চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব ৬৩তম পর্ব
2024-03-25 15:52:40

 

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৬৩তম পর্বে যা থাকছে:

 

* জোনাকির দেহের লাইট অর্গানের রহস্য উন্মোচন

* লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে নতুন প্রযুক্তি চীনা বিজ্ঞানীদের

 

* শূকরের যকৃত প্রতিস্থাপনে নতুন রেকর্ড

 

 

জোনাকির দেহের লাইট অর্গানের রহস্য উন্মোচন

জোনাকির দেহে থাকে লুসিফেরিন নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ। সেটাই জোনাকির দেহে বিক্রিয়া ঘটায়। লুসিফেরিন বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে আলো তৈরি করে। এভাবে প্রাণীর দেহে জৈবিক প্রক্রিয়ায় আলো তৈরি হওয়াটাকে বলে বায়োলুমিনিসেন্স।

সম্প্রতি একদল চীনা গবেষক জোনাকির দেহের এই লাইট অর্গানের কিছু রহস্য উন্মোচন করেছেন।

 

একটি প্রাপ্তবয়স্ক জোনাকির দেহে কীভাবে আলো তৈরির অঙ্গ বিকাশ লাভ করে এবং এই আলোর মাধ্যমে কীভাবে পুরুষ ও স্ত্রী জোনাকি একে অপরকে আকৃষ্ট করে এসব তথ্য উঠেছে এসেছে তাদের গবেষণায়। এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।

গবেষণাটি করেছেন হুয়াচং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। গবেষকরা ‘আকুয়াটিকা লেই’ নামক এক প্রজাতির জোনাকি নিয়ে গবেষণাটি করেছেন। মজার বিষয় হলো জোনাকির এ প্রজাতি শুধু চীনেই পাওয়া যায়।

চীনা গবেষকদের আবিষ্কারটি কীটপতঙ্গের আলোর সংকেত প্রদান ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রী জোনাকি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর আলো জ্বালানোর মাধ্যমে একে অন্যকে আকৃষ্ট করে।

এর জন্য প্রাপ্তবয়স্ক ফায়ারফ্লাই ভিন্ন ভিন্ন আলোর ঝলকানি দিয়ে প্রণয়ধর্মী সংকেত প্রদর্শন করে। এই আলো বিশেষ লাইট অর্গান থেকে নির্গত হয়। আর লাইট অর্গানগুলো পিউপা পর্যায় থেকে প্রায় স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়। যদিও এ গবেষকরা পূর্ণাঙ্গ লাইট অর্গানের বিকাশের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে উদঘাটন করতে পারেননি।

লাইট অর্গানের রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে চীনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা, জোনাকির লাইট অর্গানের বিকাশের প্রথম, মধ্য এবং পরবর্তী বিভিন্ন ধাপ নিয়ে গবেষণা করেছেন। এর জন্য তারা তুলনামূলক জিনোমিক্স, ট্রান্সক্রিপ্টোমিক্স এবং জিন নিষ্ক্রিয়করণ কৌশল ব্যবহার করেছেন।

চীনা গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, ‘এএলএবিডি-বি এবং এএলইউএনসি-৪’ নামের দুটি গুরুত্বপূর্ণ হোমিওবক্স ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর জোনাকির আলোক অঙ্গ ও জৈবদীপ্তির বিকাশের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। এই জিনগুলো কোনও ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে কিংবা কার্যক্রম বাধাপ্রাপ্ত হলে জোনাকির আলো জ্বলতে ব্যর্থ হবে।

হোমিওবক্স ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর হলো একগুচ্ছ জিন, যা জীবের শারীরিক গঠন ও বেড়ে ওঠার বিন্যাস ঠিক করে। এগুলো প্রাণী, ছত্রাক, উদ্ভিদ এবং কিছু এককোষী জীবে পাওয়া যায়।

পৃথিবীতে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির জোনাকি পোকা রয়েছে। তবে সব জোনাকি আলো তৈরি করে না। আর তাই জোনাকির আলো জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও অন্যান্য প্রযুক্তির গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

 

লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে নতুন প্রযুক্তি চীনা বিজ্ঞানীদের

ব্যাটারির জগৎটা এমন এক মহাসাগরের মতো, যেখানে একটি ঢিল ছুড়লেও সেটার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়াজুড়ে। সম্প্রতি ঠিক এমনই একটি সাড়া জাগানো আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেন চীনের বিজ্ঞানীরা। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে থাকা ইলেকট্রোলাইটের এমন এক সংস্করণ তারা তৈরি করেছেন যাতে ব্যাটারিটি মাইনাস ৮০ ডিগ্রির মতো চরম ঠান্ডার মাঝেও টিকে থাকবে।

 

এ ধরনের ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে প্রতিকূল পরিবেশে চলা যন্ত্রপাতি ও যানবাহনে। বিশেষ করে অনেক উঁচুতে ওড়া উড়োজাহাজ কিংবা ড্রোনে কাজে আসবে এ ব্যাটারি।

 

পাশাপাশি সামুদ্রিক গবেষণায় ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্স, রেলপথ, মেরু অঞ্চলে গবেষণা এবং টেলিযোগাযোগ সহ বিস্তৃত পরিসরে এ ব্যাটারির ব্যবহার রয়েছে।

চীনের চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এ আবিষ্কারের বিস্তারিত প্রকাশ হয়েছে নেচার জার্নালে। তাতে গবেষকরা দেখিয়েছেন, কী করে খুব সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করা একটি দ্রাবকের সাহায্যে তারা আস্ত ব্যাটারির বৈশিষ্ট্য বদলে দিতে পেরেছেন। আর ওই দ্রাবকের কারণেই ব্যাটারির ভেতর থাকা ইলেকট্রোলাইটের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বদলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

