নৈতিক ক্লাস: চীনা শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার উন্নয়ন ও মূল্যবোধ গঠনে সহায়ক
2024-03-25 16:02:23

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীদের নৈতিকতার চর্চায় বিশেষ ক্লাস চালু হয়েছে। এমন ক্লাসের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিকতার গুণগতমান উন্নীত করা এবং তাদের সঠিক মূল্যবোধ গঠনে চেষ্টা করেন শিক্ষকরা। দেশ প্রেমমূলক গান বা চলচ্চিত্র পরিবেশনা এবং চীনা বীরদের শ্রেষ্ঠ গল্প তুলে ধরাসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে শিক্ষকরা মতাদর্শগত এবং নৈতিক ক্লাসে পাঠদান করেন।

 

আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের কুয়াংসি চুয়াং জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের উচৌ শহরের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নৈতিক ক্লাসের বিষয়ে কিছু তুলে ধরবো। তাদের নতুন পদ্ধতির নৈতিক ক্লাস চালু করার পর তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চলুন শুরু করা যাক আজকের অনুষ্ঠানটি।

 

কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় ও কার্যকর নৈতিক ক্লাস করা যায়? এটি নৈতিক ক্লাসের শিক্ষকদের জন্য বেশি কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। এ সম্পর্কে উচৌ শহরের শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক থান ইং সিয়া বলেন, নৈতিক ক্লাসের বিষয় এবং সামাজিক অনুশীলনের সাথে যুক্ত করে এবং ইন্টারনেট ও এআই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে স্থানীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় নৈতিক ক্লাস নিতে পারেন শিক্ষকরা। যেমন উচৌ শহরের ৮ নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের নৈতিক ক্লাসে শিক্ষক শুরুর দিকে ছাত্রছাত্রীদের জন্য উচৌ শহরের ইতিহাসে বিপ্লবী গল্প আর তোরণ-শোভিত পথ-সংস্কৃতি ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট গবেষণা আর পড়াশোনার সময়সূচি তৈরি করেন। এভাবে শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট পড়াশোনা শুরুর আগে দলীয় আলোচনা, গ্রন্থাগারে বইয়ের তথ্য সংগ্রহ করাসহ বিভিন্ন কাজ করতে পারে, এমন কাজের মাধ্যমে নৈতিক ক্লাসে নিজের জন্য মজার ও আকর্ষণীয় বিষয় খুঁজতে সক্ষম এবং এর মাধ্যমে জন্মস্থানের সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে আরো বেশি ধারণা পাওয়া সম্ভব।

উচৌ শহরের কংছাংলু প্রাথমিক স্কুলে ঐতিহ্যিক সিংহনৃত্যের দিক থেকে অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সাথে জড়িত নৈতিক ক্লাস চালু করা হয়। ছাত্রছাত্রীরা ঐতিহ্যিক শ্রেষ্ঠ সভ্যতা শেখার মাধ্যমে দেশ প্রেমমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে এবং এতে জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি তাদের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যাবে। এমন ক্লাস ছাত্রছাত্রীদের জন্য কেবল শিক্ষকদের মুখে কথা শোনা নয়, বরং নিজের উদ্যোগে আরো বেশি জ্ঞান ও তথ্য জানতে সক্ষম, এমন কাজের মাধ্যমে জীবনের দার্শনিক তত্ত্ব বুঝতে পারে।

উচৌ শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ।  উচৌ শহরের শিক্ষ ব্যুরোর মহাপরিচালক থান ইং সিয়া বলেন, শহরে গঠিত নৈতিক ক্লাসের পাঠ্যপুস্তক এ অঞ্চলের বিপ্লবী ইতিহাস ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি যুক্ত করা হয়েছে, এভাবে পড়াশোনার মাধ্যমে চীনা সভ্যতা ও ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির প্রতি ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা যায়, যা তাদের সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ গঠনে সহায়ক।

উচৌ শহরের নম্বর ১ মাধ্যমিক স্কুলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন প্রথম শহর পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী ফেডারেশনের প্রদর্শনী করিডোর স্থাপন করা হয়েছে, এতে স্কুলের বিপ্লবী ইতিহাস ও স্কুলে পড়াশোনা বা শিক্ষকতার কাজে অংশ নেওয়া বিপ্লবী শহীদদের গল্প তুলে ধরা যায়। এ সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর স্কুলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তাই তাদের বাস্তব গল্প জানা ছাত্রছাত্রীদের জন্য আরো প্রাণবন্ত হয়, আর খুব সহজে তা মনে রাখা যায়।

