বসন্ত উত্সবের সময় পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য চীনারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে জন্মস্থানে ফিরে যায় এবং উত্সবের পর আবার নিজ নিজ কর্মস্থল বা বাসস্থলে ফিরে আসে। এ প্রক্রিয়াকে ছুন ইয়ুন বলা হয়। চলতি বছরের ৪০ দিনের ছুন ইয়ুনকালে চীনা সব মিলেয়ে আনুমানিক ৯শ কোটি বারের মতো ভ্রমণ করবে। ছুন ইয়ুন নিয়ে প্রত্যেকের নিজের গল্প ও স্মৃতি আছে এবং তাদের অভিজ্ঞতায় চীনের উন্নয়ন ও পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়।
স্লো ট্রেন থেকে হাই-স্পিড ট্রেন, ট্রেনে ইনস্ট্যান্ট নুডলস খাওয়া থেকে অর্ডার করে খাবার খাওয়া পর্যন্ত, মোটরসাইকেল থেকে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরে যাওয়া পর্যন্ত চীনা মানুষেরা ছুন ইয়ুনে নানা পরিবর্তন দেখেছে।
পঞ্চাশ বছর বয়সী সিয়া জুন বেইজিংয়ে বাস করেন এবং তার বাবা মা শাংহাইয়ে থাকেন। তাই উত্সবের সময় তিনি পরিবার নিয়ে বেইজিংয়ে থেকে শাংহাইয়ে যান। এক সময় ট্রেনে করে বেইজিং থেকে শাংহাই যেতে ২২ ঘন্টা লাগতো। স্লো ট্রেনে এতো ভিড় থাকতো যে, পা রাখার জায়গা পর্যন্ত থাকতো না। একটি বসার জায়গা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল।
২০২৩ সালের শেষ নাগাদ চীনে রেলপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৯ হাজার কিলোমিটারে। এর মধ্যে ৪৫ হাজার কিলোমিটার হাই-স্পিড রেলপথ। রেলপথ শহর ও গ্রামকে যুক্ত করেছে এবং বাসায় ফেরার সময় কমিয়েছে।
সকালে সিয়া চুন ও তার পরিবার বেইজিং দক্ষিণ ট্রেন স্টেশনে আসে আর সাড়ে ১১টায় তারা শাংহাইতে পৌঁছায়। শাংহাই ট্রেন স্টেশন থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে তারা বাবা-মার বাসায় পৌঁছে যান।
ছুন ইয়ুনের সময় একটি ট্রেনের টিকিট পাওয়াও এক সময় ভীষণ কঠিন ব্যাপার ছিল। ষাট বছর বয়সী লি ইউং হুইয়ের এখনও মনে আছে, ছুন ইয়ুনে একটি টিকিট পেতে কত কষ্ট করতে হতো। টিকিট কিনতে প্রচণ্ড শীতে ট্রেন স্টেশন বা টিকিট কাউন্টারে সবাইকে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। মধ্য রাত থেকে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো কখনও কখনও।
টিকিট একসময় হাতে লেখা একটি কাগজ ছিল। তারপর লাল রঙে প্রিন্ট কাগজের টিকিট এলো। এরপর এলো কয়েক মিনিটে তৈরি করা যায় এমন টিকিট আর এখনকার টিকিট কয়েক সেকেন্ডে তৈরি হয়। ২০১২ সাল থেকে চীনে অনলাইন ট্রেন টিকিট বিক্রি শুরু হয় এবং মানুষের আর লাইনে দাড়াঁনোর দরকার হয় না। এখন ট্রেন স্টেশন, অনলাইন ও ফোন - নানা পদ্ধতিকে টিকিট কাটা যায়।
লি ইউং হুই এবার হুই বেই প্রদেশের উ হান শহরে যান। তার মেয়ে ওখানে বাস করেন। ফোন আ্যাপের মাধ্যমে তিনি টিকিটটি কেনেন।
কান সু প্রদেশের থিয়ান সুই শহর উত্তর-পশ্চিম চীনের একটি বড় শ্রম রপ্তানিকারক শহর। প্রতি বছর এখান থকে গড়ে ৭ লাখ মানুষ বাইরে কাজ করতে যান। প্রতি বছরের বসন্ত উত্সবের সময় থিয়ান সুই শহরের নানা স্টেশনে দেখা যায় ফিরে আসা মানুষের স্রোত। থিয়ান সুই স্টেশনের নিরাপত্তাকর্মী চেন সিং সুনের মনে আছে যখন তিনি মাত্র এ চাকরি শুরু করেন, তখন বাইরে যাওয়া কর্মীদের পিঠে একটি বড় ব্যাগ, হাতে একটি বড় প্লাস্টিকের ব্যারেল আর কাঁধে আরও একটি ব্যাগ থাকতো। তখন নিরাপত্তা চেকিং ভারি একটি কাজ ছিল। কারণ সবাই অনেক বেশি লাগেজ নিয়ে আসতেন। প্রতিটি জিনিস চেক করতে নিরাপত্তা কর্মীদের বেশ সময় লাগতো। এখন আর সে দৃশ্য আর দেখা যায় না। যাত্রীরা মাত্র একটি স্যুটকেস বা ব্যাকপ্যাক নিয়ে ভ্রমণ করেন আর নিরাপত্তা চেকিং দক্ষতাও বেড়েছে।
