দেহঘড়ি পর্ব-৬৩
2024-03-24 15:54:30

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং ভেষজের গুণ নিয়ে আলোচনা ‘হারবাল হিলিং’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

বাতজ্বরের টিসিএম চিকিৎসা

রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর একটি গুরুতর অসুস্থতা। গলায় স্ট্রেপ্টোকোকাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে সাধারণত এ রোগ হয়। এই রোগ হলে হৃদযন্ত্র, অস্থিসন্ধি, ত্বক ও মস্তিষ্ক প্রভাবিত হয়। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় বাতজ্বরের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তবে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা এ রোগের একটি বিকল্প চিকিৎসা প্রদান করে, যা শরীরের মধ্যে ভারসাম্য পুনরুদ্ধার এবং রোগের মূল কারণগুলোকে দূর করার ওপর গুরুত্ব দেয়।

টিসিএমে মনে করা হয়, শরীরের অত্যাবশ্যকীয় শক্তি বা ‘ছি’ ও রক্ত সঞ্চালনের ভারসাম্যহীনতার প্রকাশ হলো বাতজ্বর। টিসিএম নীতি অনুসারে, বাতজ্বর বায়ু, ঠান্ডা, ক্লেদ ও তাপের মতো প্যাথোজেনিক কারণগুলোর আক্রমণের সঙ্গে যুক্ত। এই কারণগুলো শরীরের শৃঙ্খলা ব্যাহত করে, যার ফলে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, জ্বর, প্রদাহ ও হৃদযন্ত্রের জটিলতার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

বাতজ্বরের চিকিৎসায় টিসিএমের মূল নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্যাথোজেনিক কারণগুলো দূর করা এবং একই সঙ্গে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা।

টিসিএম চিকিৎসায় ভেষজ ওষুধ একটি মূল ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে যেসব ভেষজ ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর মধ্যে থাকে চীনা অ্যাঞ্জেলিকা (তাং কুই), অ্যাস্ট্রাগালাস (হুয়াং ছি), হোয়াইট পিওনি রুট (পাই শাও), পিউবেসেন্ট অ্যাঞ্জেলিকা রুট (তু হুও) এবং ক্লেমাটিস রুট (ওয়েই লিং সি)। এগুলোর মধ্যে চীনা অ্যাঞ্জেলিকা, অ্যাস্ট্রাগালাস ও  হোয়াইট পিওনি রুট ‘ছি’ ও রক্ত পুষ্ট করে এবং  দুর্বলতা ও ক্লান্তি দূর করে। পিউবেসেন্ট অ্যাঞ্জেলিকা রুট ও ক্লেমাটিস রুট শরীর থেকে ক্লেদ দূর করে এবং অস্থিসদ্ধির ব্যথা ও ফোলা উপশম করে।

বাতজ্বরের আরেকটি টিসিএম চিকিৎসা হলো আকুপাংচার। রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি, প্রদাহ হ্রাস এবং বাতজ্বরের সাথে সম্পর্কিত ব্যথা উপশমে ভীষণ কার্যকর আকুপাংচার। নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে আকুপাংচার দেওয়া হলে ‘ছি’ ও রক্তপ্রবাহ সুশৃঙ্খল হয়, যার ফলে বাতজ্বরের উপসর্গগুলো উপশম হয় এবং শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়।

বাতজ্বরের চিকিৎসায় টিসিএম খাদ্য ও জীবনধারার ওপর খুব গুরুত্ব দেয়। টিসিএম চিকিৎসকরা প্রদাহ কমাতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখতে খাদ্যতালিকাগত পরিবর্তনের সুপারিশ করে থাকেন। এ পরিবর্তনের মধ্যে সাধারণত থাকে প্রদাহসৃষ্টিকারী খাবার যেমন প্রক্রিয়াজাত মাংস, পরিশোধিত শর্করা এবং হাইড্রোজেনেটেড তেল এড়ানো এবং ফল, শাকসবজি, শস্য, মাছ ও বাদাম মতো প্রদাহবিরোধী খাবার গ্রহণ।

ছিকং, থাই চি ও ধ্যানের মতো মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ কৌশলগুলো অবলম্বন করাও বাতজ্বরের উপসর্গ উপশমে সহায়ক হতে পারে। এই অনুশীলনগুলো চাপ কমাতে, স্বস্তি বাড়াতে এবং সামগ্রিক সুস্থতার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে, যা টিসিএম নীতি অনুসারে স্বাস্থ্যের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।

একটি বিষয় মনে রাখা দরকার - বাতজ্বর নিরাময়ে টিসিএমকে একটি পরিপূরক পদ্ধতির হিসাবে গ্রহণ করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। টিসিএম ও আধুনিক চিকিৎসা উভয়ই বোঝেন এমন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে টিসিএমকে অন্তর্ভূক্ত করে একটি সামগ্রিক চিকিৎসা প্রক্রিয়া গ্রহণ করলে বাতজ্বর নিরাময় সহজ হয়।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

শানতুংয়ের অন্যতম সেরা চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান ছিংদাও কেন্দ্রীয় হাসপাতাল