উচৌ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের স্বেচ্ছাসেবক পরিষেবা দল গঠন করেছেন, তারা বিভিন্ন সামাজিক তত্পরতায় অংশ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে থাকে এবং এমন কার্যক্রমের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিকতা চর্চা করা হয়। এ কর্মসূচির মাধ্যমে ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ১২৩টি দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের দেওয়া বইয়ের মোট মূল্য ১১.৫ লাখ ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের গ্রামাঞ্চলের পুনরুজ্জীবনের সাফল্য সম্পর্কে ধারনা দিতে সংশ্লিষ্ট গবেষণা তত্পরতা আয়োজন করা হয়েছে এবং কুয়াংসি এলাকার উন্নয়নের অবস্থা বিবেচনা করে সামাজিক উন্নয়নের প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে পরামর্শ ও সহায়তা দেন শিক্ষকরা।

এ উচ্চবিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী মো থাং ইয়ু মনে করেন, গ্রামাঞ্চলের পুনরুজ্জীবনের সাফল্য তার মনের ওপর গভীর ছাপ ফেলেছে। ক্লাসের সহপাঠীদের সাথে মেংশান জেলার সিনস্যু উপজেলার বাথৌ গ্রাম আর তামিং গ্রামসহ কয়েকটি জায়গায় ফিল্ড জরিপ করেছে ছাত্রী মো। গ্রামের বুদ্ধিমান খামার পরিদর্শন করার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পেরেছে যে, গ্রামীণ পর্যটন কীভাবে কৃষকদের জন্য আর্থিক আয়ের পথ খুলে দিয়েছে এবং গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের নতুন সাফল্য ও শিল্প চেইনের আর্থিক মুনাফা সবই দেখেছে তারা। চীনা গ্রামের উন্নয়নে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণে তারা বাস্তব অনুভূতি পেয়েছে।

বস্তুত, বিভিন্ন নৈতিক ক্লাসে ভালো করে পড়াশোনার সঙ্গে শিক্ষকদের প্রচেষ্টার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই শিক্ষকদের মধ্যে এ ক্লাসের মান উন্নীত করার চেতনা গঠন করা এবং এ ক্লাসের গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। উচৌ শহরের বিভিন্ন স্কুলের প্রেসিডেন্ট ও সিপিসি’র সম্পাদক সর্বপ্রথমে ‘নৈতিক ক্লাসের শিক্ষকতার কাজ করে থাকেন, ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেওয়ার পর নৈতিক ক্লাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেয়েছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন স্কুলের নৈতিক ক্লাসের মান উন্নয়নে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু করা হয়েছে। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা প্রতিযোগিতা করে নৈতিক ক্লাসের মান উন্নীত করতে চেষ্টা করেন। ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত মোট ৬টি বড় আকারের নৈতিক ক্লাস প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।

কিছু কিছু এলাকার মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের নৈতিক ক্লাসের শিক্ষকের অভাব রয়েছে এবং তাদের শিক্ষাদানের মানও দুর্বল। তাই বিভিন্ন ভালো স্কুল থেকে সেরা শিক্ষকদের বেছে নেওয়া হয়েছে, তারা অন্যান্য স্কুলে গিয়ে নিজের নৈতিক ক্লাসের অভিজ্ঞতা ও কর্মপদ্ধতি বিনিময় করেন। এভাবে সবার যৌথ প্রয়াসে বিভিন্ন স্কুলের নৈতিক ক্লাসের মান উন্নীত করা সম্ভব।

উচৌ শহরের সিনশিং প্রাথমিক স্কুলের সিপিসি’র সম্পাদক সিয়াও সিন সিন বলেন, নৈতিক ক্লাসের পাঠদান আনন্দদায়ক করার জন্য স্থানীয় ইউয়ে অপেরার উত্তরাধিকারী ব্যক্তিকে স্কুলের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। শিল্পকলা যুক্ত করার পর ছাত্রছাত্রীরা ইউয়ে অপেরার চর্চায় অংশ নিতে পারে। বিভিন্ন ধরনের অপেরায় অভিনেতার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা অপেরার মধ্যে প্রকাশিত দার্শনিক চেতনা ও মূল্যবোধ আরো ভালো করে বুঝতে সক্ষম এবং ইউয়ে অপেরাসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যিক চীনা সভ্যতার প্রতি তাদের গবেষণার আগ্রহ তৈরি হয়, এটিও শিক্ষার্থীদের শিল্পকলার গুণগতমান উন্নয়নে সহায়ক।

 

সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের হোমওয়ার্ক করা উভয়ের জন্য ক্ষতিকর

