বিজ্ঞানবিশ্ব ৫৯তম পর্ব
2024-02-26 19:16:06

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৫৯তম পর্বে যা থাকছে:

 

* রোবট করছে কৃষিকাজ

* ভবিষ্যতের আরভি আনছে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান

* খনি শনাক্তে মিউয়ন ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করছে চীন

 

 

রোবট করছে কৃষিকাজ

দীর্ঘদিন ধরে গরু, লাঙ্গল আর কায়িক পরিশ্রমে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল গ্রামীণ কৃষিকাজ। এখন সেখনে কৃষকদের কষ্ট কমাতে এসেছে রোবট। এসেছে অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তিও। আর এসবের হাত ধরে চীনের কৃষিখাত এসেছে অভাবনীয় সব পরিবর্তন।

সম্প্রতি চীনের শাংহাইয়ের তিয়ানথিয়ান খামারে দেখা গেছে এমন পরিবর্তন। খামারটিতে প্রায় সব ধরনের কাজ করা হচ্ছে রোবটের সাহায্যে।

কৃষিতে ব্যবহৃত এ রোবটগুলোকে রিমোট কন্ট্রোলারের সাহায্যে নির্ভুলভাবে পরিচালনা করছেন প্রকৌশলী লি ওয়েই। শাংহাইয়ের তিয়ানথিয়ান খামারে কাজ করা এমন ৭০ জনেরও বেশি প্রকৌশলী রয়েছেন। খামারটি প্রধান ফসল হলো ধান।

এ প্রকৌশলীরা গত সাত বছরে কৃষি রোবটের উদ্ভাবন ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করেছেন। এই সময়ে ৬০টিরও বেশি ধরনের কৃষি রোবট তৈরি করেছেন তারা। রোবটগুলো বীজ রোপণ থেকে শুরু করে ফসল কাটার কাজও করছে।

চাকায় ভর করে রোবটগুলো এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাচ্ছে এবং নানা ধরনের উঁচুনিচু ভূমিতেও দক্ষতার সঙ্গে চলাচল করছে। রোবটগুলোর অপারেটিং সিস্টেমে দেওয়া হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যা তাদের চলাফেরাকে করেছে স্বয়ংক্রিয় এবং তাদের কাজকর্ম দেখতে অনেকটা মানুষ-কৃষকের মতোই।

 

রোবটগুলো পরিচালনার জন্য কৃষকদেরও খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। তাদের মোবাইল ফোনে থাকা উইচ্যাট মিনি প্রোগ্রামের মাধ্যমে লগইন করতে হয়। এরপর রোবটগুলোকে শুধু চালু করলেই তারা কাজ করতে শুরু করে।

তিয়ানথিয়ান খামারের কৃষি সমবায়ের প্রধান ওয়াং চিনইয়ু জানান, তিনি গ্রামাঞ্চলে বড় হয়েছেন এবং তিনি জানেন খামারের কাজ অত্যন্ত ক্লান্তিকর। তার খামারের কাজে সহায়তা করছে কয়েকটি রোবট। এগুলো কাজ করে চলেছে কান্তিহীন।

ফাইভ-জি প্রযুক্তির সাহায্যে ছবি শনাক্তকরণ ও বড় তথ্য কেন্দ্র ব্যবহার করে রোবটগুলো দ্রুত ফসলের মাঝে নানা ধরনের দূরত্ব নির্ণয় করতে পারে। পাশপাশি ফসল তোলার উপযোগী হলে মধ্যে ফসল কাটা শুরু করতে পারে কয়েক সেকেন্ডেই।

শুধু ফসল কাটাই নয়। আগাছা সরানো, পরিচর্য়া, এমনকি ঘাস ও ফসলের পার্থক্যও চিনতে পারে বুদ্ধিমান রোবটগুলো। একবার চার্জ দিলে টানা আধাঘণ্টা আগাছা পরিষ্কার করতে পারে এ রোবটগুলো।

তিয়ানথিয়ান ফার্মের কৃষি রোবটগুলো চীনের বেইতৌ নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম (বিডিএস) এর সঙ্গে যুক্ত। এখন চীনের এক লাখেরও বেশি কৃষি যন্ত্রপাতির স্বয়ংক্রিয় পরিচালনার জন্য এই স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভর করছে।

অন্যদিকে, চীনের শায়ানসি প্রদেশের হ্যানচৌয়েও স্মার্ট যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে চলছে চাষাবাদ। এতেও ব্যয় কমেছে চাষের। প্রদেশটিতে একটি স্বয়ংক্রিয় সবজি খামার আছে। ১৩ হেক্টরের ওই খামারে সবজি চাষে নিয়োজিত আছে মাত্র পাঁচ জন কৃষক। বাকি সব কাজই করছে রোবট।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

 

 

ভবিষ্যতের আরভি আনছে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান

ভবিষ্যতের রিক্রিয়েশনাল ভেহিক্যাল তথা আরভি তৈরিতে চীনের খুদে হোটেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েইসুর সঙ্গে জোট বেঁধেছে দেশটির শীর্ষ প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা হুয়াওয়েই। দুটি প্রতিষ্ঠান মিলে অচিরেই নিয়ে আসতে যাচ্ছে আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন আরভি গাড়ি।

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সম্পন্ন এ আরভিতে থাকবে নানা হাই-টেক বৈশিষ্ট্য। এটি পরিচালিত হবে হুয়াওয়েইর তৈরি হারমোনি ও এস-৪ অপারেটিং সিস্টেমে। বুদ্ধিমান এ আরভিতে বসবাসকারীদের হাতে থাকবে অন্দরমহলের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ।

ওয়েইসুর প্রতিষ্ঠাতা ওয়াং শুয়াইবিন জানালেন, গাড়ির জন্য হুয়াওয়েই যে প্রযুক্তি তৈরি করেছে সেটার সঙ্গে ওয়েইসুর মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশনের সমন্বয়ে এই স্মার্ট ঘরের সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে দূর থেকেই।

এ ছাড়া, এ ঘরটির বিদ্যুতের যোগান আসছে সৌরশক্তি থেকে। চার্জ হওয়ার সময় গাড়িটির ছাদ থেকে ডানা মেলে দেয় সোলার প্যানেল।

…….

অন্যদিকে, চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের চাংচৌ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি কনক্রিট ঢালাইয়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় প্লান্টটির ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ।

এ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে চীনের তৈরি হুয়ালং-ওয়ান নামের তৃতীয় প্রজন্মের নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর। বিশ্বে এ ধরনের নিউক্লিয়ার পাওয়ার মডেলগুলোর মধ্যে চীনের তৈরি এ রিয়েক্টরটি আছে প্রথম সারিতে।

চাংচৌ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ধাপে তৈরি হবে ৩ ও ৪ নং ইউনিট। পরের ইউনিটের কাজ এই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগে এ দুটি ইউনিট যথাক্রমে ২০২৮ ও ২০২৯ সালে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চীনের জাতীয় নিউক্লিয়ার কর্পোরেশনের অধীনে থাকা চাংচৌ এনার্জি কোম্পানির ব্যবস্থাপক চৌউ তেলিন জানান, প্রথম ধাপের নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই দ্বিতীয় ধাপের নকশা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ প্লান্টের নকশার উন্নয়নে আনা হয়েছে ৩০টি পরিবর্তন। আর এ কাজে নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

চাংচৌ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি ছয়টি ইউনিটের সমন্বয়ে তৈরি হবে। যার প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১০ লাখ কিলোওয়াট। মোট ক্ষমতা হবে ৭২ লাখ কিলোওয়াট পর্যন্ত। চালু হওয়ার পর বছরে এ কেন্দ্রের উৎপাদন দাঁড়াবে ৫৮ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা।

 

|| প্রতিবেদন: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

খনি শনাক্তে মিউয়ন ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করছে চীন

খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বছরে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে। আবার অনেক দেশের এত অর্থ নেই যে তারা নিজ দেশের খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান করবে। বিষয়টি যেমন জটিল তেমনি ব্যয়সাপেক্ষ। জটিল এ কাজটি সহজ করতেই নতুন এক প্রযুক্তি নিয়ে এসেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা।

প্রযুক্তির নাম মিউয়ন ইমেজিং। আর এটি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান ও কাঠামো নির্ণয়ে সফল হয়েছেন চীনা গবেষকদের একটি দল। খনিজ অনুসন্ধান এবং ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর গঠন নির্ণয়ে এটি একেবারেই নতুন পদ্ধতি। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল জিওফিজিক্যাল জার্নাল ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত হয়।

ভূগর্ভস্থ খনিজের গঠন, আকার এবং এর সঠিক অবস্থান নির্ণয় খনি শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে খনিজ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে যেসব কৌশল ব্যবহার করা হতো সেগুলো ছিল উচ্চ ব্যয় সম্পন্ন এবং তুলনামূলক কম নির্ভুল। তবে নতুন এই প্রযুক্তি খনিতে অনুসন্ধান ও ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর ছবি তোলার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

ল্যানচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রযুক্তিটির বিকাশ ঘটিয়েছেন। গবেষণা দলের প্রধান এবং ল্যানচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিউ চি-ই জানান, মিউয়ন হলো লেপটন গ্রুপের মৌলিক কণা, যা অনেক গভীরে কঠিন বস্তু ভেদ করে যেতে পারে। যে কারণে এটি কার্যকর, নির্ভুল ও পরিবেশবান্ধব।

গবেষণা দলটি বড় কোনও বস্তুর ইমেজ বা ছবি পাওয়ার ক্ষেত্রে মিউয়নগুলোকে শনাক্তকারী রশ্মি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এতে স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে খনিজের অবস্থান ও আকার সম্পর্কে জানা যায় এবং এ প্রক্রিয়ায় খরচ ও ঝুঁকি দুটোই কমে আসে।

ইতোমধ্যেই উত্তর-পশ্চিম চীনের কানসু প্রদেশের একটি স্বর্ণ খনিতে এই প্রযুক্তিটি প্রয়োগ করে সফল হয়েছেন।

প্রথাগত অনুসন্ধান পদ্ধতি যেমন ব্যাচ গ্রাউন্ড ড্রিলিং বা বিস্ফোরক ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতি হয়। অনেক সময় খনিটাও ঝুঁকিতে পড়ে। মিউয়ন বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ছবি তোলা হলে তাতে পরিবেশ ও প্রকৃতির কোনো ক্ষতিই হবে না। হবে না কোনো দূষণও।

 

ল্যানচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিউ চুনথাও জানান, স্বর্ণ খনিতে অনুসন্ধানের সময় দলটি ছয় সেট সরঞ্জাম ব্যবহার করে সোনার খনিটির একটি বড় এলাকা স্ক্যান করেছে এবং উল্লেখযোগ্য ফলাফল দিয়েছে।

নতুন এই প্রযুক্তিটি খনিজ অনুসন্ধান, ভূতাত্ত্বিক কাঠামো ইমেজিং, ভূগর্ভস্থ স্থাপত্য এবং সুড়ঙ্গ পর্যবেক্ষণ অভ্যন্তরীণ অংশ পর্যবেক্ষণ সম্ভব হবে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী