চীনের প্রাথমিক ও মাধ্যমকি স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা
2024-02-26 18:03:45

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের বিভিন্ন এলাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষাদানের বার্ষিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করেছে এবং ধীরে ধীরে শিক্ষকদের প্রত্যাহারের ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। এভাবে চীনা শিক্ষকদের গুণগতমান আরো উন্নত করা যায় এবং শিক্ষকতার মানও উন্নীত করা যায়। এ সম্পর্কে চীনের নেটিজনরা মনে করেন, বিস্তারিত ও কঠোর মূল্যায়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষকদের কাজের মান ও নিবেদিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়, বিশেষ করে চীন সরকার শিক্ষকদের মাসিক বেতন ও ভর্তুকি বাড়িয়ে দেওয়ার পর এমন উদ্যোগ অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু শিক্ষক মনে করেন, এখন স্কুলের শিক্ষকদের কাজের পরিমাণ অতীতকালের চেয়ে অনেক বেড়েছে এবং এখন তাদের কাজের চাপ অনেক বেশি।

 

বস্তুত ‘চীনের দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাদানের সংস্কার ও উন্নন কর্মপরিকল্পনা ২০১০-২০২০’এ বলা হয়েছে, চীনের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষকদের প্রশাসনিক কাজের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং অদক্ষ শিক্ষকদের প্রত্যাহার করা জরুরি। ২০১৮ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের প্রকাশিত নতুন যুগে চীনা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সংস্কার পরামর্শে বলা হয়েছে, শিক্ষকদের যোগ্যতার নিয়মিত নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। অযোগ্যদের প্রত্যাহার চীনা শিক্ষকদের কর্মদক্ষতা ও প্রাণশক্তির উন্নয়নে সহায়ক।

 

তাহলে, কেন শিক্ষকদের প্রত্যাহার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, এ ব্যবস্থার বাস্তবায়নে কী কী মানদণ্ড নির্ধারণ করা প্রয়োজন? এ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নিতে আর কী কী সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার?

 

আজকের অনুষ্ঠানে এ বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করবো।

গত কয়েক বছরে চীন সরকার শিক্ষাখাতে ব্যাপক সংস্কার চালু করেছে এবং শিক্ষাদানের মান উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের কর্মদক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকার শিক্ষকদের বেতনের ব্যবধান কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়ছে। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত এলাকায় শিক্ষকদের বেতন ও ভর্তুকি বাড়িয়ে দিতে সুবিধাজনক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের পদোন্নতিতে যাচাই মানদণ্ড ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

তবে কিছু শিক্ষক কর্মযোগ্যতার স্বীকৃতি পেয়ে কাজে অনাগ্রহী হয়েছেন, বিশেষ করে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর স্কুলের গ্রন্থাগারে কাজ করতে আবেদন করেন। এভাবে তাদের মাসিক বেতন প্রায় সমান থাকে, তবে দায়িত্ব ও কাজের চাপ অনেক কম হয়। যদিও এমন শিক্ষকের পরিমাণ খুবই কম, তবে অল্প হলেও তা শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় চীন সরকার অযোগ্য শিক্ষকদের প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিয়েছে। তাছাড়া, কিছু কিছু শিক্ষক দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে সময় মতো শিক্ষকতার কাজ করতে পারেন না। এমন শিক্ষকদের জন্য প্রত্যাহার ব্যবস্থায় তাদের দ্রুত অবসর নেওয়ার জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়।

 

উদাহরণ দিয়ে বলি, চীনের নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে প্রচুর শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষক থেকে সরকারি শিক্ষক হবার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে বয়স্ক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল। তাই ২০১১ সাল থেকে এমন শিক্ষকদের প্রত্যাহার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। যাদের শরীরিক অবস্থা দুর্বল এবং অবসরের বয়সের আগে অবসর নিতে চান, তাদের জন্য প্রত্যাহার ব্যবস্থা বেশ কার্যকর হয়। তারা অবসরে যাবার পর আরো বেশি যুব শিক্ষক চাকরির আবেদন করতে পারেন।

