শীতকালীন ছুটিতে চীনা শিক্ষার্থীদের ঘুরে বেড়ানোর ক্লাস
2024-02-19 16:30:15

এখন চীনের বসন্ত উত্সব চলছে। এর সাথে সাথে জানুয়ারি মাসের শেষ দিক থেকে চীনের বিভিন্ন এলাকার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শীতকালীন ছুটিও শুরু হয়েছে। ছুটির দিনে অধিকাংশ পিতামাতাকেই অফিসের কাজ করতে হয়। এদিকে, মজার ও তাত্পর্যপূর্ণ শীতকালীন ছুটি কাটানো চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের বিভিন্ন এলাকার ছাত্রছাত্রীদের ঘুরে বেড়ানোর ক্লাস ও পড়াশোনার শীতকালীন ক্যাম্প নিয়ে কথা বলবো।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিবছরের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের ঘুরে বেড়ানোর ক্লাস বা শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এমন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জাদুঘর ও দর্শনীয় স্থান দেখতে এবং স্বেচ্ছাসেবকের কাজ চর্চা করতে পারে এবং এর মাধ্যমে অনেক জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ক্লাসরুমে পড়াশোনার চেয়ে এটি শিক্ষার্থীদের কাছে বেশি প্রিয়।

 

চলতি বছরের শীতকালীন ছুটিকে কোভিড মহামারীর পর প্রথম শীতকালীন ছুটি বলা যায়। চীনের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা-ভ্রমণ বেশ জনপ্রিয়। এসময় দক্ষিণ চীনের বাচ্চারা উত্তর চীনে আসে এবং উত্তর চীনের বাচ্চারা দক্ষিণ চীনে যায়।

 

চীনের পর্যটন ওয়েবসাইটের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, শীতকালীন ছুটিতে বাচ্চাদের নিয়ে নিজের শহর থেকে অন্য এলাকায় ভ্রমণকারী পিতামাতার সংখ্যা ৫৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেইজিং, নানচিং, কুয়াংচৌ আর শাংহাইসহ বিভিন্ন শহরের পিতামাতা ও বাচ্চারা ভ্রমণের প্রতি আরও বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

 

বস্তুত, ২০২৩ সালের শীতকাল থেকে উত্তরপূর্ব চীনের বরফ ও তুষার পর্যটন চীনের বিভিন্ন এলাকার নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। হারবিন, ছাংছুন, শেনইয়াং এবং মুতানচিয়াংসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন শহর চীনা বাবা-মা ও বাচ্চাদের প্রিয় পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত, এমন শহরের পর্যটন দলের বুকিং সব শেষ হয়ে গেছে। বেইজিং, শাংহাই এবং কুয়াংচৌসহ বিভিন্ন শহর, যেখানে ডিসনিল্যান্ড বা পর্যটন রিসর্ট এলাকা রয়েছে, সেগুলোর দর্শনীয় স্থানের আশেপাশের হোটেলও বুকিং শেষ হয়েছে। তা ছাড়া, বেইজিং, নানচিং, সি’আন এবং  হাইনান প্রদেশের বিভিন্ন দ্বীপশহরও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

 

চীনের বিভিন্ন এলাকার পর্যটন ও সংস্কৃতি বিভাগ নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যময় দর্শনীয় স্থান তুলে ধরার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। এভাবে শীতকালীন ছুটিতে চীনের পর্যটন বাজার আরও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সবাই আনন্দে আমেজে পর্যটনের সুখ অনুভব করে থাকে। এ সময়, যারা বাচ্চাদের নিয়ে ভ্রমণ করেন, যদি তারা উত্তর চীনে থাকেন, তারা দক্ষিণ চীনে যেতে আগ্রহী, যদি কেউ কেউ শাংহাই, চিয়াংসু বা কুয়াংতুং প্রদেশে বসবাস করেন, তাহলে তারা উত্তরপূর্ব চীনে যেতে আগ্রহী।

 

