বিশ্ব চিপ সরবরাহ চেইনের অত্যধিক ঘনত্ব এড়াতে ফিলিপাইনকে তার সেমিকন্ডাক্টর কারখানা দ্বিগুণ করতে সাহায্য করবে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী জিনা রাইমন্ডো ১২ মার্চ ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় একথা বলেন।
এর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই ফিলিপাইনকে সাহায্য করতে চায় নাকি তাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে?
দীর্ঘসময় ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ খুব বেশি ছিল না; গড় বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। ২০২২ সালের জুন মাসে ফিলিপাইনে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কথিত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়ন করতে ফিলিপাইনের জন্য প্রলোভন বাড়িয়েছে, তবে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ায়নি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে ফিলিপাইনের ষষ্ঠ বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে থাইল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ পরিমাণ ছিল ২৩০ কোটি ডলার। কিন্তু ফিলিপাইনের জনসংখ্যা থাইল্যান্ডের চেয়ে ৪ কোটির বেশি।
এবার রাইমন্ডো বাণিজ্য ও কৌশল বিষয়ক ২২ জনের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ফিলিপাইন সফর করেন। যদিও তিনি ফিলিপাইনে মার্কিন বিনিয়োগ করার কথা বলেন, তবে বিস্তারিত পরিকল্পনা জানান না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অতীত আচরণ বিশ্লেষণ করলে ফিলিপাইনে তার বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করাই যায়। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত বলেন, তাঁর দেশে যুক্তরাষ্ট্র অবকাঠামো, নির্মাণখাতসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে তবে সবাই জানে এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভালো করে না।
আরেকটি বিবেচনা হলো ফিলিপাইনের বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ক্ষমতা কেমন? ফিলিপাইনের সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ ও ২০২২ সালে ফিলিপাইনে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১১৯০ কোটি ডলার এবং ৯২০ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের প্রথম ১০ মাসে এ পরিমাণ ছিল ৬৫০ কোটি ডলার, যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ কম। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে, যেমন দুর্নীতি, পরিবহন খাতের দুর্বলতা, বিদ্যুৎ ও পানির অধিক মূল্য ইত্যাদি। যদিও ফিলিপাইনে শ্রমের মূল্য অতো বেশি না, তবে গোটা এশিয়ায় যে কটি দেশে শ্রমের মূল্য বেশি, দেশটি তার মধ্যে একটি। আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও নীতি দ্রুত পরিবর্তনের কারণে ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন হবে পারে কি না সেটাও একটি প্রশ্ন।
তাহলে ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতির আসল উদ্দেশ্য কী?
বিশ্লেষকদের মতে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সামরিক ও নিরাপত্তার উপর গুরুত্ব দেয় এবং অর্থনীতির সঙ্গে এর সম্পর্ক বেশি না। তাই মিত্র দেশগুলোকে কৌশর আর্ষণ করতে পারছে না। যেমন ফিলিপাইনের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি একটি ব্যাপার। তাই যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক দিকে ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলে অর্থনীতি যুক্ত করছে; অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র-ফিলিপাইন সামরিক জোটে অর্থনৈতিক শক্তি যোগাচ্ছে।
ফিলিপাইন সফরকালে রাইমন্ডো বলেছেন, সেমিকন্ডাক্টরসহ উন্নত প্রযুক্তি চীনের হাতে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকবে - এটা নিশ্চিত করতে যে কোনও মূল্য দেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র যেকোনভাবেই চীনকে দমন করতে চায় আর তাদের কাছে ফিলিপাইন হলো উপযুক্ত দাবার গুটি।
ফিলিপাইনকে নিজের কাছে নেওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। ফিলিপাইনকে ব্যবহার করে চীনকে দমন করতে পারে। যেমন দক্ষিণ চীন সাগরে আগের চেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাইমন্ডোর সফরের প্রাক্কালে ফিলিপাইন দুটি কোস্ট গার্ড জাহাজ ও দুটি রসদ জাহাজ চীনের রেন আই ক্লিফে অনুপ্রবেশ করে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে একটি চীনা কোস্ট গার্ড জাহাজকে ধাক্কা দেয়। আর সিএনএন এমন ভুয়া খবর প্রচার করে যে, ফিলিপাইনের জাহাজ চীনের আঘাত শিকার হয়েছে। এবার রাইমন্ডো যুক্তরাষ্ট্র-ফিলিপাইনের জোট ‘অবিনশ্বর’ – এ কথার মধ্য দিয়ে নিজেদের ইন্দো-প্যাসিফিক যুদ্ধ-গাড়িতে ফিলিপাইনকে বাঁধতে চায়।
ফিলিপাইন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বোঝে। তবে তারা এর থেকে কিছু লাভ করতে চায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে চীনের রেন আই ক্লিফ ও হুয়াং ইয়ান দ্বীপ দখল এবং চীনের সেমিকন্ডাক্ট খাতের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দমন নীতি থেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধি। তবে নিজের নয়, এমন জিনিসের প্রতি লোভ করলে শেষে মূল্য দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রাখলে বড় ক্ষতি হতে পারে। (শিশির/রহমান/লিলি)