সুইর এ খাবার হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে উঠে? হা হাই ইং মনে করেন, মা লা থাং সুস্বাদু ও সস্তা খাবার এবং এখন খদ্দেরের সংখ্যা বেশি হলেও দাম বাড়বে না। ১০-১২ ইউয়ান দিয়েই এটা পাওয়া যায়। সিচুয়ান গোলমরিচ এবং কাঁচা মরিচ দিয়ে তৈরি হয় এ খাবারের সস এবং প্রতিটি রেস্তোরাঁর নিজ নিজ রেসিপি রয়েছে।
কান কু কাঁচা মরিচ ও মাই চি গোলমরিচ স্থানীয় দুটি কৃষি পণ্য এবং তা মা লা থাংয়ের অপরিহার্য উপাদান। গোলমরিচ থিয়ান সুই শহরে হাজার বছর ধরে চাষ হয় এবং কান কু জেলা চীনে প্রধান কয়েকটি কাঁচা মরিচ চাষ জেলার মধ্যে অন্যতম।
এখন কান সু প্রদেশের নানা জায়গায় গোলমরিচ চাষ হয় এবং ২০টির বেশি কাঁচা মরিচ চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ২০টির বেশি দেশ ও অঞ্চলে রপ্তানি হয়।
৩০ বছর আগে, হু সিয়াও ইউয়ু ও তার স্বামী একটি মা লা থাং দোকান খোলেন। তখন তাদের ভালবাসার স্মরণে দোকানের নাম দিয়েছেন ইডেন গার্ডেন। তিনি থিয়ান সুইর স্থানীয় মানুষ এবং প্রবীণের কাছ থেকে নুডস ও আলু বল তৈরি করতে শিখেছেন।
কান সু আলু চাষের বড় একটি প্রদেশ এবং তিন সি জেলা চীনে বৃহত্তম আলু চাষ ও গবেষণা এবং প্রক্রিয়াকরণ ও উত্পাদন কেন্দ্র। হু সিয়াও ইউয়ুর দোকানে আলু দিয়ে তৈরি বল ও নুডস সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলু ছাড়া থিয়ান সুইর মা লা থাংয়ে নানা ধরনের শাকসবজি যোগ করা হয়েছে। কান সু চীনের বড় একটি শাকসবজি চাষের প্রদেশ এবং এখানে মালভূমি শাকসবজি ও নানা ধরনের মাশরুম পাওয়া যায়। হু সিয়াও ইউয়ুর মতে থিয়ান সুই মা লা থাং শুধু সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়েছে তা নয়, গেল কয়েক বছরে সি’আন, সিন চিয়াং ও উত্তর-পূর্ব চীন থেকে আসা মানুষ তার কাছ থেকে মা লা থাং তৈরি করতে শেখেন।
নিজের হোমটাউনের মা লা থাং জনপ্রিয় খাবার হয়ে উঠার খবর শুনে শায়ানসি প্রদেশে কাজ করা ওয়াং ইয়ান চুন থিয়ান সুই শহরে ফিরে আসেন এবং মা লা থাং তৈরি করতে শেখেন। তিনি জানান, গেল দু’দিনে দশ বারো জন তার মতো শিখতে আসেন এবং হু সিয়াও ইউয়ু সস ও নুডস তৈরিসহ সবকিছু তাদেরকে শিখিয়েছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে শেখা শেষ হতে পারে। ওয়াং ইয়ান চুন জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে তিনি শায়ানসিতে একটি মা লা থাং দোকান খুলতে চান এবং থিয়ান সুইর সুস্বাদু খাবার অন্য জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চান।
সাক্ষাত্কারের শেষে হু সিয়াও ইউয়ু মা লা থাংয়ের এক একটি বাঁশের কাঠি সংগ্রহ করছেন। প্রতিদিন তিনি ১০ হাজারের বেশি বাঁশের কাঠি সংগ্রহ করেন। তিনি হেসে বলেন, কখনও ভাবেনি তার হোমটাইউন একটি খাবারের কারণে বিখ্যাত হয়ে উঠবে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি খাবারের মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি যতবেশি সম্ভব অন্যদেরকে শেখাতে চান। এখন তার কাছে শিখতে চান এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই তিনি সরাসরি রান্নঘরে লাইভ অনুষ্ঠান করেন। তার মাধ্যমে মানুষ অনলাইনে শিখতে পারে।
কখন থেকে থিয়ান সুই মা লা থাং ইন্টারনেট জনপ্রিয় হয়ে উঠে?
