দেহঘড়ি পর্ব-৬২
2024-03-17 13:22:18

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং ভেষজের গুণ নিয়ে আলোচনা ‘হারবাল হিলিং’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

স্পন্ডিলাইটিস হলে চেষ্টা করুন টিসিএম

স্পন্ডিলাইটিস মেরুদণ্ডের কশেরুকার প্রদাহজনিত একটি রোগ। স্পন্ডিলাইটিস মেরুদণ্ডের একটি জয়েন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে আবার একাধিক জয়েন্টের সঙ্গেও যুক্ত থাকতে পারে। এ রোগ চলফেরার সক্ষমতা নষ্ট করতে এবং জীবনযাত্রার মানকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় স্পন্ডিলাইটিসের চিকিৎসার জন্য সাধারণত ওষুধ, ফিজিওথেরাপি ও সার্জারির উপর নির্ভর করা হয়। তবে অনেকে এ রোগের উপসর্গ উপশম করতে এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য পরিপূরক ও বিকল্প পদ্ধতির সন্ধান করে। ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা বা টিসিএম স্পন্ডিলাইটিসের চিকিত্সার জন্য একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প উপায় দেয়। এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়া হয় রোগীর সামগ্রিক সুস্থতা এবং একেবারে ব্যক্তিভিক্তিক চিকিৎসার উপর।

টিসিএমে স্পন্ডিলাইটিসকে শরীরের অত্যাবশ্যক শক্তি বা ‘ছি’ ও রক্ত সঞ্চালন এবং অঙ্গ ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা হয়। টিসিএম তত্ত্ব অনুসারে, ক্লেদ, ঠান্ডা ও ‘ছি’র স্থবিরতার মতো কারণগুলো স্পন্ডিলাইটিসের বিকাশ ও অগ্রগতিতে অবদান রাখে। তাই এ রোগের টিসিএম চিকিৎসা-কৌশলের লক্ষ্য থাকে এই অন্তর্নিহিত ভারসাম্যহীনতাগুলোকে দূর করার মাধ্যমে ব্যথা উপশম করা, প্রদাহ কমানো এবং নিরাময় ত্বরান্বিত করা।

আকুপাংচার: টিসিএম চিকিৎসার অন্যতম ভিত্তি হলো আকুপাংচার। আকুপাংচার স্পন্ডিলাইটিসের চিকিৎসায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। মেরুদণ্ড ও সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলোর সঙ্গে যুক্ত মেরিডিয়ান বরাবর নির্দিষ্ট আকুপাংচার পয়েন্টগুলোতে আকুপাংচার দেওয়া হলে তা ‘ছি’ প্রবাহকে স্বাভাবিক করে, রক্ত সঞ্চালন উদ্দীপিত করে এবং শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে। গবেষণায় দেখা গেছে, আকুপাংচার কার্যকরভাবে ব্যথা উপশম করতে পারে এবং স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চলাফেরায় সক্ষম করে তুলতে পারে।

ভেষজ ওষুধ: টিসিএমের আরেকটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান ভেষজ ওষুধ। স্পন্ডিলাইটিসের ব্যবস্থাপনায় একটি ভালো বিকল্প যোগায় ভেষজ ওষুধ। টিসিএম অনুশীলনকারীরা প্রতিটি ব্যক্তির অনন্য শারীরিক গঠন, উপসর্গ ও অন্তর্নিহিত ভারসাম্যহীনতা বিশ্লেষণ করে ব্যক্তিভিত্তিক ভেষজ ফর্মুলেশন নির্ধারণ করেন। প্রদাহনিয়ন্ত্রণ, ব্যথানাশ ও পেশী-শিথিল করার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভেষজ যেমন র‌্যাডিস্ক অ্যাঞ্জেলিকা পুবেসেন্টিস বা তু হুও, ফিমেল জিনসেং বা তাং কুই এবং কুইন্স ফ্রুট বা মু গুয়া সাধারণত স্পন্ডিলাইটিসের জন্য ভেষজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ভেষজগুলো প্রদাহ কমাতে, ব্যথা উপশম করতে এবং মেরুদণ্ডের আশেপাশের শিরা ও রগগুলোকে পুষ্ট করতে এবং সেগুলোর নমনীয়তা ও শরীরের গতিশীলতাকে বাড়াতে সমন্বিতভাবে কাজ করে।

এই টিসিএম পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি ডায়েটারি থেরাপি, ছিকুং ও থাই চি স্পন্ডিলাইটিস ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। টিসিএম এমন খাবারগুলোর উপর জোর দেয়, যেগুলো শরীরের জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধির স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখে, প্রদাহ কমায় এবং শরীরের ‘ছি’ ও রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে। ছিকুং ও থাই চি শিথিলতা, নমনীয়তা ও শক্তি প্রবাহ ঠিক রাখে এবং এর মধ্য দিয়ে স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

শায়ানসি প্রদেশের অনেক ‘প্রথম’ জন্ম দিয়েছে সি’আন কেন্দ্রীয় হাসপাতাল

সি’আন কেন্দ্রীয় হাসপাতাল মধ্য চীনের একটি শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৫২ সালে শায়ানসি প্রদেশের রাজধানী সি’আনে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ক্রমাগত উন্নয়ন, নতুন নতুন সরঞ্জাম সংযোজন, নিয়মানুবর্তিতা এবং আধুনিক চিকিৎসাপ্রযুক্তি অর্জনের মধ্যে দিয়ে গত ৭ দশকে এটি একটি বৃহৎ মাপের সামগ্রিক আধুনিক হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। এখানে একই ছাদের নিচে এসেছে চিকিৎসা, চিকিৎসা শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা।

চীনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, সি’আন কেন্দ্রীয় হাসপাতালে রয়েছে ১ হাজার ৩শ শয্যা। পাশাপাশি রয়েছে ৪০টিরও বেশি নিবিড় পরিচর্যা শয্যা এবং ১৬টি আধুনিক লেমিনার-ফ্লো অপারেটিং রুম। এ হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে প্রতিবছর ৮ লক্ষাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা নেয় আর বছরে এখানে ভর্তি করা হয় ৪০ হাজারের বেশি রোগী। বর্তমানে হাসপাতালটিতে প্রায় ২ হাজার কর্মী আছেন, যাদের মধ্যে দেড় হাজারের বেশি মেডিকেল, নার্সিং ও প্রযুক্তিগত কর্মী। চিকিৎসাসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য প্রাদেশিক পর্যায়ের বিভিন্ন খেতাব পেয়েছে এ হাসপাতাল।

সি’আন কেন্দ্রীয় হাসপাতালে ৫২টি ক্লিনিকাল ও চিকিৎসা প্রযুক্তি বিভাগ রয়েছে। এখানে বর্তমানে শায়ানসি প্রদেশের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিকাল স্পেশালিটি রয়েছে। এগুলো হলো নিউরোলজি, নিউরোসার্জারি, রেসপিরেটরি মেডিসিন ও ইমেজিং। এর অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো হলো কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, রেডিওলজি, রেসপিরেটরি মেডিসিন, অকুপেশনাল ডিজিজ, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি, হেমাটোলজি, আল্ট্রাসাউন্ড মেডিসিন, কার্ডিওভাসকুলার মেডিসিন, এন্ডোক্রিনোলজি এবং বার্নস অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ।

শায়ানসি প্রদেশের অনেক ‘প্রথম’-এর জন্ম দিয়েছে সি’আন কেন্দ্রীয় হাসপাতাল। প্রদেশের মধ্যে এখানেই প্রথম তিন-চেম্বার পেসমেকার স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়া এটি প্রদেশের প্রথম হাসপাতাল, যেখানে ওপেন হার্ট সার্জারি, লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন, বাইপাস হার্ট সার্জারি, কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনাল সার্জারি, বিচ্ছিন্ন আঙুল প্রতিস্থাপন সার্জারি শুরু হয়।

সি’আন চিয়াওথুং ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিন-অধিভুক্ত সি’আন কেন্দ্রীয় হাসপাতাল এয়ার ফোর্স মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, সি’আন চিয়াওথুং ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিন, ইয়ানআন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিন এবং চংকিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটির শিক্ষণ হাসপাতাল। বর্তমানে এখানে ডক্টরেট ও মাস্টার্স পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন প্রায় সাড়ে ৩শ শিক্ষার্থী।

 

#হারবাল_হিলিং

তেতো কমলার মিঠা গুণ

বিটার অরেঞ্জ বা তেতো কমলা নানা বায়োঅ্যাকটিভ যৌগসমৃদ্ধ, যার কারণে বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যগত উপকারিতা পাওয়া যা এ ফল থেকে। এ গুণের জন্য বিটার অরেঞ্জ ভেষজ হিসাবেই বেশি ব্যবহৃত হয়। বিটার অরেঞ্জের বৈজ্ঞানিক নাম সাইট্রাস অরেন্টিয়াম। জানিয়ে দিচ্ছি এ ফলের প্রধান স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে:

ওজন কমায়: তেতো কমলা প্রায়ই ওজন নিয়ন্ত্রণের একটি প্রাকৃতিক সম্পূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটিতে রয়েছে সিনেফ্রাইন। এটি এমন একটি যৌগ যা বিপাকে এবং চর্বি পোড়াতে সাহায্য করতে পারে। এ জন্য বিটার অরেঞ্জের নির্যাস ওজন কমানোর সম্পূরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

হজমে সহায়তা করে: তেতো কমলা হজমে সহায়তা করে বলে ভেষজ ওষুধে এটা ব্যবহৃত হয়। এটি হজমকে উদ্দীপিত করতে, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে এবং বদহজম উপশম করতে সহায়তা করতে পারে।

বিষাক্ত উপাদান থেকে রক্ষা করে: তেতো কমলা ফ্ল্যাভোনয়েড ও ফেনোলিক যৌগসহ বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ। এগুলো শরীরের ক্ষতিকারক ফ্রি র‌্যাডিকেলগুলোকে বের করতে সাহায্য করে। এছাড়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো কোষকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে, প্রদাহ কমাতে এবং হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে: কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, তেতো কমলার নির্যাস হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের উপর উপকারী প্রভাব ফেলে। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে, রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে এবং ধমনীতে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। আর এ প্রভাবগুলো হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে অবদান রাখতে পারে।

রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: তেতো কমলাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি আসলে একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং সংক্রমণ ও অসুস্থতা থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত তেতো কমলা গ্রহণ সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বাড়াতেও সাহায্য করে।

ত্বকের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে: তেতো কমলার ত্বক সংকোচন করার এবং ব্যাকটেরিয়াবিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে। এ কারণে এর নির্যাস স্কিনকেয়ার পণ্যগুলোতে ব্যবহৃত হয়। এটি তৈলাক্ততা কমাতে, ত্বক পরিষ্কার করতে এবং ব্রণ কমাতে সাহায্য করে। তেতো কমলার নির্যাস ওবার্ধক্যের প্রক্রিয়াও ধীর করতে পারে।

 

 ‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।