নতুন এ ইলেকট্রোলাইটে তৈরি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি শুধু চরম শীতে টিকেই থাকবে না, এ অবস্থায় এটি চার্জও হবে দ্রুত। চেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফান সিউলিন বললেন, চরম শীতল তাপেও এই ব্যাটারি চার্জ হতে সময় নেবে মাত্র ১০ মিনিট।

লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির প্রচলিত ইলেকট্রোলাইটটি হলো মূলত একটি জৈব দ্রবণে থাকা লিথিয়াম লবণ। ব্যাটারির ভেতর চার্জ আদান প্রদানের যে আয়নিক কর্মকাণ্ড ঘটে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই এর কাজ।

ব্যাটারি নিয়ে ফান ও তার সহকর্মীরা গত চার বছরের গবেষণায় নানা ধরনের দ্রাবক নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। এর মধ্যে তারা ফ্লুরোএসিটোনাইট্রিল নামের একটি দ্রাবক ব্যবহার করে তৈরি করেছেন নতুন ইলেক্ট্রোলাইটটি।

বিজ্ঞানীরা নতুন এ প্রযুক্তির পরীক্ষায় ব্যবহার করেছেন সফট প্যাক লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। এতে দেখা গেছে, ব্যাটারির ভেতর আয়ন আদান-প্রদানে এমন গঠনগত পরিবর্তন এসেছে, যে পদ্ধতি সম্পর্কে আগে কারও ধারণা ছিল না।

এতে দেখা গেছে, চীনা গবেষকদের তৈরি ইলেক্ট্রোলাইটের ছোট দ্রাবক অণুগুলো লিথিয়াম আয়নের চারপাশে দুটি স্তর তৈরি করে। যার ভেতর দিয়ে আয়ন চলাচলের একটি নতুন রাস্তা তৈরি হয়। আর এ রাস্তার নাম লিগ্যান্ড-চ্যানেল ট্রান্সপোর্ট।

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ওই লিগান্ড চ্যানেলের মাধ্যমেই ব্যাটারিগুলো চরম শীতল পরিবেশে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে।

এ আবিষ্কার শুধু লিথিয়াম আয়নের জন্যই প্রযোজ্য হবে, এমন নয়। ফ্যান ও তার গবেষণা দল দেখিয়েছেন, তাদের এ পদ্ধতি সোডিয়াম আয়ন ও পটাশিয়াম আয়ন ব্যাটারির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব।

তবে এখনকার প্রচলিত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির নকশায় নতুন ইলেকট্রোলাইটটি কাজ করবে কিনা তা পরিষ্কার করে জানাতে আরও গবেষণার দরকার আছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানী ফান সিউলিন।

 

|| প্রতিবেদন ও সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

 

শূকরের যকৃত প্রতিস্থাপনে নতুন রেকর্ড

চীনের শায়ানসি প্রদেশের সি’আন শিচিং হাসপাতালের চিকিৎসকরা একজন রোগীর দেহে শূকরের যকৃত সফলভাবে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রদেশের বিমানবাহিনী সামরিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা এমন সফলতা দেখিয়েছেন।

 

যকৃতটি ৯৬ ঘণ্টারও বেশি সময় সঠিকভাবে কাজ করছে, যা আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

৫৭ বছর বয়সী একজন পুরুষ রোগীর দেহে এই লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়। তিনি লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। লিভার সিরোসিস হলো লিভারের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি যা লিভারের কার্যকারিতা ব্যাহত করে। অস্ত্রোপচারের সময়, রক্ত প্রবাহ পুনরুদ্ধার করার পর যকৃত পিত্ত নিঃসরণ করতে শুরু করে এবং কোনও হাইপারঅ্যাকিউট প্রত্যাখ্যান দেখা যায়নি বলে বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উইচ্যাট অ্যাকাউন্টে জানানো হয়েছে।

ওই রোগীর মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি ছিলেন মূলত ব্রেইন ডেড।  চিকিৎসকরা প্রায় ৯ ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের পর ওই মৃত্যুপথযাত্রীর শরীরে মাল্টি-জিন-সম্পাদিত শূকরের  লিভার প্রতিস্থাপন করেন। অস্ত্রোপচারের সময় রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করার পর দেখা গেল লিভারটি বাইল রস নিঃসরণ শুরু করেছে এবং কোনও ধরনের জটিলতাও দেখা যায়নি।

হাসপাতালের লিভার সার্জারি বিভাগের পরিচালক থাও খাইশান জানান, প্রতিস্থাপিত লিভারটি চমৎকার পিত্ত নিঃসরণ, রক্ত সরবরাহ এবং রোগতাত্ত্বিক ফলাফল দেখিয়েছে, যা দলটির প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

 

চীনের বিজ্ঞান একাডেমির গবেষক এবং হাসপাতালের লিভার এবং পিত্তথলি সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক তৌ খেফেং জানান, এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে শূকরের যকৃত মানুষের যকৃতের স্থলে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। এটি জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চীনে প্রায় ৪০ কোটি লিভার আক্রান্ত রোগী রয়েছে। দেশটিতে প্রতি বছর ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ নতুন লিভার ফেইলিয়রের ঘটনা ঘটে। লিভার ফেইলিয়র হলে প্রতিস্থাপনই হলো একমাত্র কার্যকর চিকিৎসা। কিন্তু বাস্তবে, অনেক মানুষই লিভার দাতার জন্য অপেক্ষা করতে না পারার কারণে জীবন হারায়।

বাংলাদেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ক্রমশ উন্নতিশীল। বর্তমানে কিডনি, লিভার, চোখের কর্নিয়া এবং চামড়া প্রতিস্থাপন নিয়মিতভাবে করা হচ্ছে। হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস প্রতিস্থাপনও শুরু হয়েছে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী