১৪০ কোটিরও বেশি মানুষকে নিয়ে আধুনিক সমাজের দিকে এগুচ্ছে চীন। চীনা বৈশিষ্ট্যময় এ আধুনিকায়নের পথে কিছু জটিলতা থাকা সত্ত্বেও, বিশ্বের বৃহৎ এ দেশটি সবসময় একটি মৌলিক নীতি পোষণ করে আসছে। আর তা হলো কখনই ‘এক দিকে সমৃদ্ধ শহর, অন্যদিকে বিষণ্ন গ্রাম’ এমনটা হবে না।
তিন বছর আগে চীন বিশ্ব দরবারে ঘোষণা দিয়েছিল, হাজার বছরের চরম দারিদ্র্য নির্মূল করে সার্বিক গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের সূচনা করবে। যা হবে শিল্প, মেধা, সংস্কৃতি, বাস্তুসংস্থান ও সাংগঠনিক পুনরুজ্জীবন। নতুন যুগের গ্রামীণ গল্প বিশাল মাঠে চলছে।
‘পরিবারের সদস্যরা, অর্ডার করার জন্য ধন্যবাদ। পরের বার দেখা হবে।’ মানহো গ্রামের সিপিসি পার্টি শাখার সম্পাদক ও গ্রাম কমিটির পরিচালক ইয়াং কুয়াং লাইভ-স্ট্রিমিং শেষ করলেন এই বলে। ওই স্ট্রিমিংয়ের দুই ঘণ্টার মধ্যেই তিনি তার চাষ করা কালো মাশরুমের ছয়শ’রও বেশি অর্ডার পেয়েছেন। আয় করেছেন হাজার হাজার ইউয়ান।
কয়েক বছর আগেও চিলিন প্রদেশের ওয়াংছিং কাউন্টির অভিবাসীদের একটি গ্রামে আবাদি জমি ছিল না। উন্নয়ন ছিল ধীর। গ্রামটি ছিল পশ্চাৎপদ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় অধিবাসীরা উপযুক্ত জলবায়ু, পানি ও কাঁচামাল কাজে লাগিয়ে, কালো মাশরুম চাষ করতে শুরু করেছেন। এতে করে গ্রামটি ফিরে পেল প্রাণচাঞ্চল্য।
বর্তমানে মানহো গ্রামে কালো মাশরুম প্রক্রিয়াকরণের পাশাপাশি চালু হয়েছে ই-কমার্সে বিক্রির প্রক্রিয়া। চালু হয়েছে কয়েক ডজন থাওপাও দোকান। এখন সেখানে ব্যাগ প্রক্রিয়াকরণ প্রকল্প ও প্যাকিং কারখানা হচ্ছে। এতে করে আরও গ্রামবাসী ফিরে আসছেন তাদের জন্মস্থানে।
গ্রামবাসী হান থিয়েলং বলেন, আগে বাইরে কাজ করে শুধু নিজের খাওয়া-পরাই চলতো। এখন পরিবারের পেছনেই ব্যয় করতে পারছেন লক্ষাধিক টাকা। কারখানার সাবেক এ শ্রমিকের এখন নিজস্ব কালো মাশরুমের প্রকল্প আছে।
হংকংয়ের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকার খবরে জানা গেছে, লক্ষ্য ঠিক করে সে অনুযায়ী দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম এবং উপযুক্ত শিল্প উন্নয়নই হলো গ্রামীণ পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নীতি। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনে ভর্তুকির হার ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। দারিদ্র্যমুক্ত গ্রামগুলোর কল্যাণে এখন তৈরি হয়েছে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় শিল্প।
শানতোং প্রদেশের পিওনি ফুল, দক্ষিণ চিয়াংসি প্রদেশের চা তেল, চিয়াংসু প্রদেশের স্ট্রবেরি, সিনচিয়াংয়ের আপেল ও নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের উৎপাদিত মদ চীনা কৃষকদের সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে গ্রামবাসীর মাথাপিছু আয় ছিল ২১ হাজার ৬৯১ ইউয়ান।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর শাংহাইয়ের একটি ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ওয়াং চিনইউয়ে। সাত বছর আগে তিনি পদত্যাগ করে ফিরে আসেন গ্রামে। এসে গবেষণা শুরু করেন চাষবাস নিয়ে। ওই সময় তার বাবা-মা ও বন্ধুরা বুঝতে পারছিলেন না, ‘কষ্ট করে শহরে গেছে, কেন আবার ফিরে এলো?’
চীনের আছে হাজার বছরের কৃষির ইতিহাস। বিম প্লাউ পদ্ধতিতে হালচাষ থেকে শুরু করে দুচিয়াংইয়ান সেচ ব্যবস্থা ও সংকর ধান—চীনারা সবসময়ই প্রাচীন কৃষিকে শক্তিশালী করতে প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা চালাতে থাকে।
ছোটবেলায় কৃষিকাজ করতেন বলে ওয়াং চিনইউয়ে জানেন এ কাজে কতটা শ্রম দিতে হয়। তাই তার হৃদয়ে কৃষিতে পরিবর্তনের বীজটা রোপিত হয়েছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরেই।
বর্তমানে ওয়াংয়ের খামারে ফাইভ-জি, ছবি সনাক্তকরণ ও বিগ ডেটার মতো প্রযুক্তির মাধ্যমে বুদ্ধিমান রোবটের সহায়তায় কৃষকরা আরও কার্যকরভাবে ও সহজে কাজ করতে পারছেন।
২০২৩ সালে চীনের খাদ্য উৎপাদন নতুন রেকর্ড গড়েছে। ১২ লাখ বর্গকিলোমিটারের আবাদি জমি তো আছেই, সেই সঙ্গে লবণ ও ক্ষারযুক্ত জমিকে চাষের জমিতে পরিণত করার পথও খুঁজতে হবে।
গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনে যোগ দিতে ওয়াং চিনইউয়ে’র মতো মেধাবীদের উৎসাহ দেয় চীন। ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০ লাখ গ্রামীণ প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও ১৫ লাখ মানুষকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষকে দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ।
চীনের আছে একটি গ্রামীণ সংস্কৃতি। এখন ‘নতুন গ্রামীণ সংস্কৃতি’ বড় পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ছোংছিং-এ “গ্রামীণ সিইও”রা ব্যবস্থাপনায় ভালো করছেন। তারা ব্যবসাও ভালো বোঝেন। চীনের শিল্পের উন্নয়ন বেগবান করছেন তারা।
প্রেমা/ফয়সল