সু চৌয়ের বাসিন্দা ৫০ বছর বয়সী লিউ কেন রং স্মরণ করে বলেন, আগে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত কেউ কেউ স্টেশনে শুয়ে থাকতেন। তবে এখন সুই চৌ স্টেশনে আর এমন দৃশ্য দেখা যায় না। যাত্রীরা ফোন দেখেন, পরিবারের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করেন, পত্রিকা বা বই পড়েন, দোকান ঘুরে দেখেন বা চা-কফি পান করেন। এখন চীনের বিভিন্ন ট্রেন স্টেশনের ওয়েটিং রুম কার্যত একটি বাণিজ্যিক সড়কে পরিণত হয়েছে। এখানে কেবল চীনের পুরান ব্র্যান্ড ও ফ্যাশন ব্র্যান্ডের পণ্যই পাওয়া যায় না; বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যও পাওয়া যায়।
টিকিট চেকিং প্রক্রিয়ায়ও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তা লিয়ান স্টেশনের নির্বাহী প্রধান লিউ সিয়াও ইয়ুন ২০ বছরের বেশি সময় এখানে কাজ করছেন। আগে টিকিট চেকাররা প্রত্যেক টিকিটে যাত্রীর নাম, তারিখ ও ট্রেন নম্বর চেক করে ছোট একটি প্লায়ার্সের সাহায্যে টিকিটে একটি ছিদ্র করে দিতেন। ছুন ইয়ুনের সময় লিউ সিয়াও ইয়ুন টিকিট চেক করতে সাহায্য করতেন। ওই সময় একটি টিকিট চেক করতে ৪-৫ সেকেন্ড সময় লাগত। তাই ট্রেন ছাড়ার ৩০ মিনিট আগ থেকে টিকিট চেক শুরু হতো। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে চীনে চালু হয় বুলেট ট্রেন এবং ম্যাগনেটিক টিকিট। এ টিকিট চেক করে মেশিন। ২০১১ সালের জুন মাস থেকে টিকিট দেখানোরও প্রয়োজন পড়ে না; আইডি কার্ড দিয়েই ট্রেনে উঠা যায়। যদি আইডি কার্ড দিয়ে অনলাইনে টিকিট কেনা হয়, তাহলে মেশিন আইডি কার্ড থেকেই বুঝতে পারে, ওই যাত্রীর টিকিট নম্বর কতো।
২০২৩ সালে তালিয়ান স্টেশনের টিকিট চেকিং ব্যবস্থা আপগ্রেড করা হয়। পাসপোর্ট দিয়েও মেশিন টিকিট চেক করতে পারে। একেকটি টিকিট চেক করতে মাত্র ১ সেকেন্ড সময় লাগে। তাই ট্রেন ছাড়ার ১৫ মিনিট আগে থেকে টিকিট চেক শুরু হলেও কোনও সমস্যা হয় না।
নান চিং প্যাসেঞ্জার সেকশন ট্রেনের কন্ডাক্টর ইয়ান ছেনের স্মৃতিতে স্লো ট্রেনের যাত্রা সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টকর। দীর্ঘ সময় ঘুমানো ছাড়া কিছুই করতে পারতেন না তিনি। কোনও খাবার ছিল না। খাবার সময় সারা ট্রেন ভরে যেত ইনস্ট্যান্ট নুডলসের গন্ধে। এমন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন বুলেট ট্রেনে প্রতিদিন কয়েক শ’ কাস্টমাইজড সেট লাঞ্চ বক্স বিক্রি করা হয়। যাত্রীরাও ফোন আ্যাপের মাধ্যমে খাবার অর্ডার করতে পারেন। নির্ধারিত স্টেশনে পোঁছালে খাবার তাদের আসনে পৌঁছে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে শাং হাই হুয়া থীয়ে যাত্রীসেবা কোম্পানি মোট ১ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার বক্স খাবার বিক্রি করে।
চীনে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি কার্যকর হবার পর থেকে ছুন ইয়ুনের সময় ট্রেনে ভ্রমণকারী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৯ সালের ছুন ইয়ুনের সময় প্রথম বারের মতো ১০ কোটির বেশি ট্রেন যাতায়াত হয়।