সম্ভবত একজন মেয়ে সবার আগে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ খাবারের ভিডিও শেয়ার করেন। বার বার ফরোয়ার্ডের পর অবশেষে এটি ইন্টারনেটে একটি হট শব্দে পরিণত হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে থিয়ান সুই মা লা থাং এ শব্দের অনুসন্ধানের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। একটি সর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্মে এ পর্যন্ত এর ভিডিওর ভিউ ১০৫ কোটি বার এবং অন্য একটি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে এর সংশ্লিষ্ট পোস্ট ৩০ হাজারের বেশি।
অনেক বার থিয়ান সুই মা লা থাংয়ের ভিডিও দেখার পর ২৯ বছর বয়সি মেয়ে চাও চিং একবার খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আর এখন তিনি নিজের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট। এখন সুস্বাদু খাবার খুঁজে বের করা চীনে এক ধরনের জীবনযাপনের রীতিতে পরিণত হয়। বিগ ডেটা এমন মানুষের কাছে সুস্বাদু খাবারের তথ্য দিয়েছে। লিয়াও নিং প্রদেশের শেন ইয়াং শহরের মানুষ চু ইউয়ু সুয়ান ৪ ঘন্টার ফ্লাইট এবং কয়েক ঘন্টার বুলেট ট্রেন এবং কয়েক ঘন্টার লাইনের পর অবশেষে মা লা থাং খেয়েছেন। তার জন্য এত কষ্ট করে এত দূর থেকে আসা কোনো ব্যাপার নয়।
এ সুযোগ ধরে থিয়ান সুইয়ের মানুষ স্থানীয় কৃষিপণ্য ও দর্শনীয় স্থানের প্রচারণাও করেন।
কান কু জেলার একটি মরিচ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানির ম্যানেজার হ্য চি বিন বলেছেন, সম্প্রতি প্রতিদিন তার কোম্পানি অনলাইন এক হাজার অর্ডার পাচ্ছে এবং চীনের একটি অনলাইন কেনাকাটা প্ল্যাফর্ম চিং তুংয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গেল দু সপ্তাহে থিয়ান সুই মরিচ এবং আলু সংশ্লিষ্ট পণ্যবিক্রি পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
এখন আরও বেশি মানুষ থিয়ান সুই শহরে দেখতে আসেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মার্চ মাসে থিয়ান সুই শহরে দর্শনীয় স্থানের টিকিট বিক্রি ২১৬.৮ শতাংশ বেড়েছে।
যদিও মা লা থাংয়ের কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে থিয়ান সুই শহরে আসছেন মানুষেরা, পাশাপাশি তারা থিয়ান সুইর ইতিহাস ও সংস্কৃতিও অনুভব করেন।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে থিয়ান সুইর গল্প কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। সি’আন, হ্য নান, চি পো, হার্বিনের মতো শহর ও প্রদেশও অল্প সময়ে ইন্টারনেট সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছে। অপরিচিত শহরগুলোতে ইন্টারনেটের সাহায্যে এসেছে সাংস্কৃতিক পর্যটনের প্রবাহ।
পর্যটকদেরকে সেবা প্রদান করতে থিয়ান সুই শহর বিশেষভাবে মা লা থাং বাস চালু করে এবং পর্যটকরা সরাসরি মা লা থাং দোকানে পৌঁছে দেয়। সড়কে শহর নতুনভাবে সাজাতে কর্মীরা পরিশ্রম করেছেন। সরকার অফিস সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে, সেখানে বিনামূল্য চা, পার্কিং ও টয়লেট পরিষেবা পাওয়া যায়। স্থানীয় কোম্পানি ও নাগরিক পর্যটকদেরকে সক্রিয়ভাবে উপহার দেয়। একজন পর্যটক বলেন, মা লা থাং খেতে তিনি মাত্র ২০ ইউয়ান ব্যয় করেন, তবে ১০ বারোটি উপহার পেয়েছেন। তার ব্যাগে ফলের রস, মরিচসহ অনেক কিছু আছে এবং হাতে লেখা একটি পর্যটন গাইড বুকও আছে।
থিয়ান সুইর নানা দর্শনীয় স্থান একদিকে খোলা রাখার সময় বাড়িয়েছে, অন্যদিকে টিকিটে ডিসকাউন্ট ব্যবস্থা চালু করেছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন নাচ, কংফু অনুষ্ঠানও নিয়মিত দর্শনীয় স্থানে পরিবেশনা করা হয়। প্রথম স্তরের শহরের তুলনায় অবকাঠামো, সেবা দক্ষতাসহ নানা ক্ষেত্রে থিয়ান সুইর দুর্বলতা রয়েছে, তবে যদি উন্নয়ন করতে চায়, অগ্রগতি অর্জন করতে চায়, সেটা কেউ আটকে রাখতে পারে না।
উত্তর-পশ্চিম চীনের ছোট এ শহরও এমন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা থেকে চীনে হাজার হাজার ছোট শহর শিখতে পারে এবং আস্থা পেতে পারে।
(শিশির/হাশিম/লিলি)