চীনের দুই অধিবেশন, অর্থাৎ চতুর্দশ জাতীয় গণকংগ্রেস-এনপিসি ও চতুর্দশ জাতীয় গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন-সিপিপিসিসির বার্ষিক অধিবেশন গত ৪ মার্চ বেইজিংয়ে শুরু হয়েছে। আগামী ১১ মার্চ পর্যন্ত চলবে গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি অধিবেশন।
চীনের শীর্ষ আইনসভা এনপিসি ও শীর্ষ পরামর্শসভা সিপিপিসিসির অধিবেশনে অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি ও সামাজিক বিষয়-আশয়সহ চীনের বিগত বছরের সার্বিক কার্যকলাপের পর্যালোচনা এবং আগামী বছরে পার্টি ও সরকারের কার্যক্রম নির্ধারিত হবে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, দেশের প্রেসিডেন্ট ও কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান সি চিন পিংসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাঁচ হাজারের বেশি প্রতিনিধি গুরুত্বপূর্ণ দুটি অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন।
দুই অধিবেশন শুধু চীন নয়, গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চীনকে জানার একটি জানালা হিসেবে বিবেচনা করা হয় দুই অধিবেশকে, বিশেষ করে চীনের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও কূটনৈতিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে গোটা বিশ্ব নজর রাখে দুই অধিবেশনের দিকে।
চীনের এবারের দুই অধিবেশনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে, যা চীনসহ গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং বার্ষিক সরকারি কর্মপ্রতিবেদনে চীনের নতুন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫ শতাংশ ধার্য করার কথা ঘোষণা করেছেন। ২০২৩ সালে চীন ৫.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, যা অর্থনৈতিক মন্দাক্রান্ত বিশ্বে অভাবিত। গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক তৃতীয়ংশই চীনের অবদান। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবে চীনের অর্থনীতি কিছুটা মন্থর হলেও এখনও তা বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হয়ে আছে। চীনের উন্নয়ন বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসবে এবং সার্বিকভাবে বিশ্বে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনবে এটা আশা করা হচ্ছে।
তবে, চীনা নেতারা পরিস্থিতির বিষয়ে সচেতন রয়েছেন। তারা ২০২৪ সালে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিকে উচ্চাভিলাষী মানলেও, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন।
চীনের উচ্চমানের উন্নয়ন ও উন্মুক্তকরণ, চীনা শৈলির আধুনিকীকরণ, গ্রামীণ পুনরুজ্জীবন- এ শব্দবন্ধগুলো এরই মধ্যে চীনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এবারের দুই অধিবেশনে অপেক্ষাকৃত নতুন একটি শব্দবন্ধ জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে, আর সেটি হলো ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি’। খোদ প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চলতি দুই অধিবেশনে এ বিশেষ ধারণাটির ওপর জোর দিয়েছেন।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে হেইলংচিয়াং প্রদেশে সফরের সময় প্রেসিডেন্ট সি প্রথম ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি’র ধারণাটি প্রকাশ করেন। ওই বছরের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক কর্মসম্মেলনে এটি গুরুত্ব পায়। চলতি বছর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রথম গ্রুপ স্টাডির বিষয়বস্তু করা হয় ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি’ – এ ধারণাটিকে।
চলতি দুই অধিবেশনে গত মঙ্গলবার এনপিসি’র দ্বিতীয় অধিবেশনে চিয়াং সু প্রদেশের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সরকারি কার্যবিবরণী নিয়ে একটি পর্যালোচনা বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট সি। সেই বৈঠকে ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি’র প্রসঙ্গটি পুনরায় উত্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট সি বলেন, ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি’র বিকাশ এখন চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান একটি কাজ। নতুন দফা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লব এবং শিল্প সংস্কারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন জোরদার করা, নতুন নতুন শিল্পের বিকাশ, ভবিষ্যৎমুখী শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে চীনের উচ্চমানের উন্নয়কে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট সি এটাও স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি’র উন্নয়ন মানে কিন্তু ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে অবহেলা বা পরিত্যাগ করা নয়। স্থানীয় অবস্থা ও সম্পদ, শিল্পভিত্তির ওপর নির্ভর করেও নতুন গবেষণার মাধ্যমে নতুন পদ্ধতি ও নতুন চালিকাশক্তি বেছে নেওয়া যায় এবং তা উন্নয়ন করা যায়। নতুন প্রযুক্তি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে স্মার্ট ও সবুজ শিল্পে রূপান্তর ও উন্নয়ন খুবই সম্ভব বলে মনে করেন চীনের প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি’র ধারণাটি বলতে আসলে কী বোঝায়?
এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি হলো একটি নতুন ধরনের উৎপাদন শক্তি যা প্রথাগত উৎপাদন শক্তি থেকে আলাদা। এটি উদ্ভাবন ও নতুন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে গড়ে তোলা একটি নতুন উৎপাদন শক্তি।
নতুন প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বলতে উচ্চগতির ইন্টারনেট, বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ইত্যাদি। এআই প্রযুক্তি বা চালকবিহীন প্রযুক্তি, শিল্প উৎপাদন এবং জীবন ধারাকে আগাগোড়া বদলে দিতে পারে। এর সঙ্গে ডিজিটাল অর্থনীতি, স্মার্ট ম্যানুফেকচারিং, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির যোগ চীনের উচ্চমানের উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে পারে।
চীনের দূরদর্শী প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, সংগত কারণেই তাঁর নতুন ধারণা ‘নতুন মানের উৎপাদন শক্তি’র বিকাশকে চীনের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেন।
মাহমুদ হাশিম
বেইজিং।