পুনরুদ্ধারে পুরানো চলচ্চিত্র পুনর্জন্ম
2024-02-29 10:25:26

দৃশ্যটা অস্পষ্ট এবং শব্দের কম্পন শোনা যাচ্ছে। এমন ধরনের অডিও-ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট অনেক চীনা মানুষের কাছে সিনেমায় প্রথম অভিজ্ঞতা। নির্বাক থেকে সবাক, সাদাকালো থেকে রঙিন, টু-ডি থেকে থ্রি-ডি পর্যন্ত, চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের সাক্ষ্য বহন করে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের শৈল্পিক স্বপ্ন এবং অন্বেষাকে বহন করে।

প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে, হাই-ডেফিনেশন ডিজিটাল ফরম্যাটের চলচ্চিত্র জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং চলচ্চিত্রগুলো ধীরে ধীরে ইতিহাসের মঞ্চ থেকে বের হয়েছে। সময়ের সাক্ষ্য বহনকারী চলচ্চিত্র একটি ‘পুনর্জন্মে’র মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

গত শতাব্দীর শুরু থেকে হংকং দশ হাজারেরও বেশি চলচ্চিত্র তৈরি করেছে এবং ‘ওরিয়েন্টাল হলিউডে’র খ্যাতি লাভ করেছে বছরের পর বছর ধরে, হংকং ফিল্ম আর্কাইভ হংকংয়ের চলচ্চিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে। বিভিন্ন অঞ্চলের পুরানো প্রেক্ষাগৃহ থেকে দীর্ঘদিন ধরে হারিয়ে যাওয়া পুরানো ফিল্ম রিল সংগ্রহ করে, পুনরুদ্ধার করে এবং সংরক্ষণ করে হংকং ফিল্ম আর্কাইভ।

বর্তমানে হংকং ফিল্ম আর্কাইভে প্রায় চার হাজার ফিল্ম রিল সংরক্ষিত আছে। আর্কাইভের পুনরুদ্ধারকারী দলকে চিকিৎসা কর্মীদের মতো ফিল্ম রিলগুলোর ভালো যত্ন নিতে হয়, ধৈর্য সহকারে ফিল্মটির প্রতিটি ফ্রেম দেখতে ও মেরামত করতে হয় এবং তাদের আয়ুষ্কাল বাড়ানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হয়।

 

হংকং ফিল্ম আর্কাইভের সহকারী পরিচালক লাও ছিমিং ১৬ বছর ধরে ফিল্ম পুনরুদ্ধারের কাজে নিয়োজিত আছেন। তিনি দেখেছেন যে, অগণিত স্ক্র্যাচে পূর্ণ ফিল্মগুলো পুনরুদ্ধার করার পর আবার প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়। তিনি বলেন, ‘এই কাজটি হলো দু’হাত দিয়ে সময়ের আলো ও ছায়াকে পুনরায় তৈরি করা।’

ফিল্ম পুনরুদ্ধার একটি পেশাদার এবং জটিল কাজ, যার জন্য শারীরিক পুনরুদ্ধার, ডিজিটাল পুনরুদ্ধার, শৈল্পিক পুনরুদ্ধার এবং সিন্থেটিক পলিশিং, এ চারটি ধাপ প্রয়োজন। একটি পুরানো চলচ্চিত্রের জন্য, পুনরুদ্ধার রুম থেকে বড় পর্দায় যেতে এটি ধারনার চেয়ে অনেক বেশি অসুবিধার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

লাও ছিমিং স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘অ্যা পেজ অফ হিস্ট্রি’ শিরোনামে ম্যুভিটি পুনরুদ্ধারের সময় পরিচালক লি মিনওয়েইয়ের বংশধররা পুনরুদ্ধারকারী দলকে দুটি সংস্করণ দিয়েছেন, একটি হলো স্বল্প দৈর্ঘ্যের এবং এর ছবির মান ভালো, আরেকটি হলো লম্বা সংস্করণ এবং এর দৃশ্য অস্পষ্ট। পুনরুদ্ধারকারী দলকে লম্বা দৈর্ঘ্যের সংস্করণে অস্পষ্ট অংশগুলো পরিবর্তন করার জন্য স্বল্প দৈর্ঘ্যের অংশগুলো লম্বা সংস্করণে যুক্ত করতে হয়। এই কাজ সম্পন্ন করতে ফিল্মের ফ্রেমের দুটি রোল তুলনা করা এবং ফ্রেমে ফ্রেমে খাপ খাওয়ানো প্রয়োজন। পুনরুদ্ধারকারী দল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ফুট ফিল্ম দেখেছেন।

ফিল্মের রাসায়নিক এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে তার স্টোরেজ পরিবেশ ভালো হওয়া প্রয়োজন। লাও ছিমিং বলেছেন যে, হংকং-এর গরম এবং আর্দ্র জলবায়ুর কারণে যদি ফিল্মটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হয়, তাহলে ফিল্মটি বিবর্ণ, সঙ্কুচিত বা এমনকি আর্দ্রতার কারণে বিকৃত হয়ে যাবে, অবশেষে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করা যাবে না। তাই হংকং ফিল্ম আর্কাইভ ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে একটি রেফ্রিজারেটেড স্টোরেজ রুম স্থাপন করেছে এবং ফিল্মটির ক্ষতি কমাতে রুমটির ৩০ বা ৪০ শতাংশের আপেক্ষিক আর্দ্রতা রয়েছে।