এ সম্পর্কে চীনের শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণাগারের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সংস্কার বিভাগের প্রধান ওয়াং ফেং বলেন, ‘বর্তমানে বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে সরকারি শিক্ষকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, তাই অনেক স্কুলে অস্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। যদি অযোগ্য শিক্ষক, সরকারি শিক্ষক হয়ে সুবিধা অধিকার করে, তাহলে সেটা দক্ষ, অস্থায়ী শিক্ষকদের জন্য ন্যায্য হয় না। তাই অযোগ্য শিক্ষকদের প্রত্যাহার ব্যবস্থার চালু করা প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের শিক্ষাদান গুণগতমান উন্নয়নের পর্যায়ে রূপান্তর করা হয়েছে, তাই চীনারা শিক্ষাদানের মানের প্রতি আশাবাদও বেড়েছে। ইস্ট চায়না নর্মাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ওয়াং ইয়ান লিং বলেন, ‘গত কয়েক বছরে চীনের উচ্চ বিদ্যালয়ে কোর্স চালু এবং ক্লাসের মানদণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয় সংশোধন করা হয়েছে। এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষকদের কর্মদক্ষতার মান  উন্নীত করতে হয়। যদি শিক্ষকরা অতীতকালের মতো কাজ করেন, তাহলে তাদের শিক্ষাদানের মান ও ফলাফলে সন্তুষ্ট হবার সুযোগ নেই এবং শিক্ষার সংস্কারের উদ্দেশ্যও বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

বস্তুত এ ব্যবস্থা প্রণয়ন থেকে বোঝা যায়, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার বিষয়ে জনগণের অনেক আশাবাদ রয়েছে। তাই চীনা শিক্ষকদের কর্মদক্ষতার উন্নয়ন এবং ভালো করে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় আর উচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করা হয়েছে।

 

গত ১০ বছরের মধ্যে চীনের বিভিন্ন এলাকা ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের প্রত্যাহার ব্যবস্থা নিয়ে কিছু পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এ ব্যবস্থার বাস্তবায়নে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষক প্রত্যাহার ব্যবস্থায় মোট দুই ধরনের শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। এক দল শারীরিক দুর্বলতার কারণে শিক্ষাদানের কাজ আর করতে পারে না এবং আরেক দল শিক্ষকতার কর্মদক্ষতায় দুর্বল।

তবে সংশ্লিষ্ট পর্যালোচনা ব্যবস্থায় বিস্তারিত নীতিমালা পূরণ করা হয়নি। যদি কেবল একটি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল বা স্কোর বা র‌্যাঙ্কিংসহ বিভিন্ন সূচক দিয়ে শিক্ষকদের কর্মদক্ষতা পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে শিক্ষকরা শুধু ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নজর রাখবেন। এটি শিক্ষার্থীদের বহুমুখী দক্ষতার উন্নয়নে সহায়ক নয়।

 

এ ছাড়া কিছু কিছু বয়স্ক শিক্ষক, যারা যুবকাল থেকে শিক্ষাদানে অনেক অবদান রেখেছেন, কিন্তু বয়স্ক হওয়ার কারণে শিক্ষাদানের দ্রুত সংস্কারের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি, এমন শিক্ষকরা যদি পর্যালোচনা ব্যবস্থায় বেকার হন, তাহলে সকল সিনিয়র শিক্ষকরা দুঃখ পাবেন, সেটি নবীন শিক্ষকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই শিক্ষকদের প্রত্যাহার ব্যবস্থার কার্যকরিতা আরো বিস্তারিত অবস্থা অনুসারে বিবেচনা করা উচিত।

যেমন ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় শিক্ষকদের প্রত্যাহার ব্যবস্থার মানদণ্ডও ভিন্ন, যা স্থানীয় অঞ্চলের শিক্ষার অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে হয়। উন্নত এলাকায় শিক্ষকদের সংখ্যা বেশি, তাই শিক্ষকদের প্রত্যাহার ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রতিযোগিতার চেতনা সৃষ্টি হয়, যা শিক্ষাদানের মানের উন্নয়নে সহায়ক। তবে শিক্ষায় অনুন্নত এলাকায় শিক্ষকের অভাব দেখা দেয় এবং শিক্ষার ভারসাম্যহীনতা আরো গুরুতর হয়ে যাবে।

তাই শিক্ষকদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে উৎসাহ দেওয়া এবং শিক্ষাদানের মান উন্নীত করা সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার। শিক্ষকদের প্রত্যাহার ব্যবস্থা এর মধ্যে শুধু  একটি পদ্ধতি। শিক্ষকদের বেতন ও ভর্তুকি ব্যবস্থা, নিয়োগ ব্যবস্থা, পর্যালোচনা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন দিক থেকে শিক্ষকদের কর্মদক্ষতা উন্নয়নে উৎসাহী করে তোলা সম্ভব। যাদের কর্মদক্ষতা দুর্বল, তাদের যদি শিক্ষক পদ ছেড়ে যেতে হয়, তাহলে তাদের কর্মদক্ষতার উন্নয়নে কিছু সহায়তাও দেওয়া উচিত। অন্য দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অদক্ষতার কারণ কোনো শিক্ষককে শিক্ষকতা ছাড়তে হলে তিনি কর্মদক্ষতার উন্নয়নে আরো নতুন প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন।

(সুবর্ণা/হাশিম/মুক্তা)