ছিংদাও কেন্দ্রীয় হাসপাতাল চীনের পূর্বাঞ্চলীয় শানতুং প্রদেশের ছিংদাও নগরীর অন্যতম সেরা চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান। এটি ছিংদাও সেন্ট্রাল মেডিকেল গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। সেন্ট্রাল মেডিকেল গ্রুপে রয়েছে দুটি ক্যাম্পাস – মূল ক্যাম্পাস ও উত্তর ক্যাম্পাস। মূল ক্যাম্পাসে অন্তর্ভূক্ত ছিংদাও কেন্দ্রীয় হাসপাতাল। এ হাসপাতালের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো হলো ছিংদাও ক্যান্সার হাসপাতাল এবং ছিংদাও পেশাগত রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ হাসপাতাল। অন্যদিকে উত্তর ক্যাম্পাসে রয়েছে ছিংদাও বক্ষব্যাধি হাসপাতাল।

এর মধ্যে ছিংদাও কেন্দ্রীয় হাসপাতাল ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুরুতে এর নাম ছিল ছিংদাও টেক্সটাইল হাসপাতাল। ১৯৮৬ সালে এটি ছিংদাও মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় অধিভুক্ত হাসপাতাল হিসাবে পরিচিতি পায় এবং ১৯৯৩ সালে সর্বোচ্চ শ্রেণীর জেনারেল হাসপাতালে উন্নীত হয়। ২০১৬ সালে এ হাসপাতালটি ছিংদাও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্লিনিক্যাল মেডিকেল কলেজে অধিভুক্ত হয় এবং ২০২০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজের সাথে অধিভুক্ত হয়।

প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকার উপর স্থাপিত এ হাসপতালে বর্তমানে শয্যাসংখ্যা ২ হাজারের বেশি। এর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ইউয়ান এবং এখানে কর্মরত ২ হাজার ৩শোর বেশি কর্মী, যাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মধ্য-স্তর থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ পেশাদার এবং ৫৫ জন স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ের সুপারভাইজার।

বর্তমানে ছিংদাও কেন্দ্রীয় হাসপাতালে রয়েছে প্রাদেশিক পর্যায়ের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, মিউনিসিপ্যাল পর্যায়ের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যাবরেটরি৷ এখানকার গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে হেমাটোলজি, ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি, জরুরি চিকিৎসা, পুনর্বাসন, প্রসূতি ও গাইনোকোলজি, নিউরোসার্জারি, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, প্যাথলজি, নাক-কান-গলা, এন্ডোক্রাইনোলজি, নিউরোলজি, কার্ডিওলজি এবং আল্ট্রাসাউন্ড মেডিসিন।

চীনের বিখ্যাত সব স্বাস্থ্যসেবা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে ছিংদাও কেন্দ্রীয় হাসপাতালের। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চীনের চিকিৎসাবিজ্ঞান একাডেমির ক্যান্সার হাসপাতাল, তিয়ানজিন হেমাটোলজি ইনস্টিটিউট, পিকিং ইউনিভার্সিটি ক্যান্সার হাসপাতাল এবং প্রাদেশিক ক্যান্সার হাসপাতাল। পিকিং ইউনিয়ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে ছিংদাও কেন্দ্রীয় হাসপাতাল ছিংদাও নগরে প্রথম মেরুদণ্ডের রোগনির্ণয় এবং চিকিত্সাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

 

#হারবাল_হিলিং

লবঙ্গ কেবল মসলা নয়, ভেষজও

মসলা হিসেবে খুব পরিচিত লবঙ্গ। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গুরুপাকে এটা না হলে চলেই না। তবে নানা স্বাস্থগত গুণের কারণে ভেষজ হিসাবেও লবঙ্গের কদর কম নয়। জানিয়ে দিচ্ছি লবঙ্গের কয়েকটি উপকারিতা সম্পর্কে:

হজমক্ষমতা বাড়ায়: লবঙ্গে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ফাইবার, যা হজমক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, ডিসপেপসিয়া ও নসিয়ার মতো সমস্যা হাত থেকে মুক্তি দিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে লবঙ্গ।

দাঁতের ব্যথা কমায়: লবঙ্গে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান শরীরে প্রবেশ করার পর দ্রু দাঁতের ব্যথা কমে। পাশাপাশি মাড়ির ক্ষয় রোধ এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে বিশেষ ভুমিকা পালন করে এই লবঙ্গ। এজন্য প্রায় সব টুথপেস্টের এটি একটি কমন উপকরণ।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন তৈরি হতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে, লবঙ্গের রস শরীরের ভিতরে ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে এবং এর মধ্য দিয়ে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। কর্মক্ষমতা বাড়াতেও অবদান রাখে লবঙ্গ।

রুচি বৃদ্ধি করে: রুচি বৃদ্ধিতে ভীষণ কার্যকর লবঙ্গ। বিভিন্ন রোগ, বিশেষ করে পেটের রোগে ও জ্বরে ভোগার পরে খাবারে অরুচি দেখা দেয়। লবঙ্গ চুর্ণ সকালে খালি পেটে এবং দুপুরে খাবারের পরে খেলে খাবারে রুচি ফিরে আসবে।

ত্বকের সংক্রমণ সারায়: লবঙ্গে থাকা ভোলাটাইল অয়েল শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান বের করে দেয় এবং জীবাণু মেরে ফেলে। এর ফলে সংক্রমণজনিত কষ্ট কমে এবং ঘা-পচড়া সেরে ওঠে।

বমি বমি ভাব দূর করে: যানবাহনে চড়ার সময় যদি মাথা ঘুরতে থাকে ও বমি আসে, তাহলে মুখে একটি লবঙ্গ রেখে সেই রস চুষলে বমি ভাব ও মাথা ঘোরা কমে যায়। গর্ভবতী মায়েরা সকালের বমিবমি ভাব দূর করতে লবঙ্গ চুষতে পারেন।

 

 ‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।