একটি ফিল্ম পুনরুদ্ধার করতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। লাও ছিমিং বলেছেন যে, পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে পুরানো চলচ্চিত্রগুলোকে সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করা, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রাখা যাওয়া এবং সাংস্কৃতিক মূল্যকে আরও দীর্ঘায়িত করা হলো পুনরুদ্ধারকারী দলের অভিন্ন লক্ষ্য।

ফিল্ম পুনরুদ্ধার রুমের দরজার দু’পাশে বড় বা ছোট ফিল্মগুলো রাখা শত শত গোলাকার লোহার বাক্সে জমা রাখা হয়।

‘পুরোনোকে আগের মতো পুনরুদ্ধার করা এবং মূলকে সম্মান করা’ হল চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধারে সর্বদা অনুসরণীয় নীতি। চলচ্চিত্রের উপাদানের মৌলিকতা এবং স্বাতন্ত্রকে সম্মান করে  এবং নির্মাতাদের আসল উদ্দেশ্য পুনরুদ্ধার করা উচিত্, যাতে প্রত্যেক চলচ্চিত্রের শৈল্পিক নান্দনিক এবং আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যকে তুলে ধরা যায়।

উ হোং সিয়োং নামে একজন ম্যুভি পুনরুদ্ধারকারী টানা ৩০ বছর ধরে এ কাজ করে আসছেন। তিনি মনে করেন, ‘চলচ্চিত্রগুলো একটি যুগের সাংস্কৃতিক অনুভূতি এবং স্মৃতি সংরক্ষণ করে এবং এটি মূল্যবান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ফিল্ম পুনরুদ্ধার করে ক্লাসিক পুরানো সিনেমাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা খুব অর্থপূর্ণ।’

হংকং ফিল্ম আর্কাইভ ২০১১ সাল থেকে ফিল্মগুলো পুনরুদ্ধার করতে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। পুনরুদ্ধারকারীদের বারবার একই কাজ করা থেকে মুক্ত করে দিয়েছে এই প্রযুক্তি। অন্যদিকে, কিছু ধারণা যা একসময় ভাবাই যেতো না, সে ধারণাগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত হয়ে ওঠে।

 

লাও ছিমিং বলেছেন যে, ফিল্মে গর্ত থাকলে সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার সময় ফ্রেমের ক্ষতি হয়ে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অতীতে এ অবস্থার কোনো সমাধান হতো না। কিন্তু এখন পুনরুদ্ধারকারীরা ডিজিটাল ওয়ার্কস্টেশনগুলোতে সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে অনুরূপ দৃশ্যগুলো সংগ্রহ করতে এবং অনুপস্থিত চিত্রগুলো পূরণ করতে পারেন। সামঞ্জস্য বিধান করার পরে ম্যুভি’র চিত্রগুলো প্রায় সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার করা যায়।

এআই প্রযুক্তি ফিল্ম পুনরুদ্ধারের দ্রুত বিকাশেও সহায়ক হয়েছে। লাও ছিমিং বলেছেন যে, প্রযুক্তিগত পুনরুদ্ধার পুনরুদ্ধারের কার্যকারিতা এবং প্রভাবকে ব্যাপকভাবে উন্নত করতে পারে। তবে এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ফিল্মের ক্ষতি করতে পারে। অনেক ক্ল্যাসিক ফিল্মের সুক্ষ্ম পুনরুদ্ধার ডিজিটাল পুনরুদ্ধার এবং ম্যানুয়াল পুনরুদ্ধারের একটি নিখুঁত সংমিশ্রণ বলে তিনি মনে করেন।

চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধার শিল্প রিলের মতো উত্তরাধিকারের একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। লাও ছিমিং সাংবাদিকদের বলেন যে, বর্তমানে হংকংয়ে ফিল্ম রিস্টোরেশনসহ এ সম্পর্কিত কোর্স কোনো স্কুল নেই। ফিল্ম আর্কাইভে কাজ করতে আসা নতুন পুনরুদ্ধারকারীরা মূলত ‘মাস্টার-শিক্ষার্থী সিস্টেম’ এর মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

ফিল্ম পুনরুদ্ধার রুমের দরজায় একটি পোস্টার লাগানো আছে, যেটি ২০০৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম আর্কাইভসের উদ্যোগে প্রস্তাবিত স্লোগান: চলচ্চিত্রটি ত্যাগ করবেন না, এটি চিরকাল থাকবে, একে ধ্বংস করবেন না।’

লাও ছিমিং বলেন, ‘চলচ্চিত্র সময়ের অনুভূতি এবং সাংস্কৃতিক স্মৃতি সংরক্ষণ করে। এক একটি চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে মূল্যবান চলচ্চিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নতুন যুগে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।

লিলি/হাশিম