চীনের কুয়াংসি, ইয়ুননান ও সিছুয়ানের ছাত্রছাত্রীরা ঠাণ্ডা আবহাওয়ার হারবিনে আসায় চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কাভারেজ পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পর্যটন পরিষেবা কোম্পানি তাদের জন্য বিশেষ পর্যটন সেবা প্যাকেজ অফার করেছে; যেমন, নোটবুক নিয়ে বেইজিং ঘুরে বেড়ানো, রেইন ফরেস্টের গবেষণা ভ্রমণ, ছাংপাইশান পাহাড়ের গবেষণা যাত্রা, ইত্যাদি।

 

এ প্রবণতার সাথে বিভিন্ন ধরনের নোটবুক ভ্রমণ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চীনাদের একটি প্রবাদ রয়েছে, সেটি হল: ‘কেবল হাজার বই পড়া আর হাজার মাইল পথ করার পর জ্ঞানী মানুষ হওয়া সম্ভব।’ বাচ্চারা ভ্রমণের সময় নিজেদের নোটবুকে অনেক তথ্য-উপাত্ত লিখে রাখে। দর্শনীয় স্থান ও স্থানীয় রীতিনীতি সম্পর্কে তারা বিশেষ জ্ঞানও অর্জন করতে পারে। আনন্দের মাধ্যমে শেখা একেই বলে। এর মাধ্যমে তাঁরা ইতিহাস, চীনা সভ্যতা ও আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়।

 

চীনের কয়েকটি পর্যটন এজেন্সি এ উপলক্ষ্যে ‘নোটবুকের সাথে ভিন্ন শহর ঘুরে বেড়ানো’ প্রকল্প চালু করেছে। তারা বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের জ্ঞান মজবুত ও শেখার আগ্রহের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের শেখার বিষয় নির্ধারণ করেছে; যেমন, ‘নোটবুকের সাথে হুইচৌ ভ্রমণ’ প্রকল্পে চীনের আনহুই প্রদেশের হুয়াংশান পাহাড়, হং গ্রাম এবং স্থানীয় রীতিনীতির অনুশীলনের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের বইয়ে পড়া হুয়াংশান পাহাড়ের পাইন গাছ নিজেদের চোখে দেখতে পায়, থিয়ানতু পাহাড়ে আরোহণ করতে পারে, এবং স্থানীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারী শিল্পীদের কাছ থেকে হুই ‘কালিদণ্ড’, ‘পাথরের পাত্র’, ‘ব্রাশ’ ও লন্ঠনসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করার পদ্ধতি শিখতে পারে। এভাবে তারা প্রাচীনকালে আনহুই প্রদেশের বৈশিষ্ট্যময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে এবং বই থেকে অর্জিত জ্ঞানের সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পায়।  

 

বিদেশ ভ্রমণও চীনা বাচ্চাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এসব দেশের মধ্যে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ যেমন সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালিয়েশিয়া সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কারণ, এ কয়েকটি দেশ চীন থেকে বেশি দূরে নয়, কয়েক ঘন্টায় বিমানে করে পৌঁছানো যায় এবং এসব দেশে প্রবাসী চীনার সংখ্যাও বেশি। চীনা ঐতিহ্যিক সভ্যতার প্রতি ব্যাপক স্বীকৃতি দেওয়া হয় এ সব দেশে। তা ছাড়া, জাপান, রাশিয়া, ইউরোপীয় দেশগুলোও চীনা বাচ্চাদের গন্তব্যস্থানে পরিণত হয়েছে।

 

সিঙ্গাপুর পিতামাতাকে নিয়ে বাচ্চাদের ঘুরে বেড়ানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যদেশ। পর্যটন এজেন্সি ৬ থেকে ১৫ বছর বয়সের বাচ্চাদের পরিবারের জন্য পর্যটন ও পড়াশোনার প্রকল্প ডিজাইন করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরীক্ষা, প্রযুক্তিগত প্রোগ্রামিং, প্রকৌশল কাঠামো, শিল্পকলার চর্চাসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যময় ক্লাস যুক্ত করা হয়েছে ভ্রমণে। পরিবারের সদস্যরা সিঙ্গাপুরের ইতিহাস, সভ্যতা ও সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পাওয়ার পাশাপাশি, এআই রোবটের ৩ডি প্রিন্টিং, ম্যানগ্রোভ বনের পরিবেশ সংরক্ষণসহ ধারাবাহিক ক্লাসে যোগ দিতে পারে। এমন ক্লাসের মাধ্যমে বাচ্চারা আনন্দময় ও আরামদায়ক পরিবেশে নিজেদের জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে।