শেন ইয়াং ট্রেন যাত্রী বিভাগের তৃতীয় দলের প্রধান চাও চ্য ছিয়াং ৪০ বছরের মতো কাজ করছেন। ট্রেনে টয়লেটে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া কঠিন ছিল। তখন ট্রেনে এত ভিড় হতো যে, এমনকি ৩ বর্গমিটারের টয়লেটে ৫-৬ জন দাড়াঁনো থাকতো। এখন বুলেট ট্রেনের টয়লেট সব আধুনিক। সেন্সর-ফ্লাশ, ওয়াশ বেসিন, হাত ধোয়ার সাবান, কাগজের তোয়ালেসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু পাওয়া যায়।
এক সময় অনেক চীনা ছুন ইয়ুনের সময় মোটরসাইকেলে চড়ে জন্মস্থানে ফিরতেন। বৃষ্টি, তুষার যাই হোক না কেন তারা ১০-১২ ঘন্টা ধরে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘরে ফিরতেন। ছুন ইয়ুনের ব্যস্ততম সময়ে কুয়াং তুং প্রদেশ থেকে ঘরে ফেরা মোটরসাইকেল চালকের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেত।
কুয়াং সি প্রদেশের হু বিন এমন মোটরসাইকেল চালকদের একজন ছিলেন। তবে এটা তার পছন্দের কাছ ছিল না; কেবল টাকা সাশ্রয়ের জন্য তিনি এটা করতেন। দুবছর আগে তিনি বুলেট ট্রেনে করে, পরেরবার বাসে করে এবং এবার নতুন-জ্বালানি গাড়ি চালিয়ে জন্মস্থানে ফেরেন।
সু চৌতে কাজ করা ওয়াং ছিং সিয়াওও একইভাবে বাসায় ফেরেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ছুন ইয়ুনের সময় চীনে মোট ৭২০ কোটি গাড়ি-যাত্রা হবে।
শেন ইউয়াং স্টেশনের পরিষেবা ডেস্কের কর্মী খো লি ২০ বছরের বেশি সময়ে এখানে কাজ করেন। আগে যদি একজন মা নিজের বাচ্চাকে নিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করতেন, তাহলে এক হাতে লাগেজ নিতে হতো আর অন্য হাতে বাচ্চা। বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য বিশেষ স্থানও ছিল না। খো লি একসময় রুমের সামনে রক্ষা করতেন আর মা ভেতরে নিজের বাচ্চাকে দূধ খাওয়াতেন। বেইজিংয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গণসমাগম স্থলে ৪০০টির বেশি ‘মা-শিশু ঘর’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সব বিমানবন্দর ও ট্রেন স্টেশনে এমন ঘর আছে এখন। শেন ইয়াং ট্রেন স্টেশনে ১০ বর্গমিটারের ‘মা-শিশু ঘর’ বানানো হয়েছে। ভেতরে বোতল উষ্ণ করার মেশিন, মাইক্রোওয়েভ, ডায়াপার সব থাকে।
সিয়া মেন থেকে অন্য জায়গায় যাবার ট্রেনে শিশুদের জন্য বিশেষ কোচ স্থাপিত হয়েছে। সেখানে শিশুর জন্য খেলনা, বই ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। শিশুদের নিয়ে ট্রেনযাত্রার সময় এমন কোচ পেলে মায়ের জন্য চাপও কম হয়।
এক সময় ছুন ইয়ুনের অর্থ ছিল কেবল জন্মস্থানে ফিরে যাওয়া আর এখন এর অর্থ ভ্রমণও। থুং ছেং নামে একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত উপাত্তে দেখা যায়, এবার বসন্ত উত্সবের ছুটিতে উত্তর চীনে তুষার উপভোগ এবং দক্ষিণ চীনে শীত এড়ানো দুটি ভ্রমণের মূল চাহিদা।
চিলিন প্রদেশের বাসিন্দা চাও ফেং মেই ও তার স্বামী বিমানের টিকিট কিনেছেন। নান চিং শহরে কাজ করা মেয়ের সঙ্গে হাই নান প্রদেশে ভ্রমণ করতে যাবেন তারা। তাদের মতে, পরিবার সঙ্গে থাকলে যে কোনও জায়গায় বসন্ত উত্সব উদযাপন করা যায়। পুনর্মিলন মানে কেবল জন্মস্থানে থাকা নয়। মানুষের ধারণা অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবারে সঙ্গে থেকে মজার ও অবিস্মরণীয় সময় কাটানো পুনর্মিলনের নতুন অর্থ। (শিশির/রহমান)