বর্তমানে সন্তানদের সাথে হোমওয়ার্ক করা অনেক চীনা বাবা মায়ের চাকরির বাইরের অতিরিক্ত কাজে পরিণত হয়েছে। যখন ছেলেমেয়ের সাথে বাব-মা হোমওয়ার্ক করেন, তখন তাদের মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং উচ্চরক্তচাপ দেখা দেয়। যখন হমওয়ার্ক থাকে না, তখন পরিবারে বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্ক বেশ ভালো থাকে, আর যখন হোমওয়ার্ক থাকে তখন দুঃখ, রাগ আর কান্নাকাটিতে সারা।

চীনের সামাজিক গণমাধ্যমে বাবা-মা সন্তানের সাথে হোমওয়ার্ক করার ভিডিও প্রচুর দেখা যায় এবং এমন ভিডিও অনেক সাড়া ফেলে। কারণ এটি অনেক পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ। তবে এ সম্পর্কে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বিপরীত কথা বলেছেন। বেইজিং ৪ নম্বর স্কুলের প্রেসিডেন্ট মা চিং লিন বলেন, বাবা-মায়ের সন্তানের সাথে হোওমওয়ার্ক করা ঠিক নয়, শুধু তাদের হোমওয়ার্কের লেখা সুন্দর কিনা চেক করা যথেষ্ট। তবে হোমওয়ার্কের সঠিক উত্তর বাবা-মা’র লিখে দেওয়া ঠিক নয়। স্বাধীন চিন্তাভাবনা গড়ে তোলা, লেখাপড়ার দক্ষতা উন্নীত করা এবং সার্বিকভাবে জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের নিজের হোমওয়ার্ক নিজেকে করতে হবে।

তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন যে, সন্তানেরা যেন ফুলের মতো। বাবা-মা তাদের বড় হওয়ার জন্য সুর্যালোক, পানি ও মাটি দিতে পারেন, তবে কাঠমিস্ত্রির মতো নির্দিষ্ট ডিজাইনে সন্তানকে আসবাবপত্রের মতো তৈরি করার দরকার নেই। প্রত্যেক শিশু আলাদা ও অনন্য। তাই তাদের বড় হওয়ায় পরামর্শ দেওয়া ঠিক আছে, তবে নিয়ন্ত্রণ না করাটা খুব জরুরি।  সন্তানের জন্মের আগে বাবা-মায়ের মনে তার শিক্ষার বিষয় কিছু চিন্তাভাবনা থাকে। তবে সন্তানের জন্ম এবং বড় হওয়ার পর বিশেষ করে স্কুলে যাবার পর আশেপাশের পরিবেশের প্রভাবে বাবা-মায়ের চিন্তাভাবনাও পরিবর্তন হয়। বস্তুত ছেলেমেয়েদের যে কোনো কাজে অংশ নেওয়া পরিবারের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ সন্তানেরা সহজভাবে পিতামাতার উপর নির্ভর করে। যদি তাদের বেশি নিয়ন্ত্রণ বা সমালোচনা করা হয়, তাহলে ছেলেমেয়ের সঙ্গে আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যায়।

অতীতকালে বাবা-মারা ছোটবেলায় অনেকে নিজেই নিজের হোমওয়ার্ক করা এবং নিজেই বাড়ি থেকে স্কুলে আসাযাওয়া করতেন। এমন ছেলেমেয়েদের স্বাধীন চেতনা দ্রুত গড়ে ওঠে এবং এটি তাদের বড় হওয়ার পর জীবনযাপনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমন সন্তানদের কর্মদক্ষতা ও মানসিক অবস্থা আরো শক্তিশালী হয়।

তাই পিতামাতার উচিত সন্তানকে স্বাধীনভাবে হোমওয়ার্ক করার সুযোগ দেওয়া। একদিকে সন্তানের বড় হওয়ার পথে সঠিক নির্দেশনা ও যথাযথ পরামর্শ দেয়া, অন্যদিকে অতিরিক্তভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ না করা। আরো আরামদায়ক মানসিক অবস্থায় তাদের জন্য সৃজনশীলতার সুযোগ ও সম্ভাবনা দেয়া। যদিও কিছু কিছু শিশুর বোঝার ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে একটু দুর্বল হতে পারে, তবে তারা নিজের গতিতে একসময় সব দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। নিজের পদক্ষেপ অনুসরণ করে বড় হওয়া শিশুর মানসিক অবস্থা আরো স্বাস্থ্যকর হয়, এটিও জ্ঞান অর্জন করা বা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

মোদ্দাকথায় সন্তানদের বড় হওয়ার পথে সহাবস্থান ও দেখাশোনা করার সময় তাদের অনুভূতিকে সম্মান করা এবং তাদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন বিষয়কে বিবেচনা করা বাবা-মায়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এমন সঠিক চেতনা থাকলে সন্তানদের সহাবস্থানে বাবা মা আরো ইতিবাচক ভুমিকা পালন করতে সক্ষম।(সুবর্ণা/হাশিম/মুক্তা)