 

বেইজিংয়ের কেন্দ্রীয় এলাকার স্কুল ও উপকন্ঠ এলাকার স্কুলের সহযোগিতামূলক কার্যক্রম

সম্প্রতি বেইজিংয়ের বিভিন্ন এলাকার মাধ্যমিক স্কুলগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর ফলে বিভিন্ন এলাকার স্কুলের মধ্যে শিক্ষা খাতে আদানপ্রদান বাড়ছে।

জানা গেছে, ২০২৩ সালে বেইজিংয়ের শিক্ষা কমিটির উদ্যোগে শহর ও উপকন্ঠ এলাকার বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুলের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের প্রকল্প চালু করা হয়। মোট ৩৬৪ জোড়া মাধ্যমিক স্কুল এ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এভাবে বেইজিংয়ের বিভিন্ন এলাকার মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার মানের উন্নয়ন হয়েছে।

বেইজিংয়ের উপকন্ঠ এলাকা মিইয়ুনে কুবেইখৌতে মহাপ্রাচীর জাপানি আগ্রাসন যুদ্ধের জাদুঘর ও মহাপ্রাচীর স্মৃতিসৌধ রয়েছে। মিইয়ুন এলাকার মুচিয়াইয়ু মাধ্যমিক স্কুল এবং ছাওইয়াং এলাকার রিথান মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা দেশপ্রেমের শিক্ষা গ্রহণ করেছে। দুটি মাধ্যমিক স্কুলের ১০টি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা যৌথভাবে মহাপ্রাচীরে আরোহণ করেছে এবং বিপ্লবের সৈন্যদের যাত্রার পথ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা পেয়েছে। এমন কার্যক্রমের মাধ্যমে তাঁরা আজকের শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল জীবনের মূল্য আরও সহজে বুঝতে পারে।

 

বেইজিংয়ের শুন’ই এলাকার বেই’উ মাধ্যমিক স্কুল এবং দ্বিতীয় নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের পর, বেই’উ মাধ্যমিক স্কুলের কৃষি ঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। দ্বিতীয় নম্বর স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এ ঘাঁটিতে বিভিন্ন কৃষিকাজ চর্চা করে এবং শ্রমের কাজ অনুশীলন করে, এটি শহরাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।

ছাওইয়াং এলাকার সানফান মাধ্যমিক স্কুলের স্বাধীন বই পড়ার পরিবেশ বেশ আকর্ষণীয়। শুন’ই এলাকার ১২ নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা মনে করেন, তাদের স্কুলে সানফান মাধ্যমিক স্কুলের মতো একটি ‘সূর্য ক্লাসরুম’ স্থাপন করা দরকার, যাতে ছাত্রছাত্রীরা আরামে সেখানে বই পড়তে পারে এবং ক্লাস শেষ করে সেখানে স্বাধীনভাবে পড়াশোনার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

বেইজিং চীনের রাজধানী। এ মহানগরে বাসিন্দার সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি। এমন বড় শহরে অবশ্যই প্রচুর মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। তাই রাজধানী হলেও বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার মান একই নয়। এমন উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুলের মধ্যে ব্যবধান কমে আসবে এবং কার্যকর শিক্ষার অভিজ্ঞতা বিনিময় থেকে সবাই উপকৃত হতে পারবে।

এমন উদ্যোগ কেবল ছাত্রছাত্রীদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা নয়, বরং বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের জন্যও  আকর্ষণীয় ব্যাপার। ছাওইয়াং বিদেশি ভাষা স্কুল এবং ফাংশান এলাকার থুওলি মাধ্যমিক স্কুল সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করেছে। দুই স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সহযোগিতার বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। দুই স্কুলের শিক্ষকদের যৌথ প্রয়াসে বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষাদানের মান উন্নত করা হয়েছে এবং ফাংশান থুওলি স্কুলের শিক্ষকরা অনলাইনে ছাওইয়ান বিদেশি ভাষা স্কুলের শিক্ষকদের ক্লাস দেখেছেন। তারা মনে করেন আরো উন্নত শিক্ষাদানের পদ্ধতি শিখতে পেরেছেন ।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)