৬২তম পর্বে যা থাকছে:
* মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধের নতুন ব্যবহার আবিষ্কার
* মহাজাগতিক তরঙ্গের বিচ্ছুরণ দেখে তোলা হলো মগজের ছবি
মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধের নতুন ব্যবহার আবিষ্কার
বিশ্বের প্রতিদিন কোটি কোটি ওষুধ হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ। ক্ষতিকর বলে এগুলোকে সাধারণত সবাই এড়িয়েই চলেন। তবে ওষুধ মানেই কোনো না কোনো রাসায়নিক। আর সেই রাসায়নিককে চাইলে কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগানোই যায়। এমন চিন্তা থেকেই গবেষণা শুরু করেন চীনের শায়ানসি প্রদেশের বিজ্ঞানীরা। তারা ওই ওষুধ থেকে বিশেষ রাসায়নিক পৃথক করে সেটাকে কাজে লাগাচ্ছেন অপরিশোধিত তেলের প্রক্রিয়াকরণের কাজে। বিশেষ করে ওই ঘন তেলের ঘনত্ব কমাতে ব্যবহার করা যাচ্ছে ওই সব ওষুধ। গত জানুয়ারিত জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্টে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়।
শায়ানসি প্রদেশের রাজধানী শিআনের শিআন শিইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছেন। তারা দেখিয়েছেন মেনোপজের বিভিন্ন উপসর্গ, মুড সুইংয়ের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রোজেস্টেরন ইনজেকশন বা ক্যাপসুলগুলো অপরিশোধিত তেলের সান্দ্রতা কমাতে পারে।
এই সান্দ্রতা হলো কোন তরল কতটা সহজে প্রবাহিত হতে পারে তার পরিমাপ। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, তরলের প্রবাহের বাধা মাপা হয় এর সান্দ্রতা থেকে। সান্দ্রতা কতটা তা নির্ণয়ের জন্য ভিসকোসিটি নামক একক ব্যবহার করা হয়। ভিসকোসিটি যত বেশি, সান্দ্রতাও তত বেশি। আর ‘পোর পয়েন্ট’ হচ্ছে সেই তাপমাত্রা যার নিচে নামলে তেল আর ঢালা যায় না। কারণ, এই তাপমাত্রার নিচে গেলে তেল জাতীয় পদার্থ জমাট বেঁধে প্রবাহ আটকে যায়।
প্রোজেস্টেরোন ইনজেকশন কীভাবে অপরিশোধিত তেলের ঘন গঠনকে ভেঙে দেয় সে সম্পর্কে গবেষণাপত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ওষুধ সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ এবং চূড়ান্ত প্যাকেজিংসহ প্রতি মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল তরলীকরণে খরচ হবে ১ হাজার ৬২ থেকে ১ হাজার ২৪১ ডলার পর্যন্ত।
গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি এন্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক ছেন কাং জানিয়েছেন, প্রোজেস্টেরনের রাসায়নিক গঠন অপরিশোধিত তেলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ ছাড়াও ফেস মাস্কের পলিপ্রোপিলিন এবং ফোম প্লাস্টিক এবং এক্রিলিক গ্লাসের কিছু উপাদানও অপরিশোধিত তেলের সান্দ্রতা ও জমাট বাঁধা কমাতে সক্ষম।
তিনি বলেন, এখন আমাদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধ, প্লাস্টিকসহ এসব বস্তুর রিসাইকেল ও কার্বন নিঃসরণ কমানো গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৪ সালে কুয়াংতোং প্রদেশের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনে প্রায় ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের বাড়িতে গড়ে একটি করে ওষুধের কেবিনেট আছে। যারা তাদের ৮০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলোকে আলাদা করে রাখেন না বা আলাদা করে ডাস্টবিনে রাখছেন না।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৯০ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা বিক্ষিপ্তভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ ফেলে দেন এবং প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার টন মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিভিন্ন বাড়িতে পাওয়া যায়।
বাড়িতে উৎপাদিত এসব ফার্মাসিউটিক্যাল বর্জ্য সাধারণত ময়লার ঝুড়িতে ফেলা হয় অথবা পোড়ানো হয়। ছেনের মতে, প্রতি বছর মেয়াদোত্তীর্ণ বা অব্যবহৃত ঔষধ পোড়ানোর ফলে প্রায় ১৫ হাজার টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ বাড়ছে। গবেষণায় প্রস্তাবিত পদ্ধতিটি কেবল বর্জ্য নিষ্পত্তি এবং অপরিশোধিত তেলের তরলীকরণ ব্যয়ই কমাবে না। বরং এটি পরিবেশকেও বাঁচাবে এবং জাতীয় কার্বন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাহায্য করবে। বিশেষ করে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা সর্বনিম্ন মাত্রায় নামিয়ে আনা এবং ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতিকেও বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করবে।
