চেচিয়াংয়ের লিশুই প্রাচীণ গ্রামের পর্যটন সম্পদ
2024-02-24 18:24:42

গত ২০ বছরে চীনে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে এবং কোনো কোনো গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নগরে গিয়ে কাজ করছে। এর ফলে গ্রামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক গ্রামের ঘরবাড়ির করুণ হাল। গ্রামীণ সংস্কৃতি ও রীতিনীতিও হারিয়ে যেতে বসেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন এবং গ্রাম পুনরুদ্ধারের জন্য চীনের বিভিন্ন এলাকায় সংস্কৃতি সুরক্ষা, প্রকৃতি পুনরুদ্ধার, ঐতিহ্যগত পর্যটন উন্নয়নসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। চেচিয়াং প্রদেশের লিশুই'র সিয়ানানশান তেননি একটি গ্রাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমি সিয়ানান গ্রামের প্রায়া-হারানো-ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার গল্প বলব।

এখানকার ঘরগুলোর প্রাচীর হলুদ কাদায় তৈরি। এগুলোর ছাদ নীল। পাহাড়ের পাদদেশে এসব ঘরের অবস্থান। কাছাকাছি আছে সবুজ বন। শান্ত ও সুন্দর গ্রাম। এ-গ্রামটিই সিয়ানানশান। দূর থেকে গ্রামটির দৃশ্য প্রাচীন কবির কবিতায় বর্ণিত দৃশ্যের মতো। কিন্তু গ্রামের ভেতরে দেখা যায় ভিন্ন দৃশ্য।

সিয়ানানশান গ্রাম চেচিয়াং প্রদেশের লিশুই শহরের লিয়ানদু জেলার বিহু থানায় অবস্থিত। গ্রামটি চীনের মিং রাজবংশ আমলে প্রায় চার শ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। গোটা গ্রামটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। গ্রামটিতে বর্তমানে ৪০টিরও বেশি প্রাচীন গৃহ রয়েছে। সবচেয়ে পুরাতন গৃহটি ৪ শতাধিক বছরের পুরাতন। কয়েক বছর আগে এসব প্রাচীন গৃহ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। সিয়ানানশান গ্রামের বাসিন্দা উ জু ছেং তখনকার কথা স্মরণ করে বলেন,

'২০০৪ ও ২০০৫ সালে এখানে অনেক প্রাচীন ঘর ছিল। সেগুলো ছিল বসবাসের অযোগ্য।'

উ জু ছেং বলেন, দশ বছর আগে গ্রামবাসীরা সরকারি উদ্যোগের কারণে ধনী স্বচ্ছলতার মুখ দেখেন। তখন তারা পুরাতন ঘর ছেড়ে পাহাড়ের নিচে নতুন নির্মিত গৃহে স্থানান্তরিত হন।

কিন্তু সিয়ানানশান গ্রামের সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্যময় প্রাকৃতিক দৃশ্য সুরক্ষার জন্য স্থানীয় সরকার গ্রামটি শহর পর্যায়ের সুরক্ষিত সাংস্কৃতিক অবকাশ ইউনিটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। পৃথকভাবে গ্রামটির মেরামতকাজ করা হয়। কিন্তু কোনো মানুষ গ্রামে বসবাস করতেন না।

২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার গ্রামীণ অবসর শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত লিয়ানচং গ্রুপের সঙ্গে সহযোগিতা করে 'সরকার ও প্রতিষ্ঠান' কাঠামোয় 'হুয়ানথিং-সিয়ানানশান প্রাকৃতিক পর্যটন গ্রাম' নামের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। এ-পরিকল্পনার উদ্দেশ্য প্রাচীন গ্রাম সুরক্ষা, উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার। লিয়ানচং গ্রুপের চেয়ারম্যান ইউ স্যুয়ে বিন মনে করেন, বর্তমানে শহরের বাসিন্দারা গ্রামীণ পর্যটনের ব্যাপারে আগ্রহী। প্রাচীন ঘর-বাড়ি আসলে খুবই মুল্যবান। ঐতিহ্যবাহী গ্রামগুলো পর্যটনসম্পদ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, "পর্যটন-ব্যবসা শুরু করার আগে এখানে কোনো বাসিন্দা ছিল না। বাসিন্দারা নতুন গ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছিল। কোনো কোনো গৃহ অবহেলায় পড়ে ছিল। ২০১৬ সালে আমরা গোটা গ্রামটি আগের মতো সাজিয়ে তুলি।"

ইউ স্যুয়ে বিন বলেন, গ্রামটির প্রাচীন দৃশ্য পরিবর্তন না-করার জন্য সংস্কারের সময় স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে।

বর্তমানে সিয়ানানশান গ্রামের ৪০টিরও বেশি প্রাচীন গৃহ আগের মতো করে সাজানো হয়েছে। এ ছাড়া, এখানে হোটেল, গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান, নবায়ন ও উদ্ভাবন চিত্রশালা, বইয়ের দোকান ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়েছে। আধুনিকতার সঙ্গে মিশেছে প্রাচীন ঐতিহ্য।

বর্তমানে উজ্জীবিত এই প্রাচীণ গ্রাম ব্যাপক পর্যটককে আকর্ষণ করছে। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে পর্যটন-ব্যবসা শুরুর পর থেকে গ্রামটিতে পর্যটক এসেছে এক লাখেরও বেশি এবং এ-থেকে আয় হয়েছে ২৭ লাখ ইউয়ান আরএমবি'রও বেশি। ইউ স্যুয়ে বিন বলেন, পর্যটনশিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনের টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "গ্রামের পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। গ্রামবাসীদের প্রতিবছর অর্থ দেওয়া হয়। আমাদের হোটেল ও রেস্তরাঁর খাবারের কাঁচামাল স্থানীয়দের কাছ থেকেই ক্রয় করা হয়। এটিও তাঁদের আরেকটি আয়ের উত্স।"

গ্রামবাসী উ জুন ছেং এ-পরিবর্তন অনুভব করেন। বর্তমানে তিনি গ্রামে উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছেন। তিনি আগের মতো বাইরে কাজ খোঁজেন না। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "নিজের গ্রামের উদ্যান সংরক্ষণ, সবুজীকরণ, পানি ঢালা, ঘাস তোলা ইত্যাদি কাজ করলে আমার প্রতিমাসে আয় হয় প্রায় ৩ হাজার ইউয়ান। আগে আমি ফুল চাষ করতাম; সময় পেলে কিছু পার্ট টাইম কাজ করতাম। কিন্তু পার্ট টাইম কাজ করার জায়গা নিজের বাড়ি থেকে অনেক দূর। আমার অনেক অসুবিধা ছিল।"

উ জু ছেং বলেন, লিয়ানচং গ্রুপ তার পুরাতন ঘর মেরামত করেছে। প্রতিবছ গ্রুপটি তাকে ভাড়া দেয় এবং তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছে। তিনি আরও বলেন, "আমার ঘর এখন একটি কফি শপ। আমার ঘরের বয়স শতাধিক বছর। আমার অনেক আত্মীয় ও বন্ধু আমাকে হিংসা করে। আমার বড় বোনের এখন ৭২ বছর বয়স। তিনি বলেন, যদি আগে জানতাম আমাদের গ্রামটি এতো সুন্দর হবে, তাহলে আমি অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হতাম না।"

লিয়ানদু জেলার কৃষি কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শাং চুও ফাং বলেন, "সিয়ানানশান গ্রামের বাসিন্দারা তাদের ভূমি ও গৃহ ব্যবহার অধিকার আমাদের দিয়েছে এবং আমরা পর্যটন-ব্যবসা চালাই। আমাদের সহযোগিতাচুক্তির মেয়াদ ৩১ বছর। প্রতিবছর আমরা গ্রামবাসীদের নির্ধারিত মুনাফা দিয়ে থাকি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ গ্রামবাসীকে মুনাফা দেওয়া হয়েছে।"

তিনি আরও বলেন, "আমরা গ্রামের ঘর ভাড়া করি। আয়ের একটা অংশ বাসিন্দাদের দেওয়া হয়। এখন আমরা গ্রামটির পরিচালনা, অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা করছি। এর মাধ্যমে গ্রামবাসীরা নিয়মিত আয় করতে পারছে।"

শাং জুও ফাং বলেন, সিয়ানানশান গ্রাম ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা চীনের অন্যান্য ঐতিহ্যগত গ্রামের সুরক্ষা ও উন্নয়নেও কাজে লাগতে পারে। ভবিষ্যতে লিয়ানদু জেলা আরেক ধাপে ঐতিহ্যগত গ্রাম পুনরুদ্ধার করবে এবং আরও বেশি প্রাচীণ গ্রাম সুরক্ষা ও উন্নয়নের আওতায় আনবে। "বর্তমান আমাদের জেলায় ২০৮টি প্রশাসনিক গ্রাম রয়েছে। স্থানীয় কৃষি কার্যালয় পরিদর্শনের মাধ্যমে আরও দশটি গ্রাম বাছাই করেছে।"

'পাহাড় আছে, পানি আছে, আছে জন্মস্থানের অনুভূতি'—এটা হচ্ছে সিয়ানানশান গ্রামের শ্লোগান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চেচিয়াং প্রদেশ গ্রাম পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা কার্যকর করে এবং ইতিবাচকভাবে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত গ্রামের সমৃদ্ধ ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে থাকে। এ পর্যন্ত ছয় দফায় ২৫৯টি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক গ্রাম ও ১২৮২টি গ্রাম সুরক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।