প্রেসিডেন্টের সি’র বিশ্বসভ্যতা উদ্যোগ: কেন পরিবর্তনশীল বিশ্বে আন্তঃসভ্যতা সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ
2024-03-17 19:14:57

আগামী মাসগুলোতে, চীনের ফরবিডেন সিটি এবং ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদ বেইজিংয়ে একটি যৌথ প্রদর্শনী করবে, যা হবে দর্শনার্থীদের জন্য দেশ দুটির প্রাচীন সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির সন্ধানের জন্য একটি বহুল-প্রত্যাশিত ইভেন্ট।

 

প্রদর্শনীতে থাকবে দুটি বিশ্ব-বিখ্যাত জাদুঘরের প্রায় ১৫০টি মূল্যবান সংগ্রহ। ২০২৪ সালে চীন-ফ্রান্স সংস্কৃতি ও পর্যটন বছর এবং চীন-ফ্রান্স কূটনৈতিক সম্পর্কের ৬০তম বার্ষিকী হিসাবে এটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এই বছরের ধারাবাহিক কার্যক্রমের একটি অংশ।

 

সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের জন্য বেইজিং এবং প্যারিসের যৌথ প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী তাৎপর্য বহন করে। বিশ্ব আজ বিশৃঙ্খলা এবং সংঘাতে ছেয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী একটি গভীর এবং আরও ব্যাপক বোঝাপড়া এসব সংকটের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির চাবিকাঠি।

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ (জিসিআই) বা বিশ্বসভ্যতা উদ্যোগ প্রস্তাব করেছিলেন।

২০২৩ সালের মার্চ মাসে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সংলাপে বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট সি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে কেন তিনি জিসিআই প্রস্তাব করছেন: “যেহেতু সমস্ত দেশের ভবিষ্যত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, সহনশীলতা, সহাবস্থান, বিনিময়, সম্পর্ক এবং পারস্পরিক শিক্ষা মানবতার আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে, বিশ্বসভ্যতার বাগানকে সমৃদ্ধ করতে একটি অপরিবর্তনীয় ভূমিকা পালন করে।”  

সি তাঁর বক্তৃতায় যেমন উল্লেখ করেছিলেন, উদ্যোগটি সভ্যতার বৈচিত্র্য, মানবতার সাধারণ মূল্যবোধ, উত্তরাধিকারের গুরুত্ব এবং সভ্যতার উদ্ভাবনের পাশাপাশি মানুষে মানুষে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক বিনিময় ও সহযোগিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

 

মানব ইতিহাস জুড়ে, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের উভয় সভ্যতা একে অপরের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়েছে। গ্রেকো-আরবি অনুবাদ আন্দোলনের সময়, যা ঘটেছিল তা এর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে, এরিস্টটল এবং প্লেটোর মতো প্রাচীন চিন্তাবিদদের প্রচুর জ্ঞানমূলক কাজ গ্রিক থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল, যার ফলে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলেও পুরনো জ্ঞান ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতিগুলিকে রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে পুনরুজ্জীবিত হতে সাহায্য করে। .

 

চীনের চারটি মহান উদ্ভাবন রেনেসাঁর মঞ্চ তৈরি করতেও সাহায্য করেছিল। একজন ব্রিটিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের পর্যবেক্ষ, “মুদ্রণ, বারুদ এবং কম্পাসের আবিষ্কার, যেখান থেকে অগণিত পরিবর্তনের সূচনা। এটা এতটাই বিশ্বসভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে যে আর কোনও সাম্রাজ্য, কোনও সম্প্রদায়, কোনও তারকাই এই যান্ত্রিক আবিষ্কারের চেয়ে বেশি কিছু করতে পারেননি।”

 

আন্তঃ-সভ্যতা সংলাপের শক্তির গভীর চেতনার সাথে, প্রাক্তন গ্রিক রাষ্ট্রপতি প্রোকোপিস পাভলোপোলোস, মতামত দিয়েছেন, “আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে প্রধানত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কিছু বিষয়ের বিকৃত ব্যবহারের কারণে, আমরা প্রায়ই, যুদ্ধ এবং শান্তির এক সংকর অবস্থানে নিজেদেরকে খুঁজে পাই। আর এ জন্য আমাদের অবশ্যই সভ্যতার সংলাপ জোরদার করতে হবে।”

 

প্রেসিডেন্ট সি’র দৃষ্টিতে, প্রতিটি সভ্যতা “একটি দেশ বা জাতির প্রজ্ঞা এবং দৃষ্টিভঙ্গি মূর্ত করে এবং প্রতিটি স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব হওয়ার জন্য মূল্যবান।”

 

চীন যেহেতু উচ্চ-মানের উন্নয়নের সাথে আধুনিকীকরণের নিজস্ব পথে অগ্রসর হচ্ছে, তার পর্যাপ্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে।

 

ব্রিটিশ পণ্ডিত মার্টিন জ্যাকস লিখেছেন, পশ্চিমী সভ্যতা যে কোনো না কোনোভাবে সার্বজনীন- এ ধারণার বিপরীতে বিশ্বসভ্যতা উদ্যোগ ধারণাটি মানবজাতির অনেক সভ্যতার বিপুল সমৃদ্ধি এবং বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয়।

 

চীনা আধুনিকীকরণ, যেমনটি বিশদভাবে বলা হয়েছে, বিশাল জনসংখ্যার আধুনিকীকরণ, সকলের জন্য অভিন্ন সমৃদ্ধি, বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক-নৈতিক অগ্রগতি, মানবতা ও প্রকৃতির মধ্যে সম্প্রীতি এবং শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ঐতিহ্যগত চীনা সংস্কৃতির প্রতিফলন খুঁজে পেতে পারে।

 

উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ দারিদ্র্য হ্রাস এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিষয়ে পশ্চিমা মডেল বাদ দিয়ে চীনের অভিজ্ঞতা ও উপায়কে গ্রহণ করেছে।

 

আর্জেন্টিনার লা প্লাটা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক সেবাস্তিয়ান শুলজ বলেন, “ইতিহাস দেখিয়েছে যে মানবতা তখনই উন্নতি লাভ করে যখন বিভিন্ন সভ্যতা শান্তিপূর্ণভাবে, সম্প্রীতির সঙ্গে একসাথে বসবাস করতে পারে।”

 

“প্রতিটি সভ্যতা অনন্য এবং কোন সভ্যতা অন্য কোন সভ্যতার চেয়ে উন্নত নয়, তাই প্রতিটি সভ্যতার বাকি সভ্যতার সাথে ভাগাভাগি করার মতো চমৎকার অবদান রয়েছে”— শুলজের ভাষায় এটাই প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বিশ্বসভ্যতা উদ্যোগের মর্মবাণী।

মাহমুদ হাশিম

সিএমজি বাংলা, বেইজিং।