গবেষণাটি মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধ পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে বলেও ছেন বলেন। তবে তার মতে কৌশলটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা কঠিন হবে। কারণ চীনে মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধের নিয়মতান্ত্রিক শ্রেণীবদ্ধকরণ ব্যবস্থা না থাকায় ওষুধগুলো সংগ্রহ করাই দায় হয়ে দাঁড়াবে।
গবেষকরা মনে করছেন তাদের এ গবেষণাটি ভালো একটি সম্ভাবনা দেখিয়েছে। অপরিশোধিত তেলে এর ব্যবহারের বিষয়টি প্রচার পেলে তেল শিল্পেও বড় প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি আবিষ্কারটি ওষুধ সংক্রান্ত বর্জ্যও কমাবে।
|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার
|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
মহাজাগতিক তরঙ্গের বিচ্ছুরণ দেখে তোলা হলো মগজের ছবি
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত একটি শব্দ হলো ফাস্ট রেডিও বার্স্ট। যার মানে হলো মহাকাশের একটি বড় এলাকাজুড়ে খুব কম সময়ের জন্য বিপুল পরিমাণ রেডিও তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়া। ব্যাপারটাকে তুলনা করা যেতে পারে বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে। চীনা বিজ্ঞানীরা সেই ফাস্ট রেডিও বার্স্ট তথা এফআরবি’র দেখাদেখি প্রাণীর মস্তিষ্কে নিউরাল নেটওয়ার্কে ঘটে যাওয়া বৈদ্যুতিক তরঙ্গ শনাক্তের একটি চিপ আবিষ্কার করেছেন।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত সব ছবি কিন্তু ক্যামেরা ধরলেই তোলা যায় না। যেমন ঘূর্ণায়মান তারকা পালসার থেকে বিচ্ছুরিত শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গের ছবি তুলতে ব্যবহৃত হয় রেডিও টেলিস্কোপ এবং নানা ধরনের ডেটা প্রসেসিং যন্ত্রপাতি। এসব তরঙ্গ অতিক্ষুদ্র সময়ের জন্য তৈরি হয়ে আবার মুহূর্তেই হারিয়ে যায়। এমনই এক ধরনের মহাজাগতিক তরঙ্গের নাম ফাস্ট রেডিও বার্স্ট। এক মিলিসেকেন্ড থেকে শুরু করে ৩ সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী হয় এ ধরনের তরঙ্গ। আমাদের মস্তিষ্কে যখন নানা ধরনের চিন্তা, শব্দ ও ছবি একসঙ্গে এসে ভিড় করে তখনও কিন্তু নিউরাল নেটওয়ার্কে এমনই একটি তরঙ্গের বিচ্ছুরণ ঘটে। পুরোপুরি জৈব প্রক্রিয়াতে ঘটা ওই তরঙ্গের বিচ্ছুরণটিকে পুরোপুরি বুঝতে পারলে বেরিয়ে আসবে মগজের অনেক রহস্য। আর সেই রহস্যের একটা বড়সড় চাবি পেয়েছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি জার্নাল নেচার নিউরোসায়েন্সে প্রকাশ হলো এ গবেষণার বৃত্তান্ত।
মানুষের মগজের না হলেও জেব্রাফিশের মগজের ভেতর তরঙ্গের বিচ্ছুরণের পূর্ণাঙ্গ ছবি তোলার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন চীনের বিজ্ঞান একাডেমির গবেষকরা। যথারীতি এ কাজে তাদের অনুপ্রেরণায় ছিল মহাজাগতিক ফাস্ট রেডিও বার্স্ট বিষয়ক পর্যবেক্ষণ।
প্রশ্ন হলো এ পরীক্ষায় জেব্রাফিশ ব্যবহার করা হলো কেন? উত্তরটা হলো গবেষণার জন্য মাছটি বেশ সহজলভ্য আর মানুষের ৭০ ভাগ জিন পাওয়া যায় জেব্রাফিশে। এ ছাড়া মানুষের সঙ্গে জেব্রাফিশের ভেতরকার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শরীরবৃত্তীয় কার্যকলাপেরও বেশ মিল আছে।
ফাস্ট রেডিও তরঙ্গ বিচ্ছুরণ শনাক্ত করার প্রযুক্তির দেখাদেখি বিজ্ঞানীরা জেব্রাফিশের মগজের ভেতর নিউরাল নেটওয়ার্কে বৈদ্যুতিক সংকেত রেকর্ড করার জন্য একটি বিশেষ চিপ তৈরি করেছেন যা কিনা সেকেন্ডে ৫০০ মেগাবাইট ছবির তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। ওই চিপে ব্যবহার করা হয়েছে ফিল্ড প্রোগ্রাম্যাবল গেইট অ্যারে নামের একটি প্রযুক্তি।
এতে জেব্রাফিশের মস্তিষ্কের ১ লাখ নিউরন একসঙ্গে কী করছে সেটার ছবি তুলতে পারছেন বিজ্ঞানীরা। আর এ তথ্য দিয়ে জেব্রাফিশের মস্তিষ্কের সঙ্গে যন্ত্রের রিয়েলটাইম সংযোগও স্থাপন করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। আর মানুষের সঙ্গে যেহেতু জেব্রাফিশের দারুণ মিল, তাই এ গবেষণায় মানব মস্তিষ্কের অন্দরমহলের অনেক দুয়ার যে খুলতে চলেছে, সেটাই আশা করছেন চীনা বিজ্ঞানীরা।
|| প্রতিবেদন ও সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার
অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল
স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী