বিজ্ঞানবিশ্ব ৫৭তম পর্ব
2024-02-12 15:42:03

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৫৭তম পর্বে যা থাকছে:

 

* জন্মগত বধিরতা নিরাময় করতে সক্ষম থেরাপি উদ্বাবন করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

* ইঁদুরের মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক ম্যাপ

* ২০২৬ সালে কার্যক্রম শুরু করবে শক্তিশালী স্পেক্ট্রাল টেলিস্কোপ

 

 

জন্মগত বধিরতা নিরাময় করতে সক্ষম থেরাপি উদ্বাবন করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

 

আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের অন্যতম হচ্ছে শ্রবণশক্তি। অথচ শ্রবণশক্তির যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে আমরা সব সময় উদাসীন। বধিরতা মানুষের ইন্দ্রিয়ের সবচেয়ে বড় রোগ৷ জন্মগতভাবে বধির শিশুর বাক্‌শক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শুধু তাই নয়, শ্রবণক্ষীণতা ও বধিরতা মানুষকে সমাজে অগ্রহণযোগ্য করে ফেলে। শিশুর ভাষা শিক্ষা, লেখাপড়া ও সামাজিক যোগাযোগের জন্য স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি অপরিহার্য। এ সমস্যার সমাধানে নতুন এক চিকিৎসাকৌশল উদ্ভাবন করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা।

এর ফলে জন্মগতভাবে শ্রবণশক্তি হারানো লাখ লাখ মানুষের জীবনে যুক্ত হবে শ্রবণ অনুভূতি। প্রভাবশালী মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যেই এই থেরাপিটি একটি অভিনব চিকিৎসা হিসেবে কার্যকর ও নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল, সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং শাংহাই রিফ্রেশজিন থেরাপিউটিকস কম্পানির সহযোগিতায় শাংহাইয়ের ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু ও ইএনটি হাসপাতালের একদল গবেষকের নেতৃত্বে এ থেরাপিটি উদ্ভাবন করা হয়।

গবেষক দলটি এমন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন যেখানে সাধারণ কিছু কাজ করা হিউম্যান সোর্স জিনগুলোকে রোগীর কানের ভেতরের কোষে প্রবাহিত করা হয়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে অকার্যকর জিনকে কার্যকরী জিন দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।

মিউটেশনের কারণে বধিরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি প্রোটিন-কোডিং জিনকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করে দলটি কক্লিয়ার কোষে জিন সরবরাহ করে চিকিৎসাটি করছেন। এর জন্য তারা অ্যাডেনো সম্পর্কিত একটি ভাইরাস ব্যবহার করেছেন।

ধারণাটি হয়তো সবার কাছে খুব সরল মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ও জটিল। এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় বাধা হলো কার্যকরী জিন সিকোয়েন্সের আকার।

গবেষকদলের নেতৃত্বে থাকা গবেষক শু ইলাই বলেন, “আমরা প্রতিটি জিন সিকোয়েন্সের জন্য দুটি করে সেট ব্যবহার করেছি। এরপর সেগুলোকে টার্গেট কোষের মধ্যে পুনরায় একত্রিত করেছি।”

বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বংশগত বধিরতায় ভুগছে এবং চীনে বছরে প্রায় ৩০ হাজার শিশু বধির হয়ে জন্মগ্রহণ করে, যার ৬০ শতাংশই জেনেটিক কারণগুলো সঙ্গে সম্পর্কিত।

নতুন এ চিকিৎসা পদ্ধতি ২০২২ সালের জুনে দেশটির বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নীতিগত অনুমোদন পায়। এরপর একই বছরের অক্টোবরে শুরু হয় ক্লিনিকাল ট্রায়াল। গত বছরের জুন পর্যন্ত নতুন উদ্ভাবিত এ চিকিৎসা পদ্ধতির আওতায় ছয়জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে পাঁচজন ছিল শিশু। ছয় মাস চিকিৎসার পর এই পাঁচ শিশু শ্রবণশক্তি ফিরে পেয়েছে। একেবারে বধির অবস্থা থেকে চিকিৎসার পর প্রায় ৪০ থেকে ৫৭ ডেসিবেল শব্দে তারা সাড়া দিয়েছে। এই ডেসিবেল শব্দ হলো একটি ঘরের ভেতরের কথোপকথনের প্রায় স্বাভাবিক মাত্রা।

বর্তমানে তারা পুরোপুরি সুস্থ রয়েছে এবং তাদের মধ্যে কোনও ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

গবেষকদের বিশ্বাস, বংশগত শ্রবণশক্তি হ্রাসের চিকিৎসার জন্য এটি বিশ্বের প্রথম কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধিতি হয়ে উঠবে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

ইঁদুরের মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক ম্যাপ

ইঁদুরের মস্তিষ্কের ‘হিপোক্যাম্পাস’ অংশের কোষের সবচেয়ে বড় নিউরাল নেটওয়ার্ক ম্যাপ তৈরি করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। মানুষসহ অন্য প্রাণীদের মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘হিপোক্যাম্পাস’। এটি মস্তিষ্কে স্মৃতি ধরে রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন, কীভাবে এই অংশের একক নিউরন পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং কীভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য অঞ্চলে নিউরনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে।

গবেষকদের যুগান্তকারী এ নেটওয়ার্ক ম্যাপের কারণে হিপোক্যাম্পাল নিউরনের কার্যকারিতা, এ সংক্রান্ত রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় অগ্রগতি অর্জিত হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সায়েন্স জার্নালে এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিপোক্যাম্পাস কেবল শেখা বা স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এমন নয়; কনন্টেক্সট, স্পেশাল কগনিশন, নেভিগেশন, স্ট্রেস ও মানবিক আবেদনের মতো মস্তিষ্কের বিভিন্ন কাজেও ভূমিকা রাখে। এই কাজগুলো করার জন্য হিপোক্যাম্পাল নিউরনগুলো কাছাকাছি বা দূরবর্তী অংশের অন্যান্য নিউরনে সংকেত পৌঁছে দেয়।

চীনের বিজ্ঞান একাডেমি এবং সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন ব্রেন সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির পরিচালক পু মুমিং জানান, মস্তিষ্কে আলঝেইমার রোগের প্রথম প্রকাশ হলো হিপোক্যাম্পাসের কোষের মৃত্যু এবং তাদের অস্বাভাবিক সংযোগ। এই গবেষণাটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন ব্যাধি সম্পর্কে আরও ভালভাবে বোঝার পথ তৈরি করতে পারে।

সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন ব্রেন সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির নেতৃত্বে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়। তবে সহযোগিতায় ছিল-সুচৌ ইন্সটিটিউট অব নিউরোস্প্যাশিয়াল ইনফরমেশন অব হুয়াচং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, হাইনান ইউনিভার্সিটি, সিএএসের খুনমিং ইন্সটিটিউট অব জিওলোজি, লিংক্যাং ল্যাবরেটরি, শাংহাই সেন্টার ফর ব্রেন সায়েন্স এবং ব্রেইন ইন্সপায়ার্ড টেকনোলজি।

গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ নিউরাল রোডম্যাপ বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাসের ১০ হাজার ১০০টি একক নিউরনের একটি ম্যাপ এবং ৪৩টি নিউরাল প্রজেকশন প্যাটার্নকে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন।

এ গবেষণা দলটির শীর্ষস্থানীয় গবেষক এবং গবেষণাপত্রের লেখক সু ছুন জানান, হিপোক্যাম্পাল নিউরনের কার্যকারিতা আরও ভালভাবে বোঝার জন্য এই ম্যাপটি দারুণ কাজে দেবে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

২০২৬ সালে কার্যক্রম শুরু করবে শক্তিশালী স্পেক্ট্রাল টেলিস্কোপ

 

টেলিস্কোপ বা দূরবীন দূরবর্তী বস্তু দেখার একটি যন্ত্র। এটি একটি টিউবের আকারে এবং বিশেষ ধরনের লেন্স ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এই লেন্সগুলোর সাহায্যে, টেলিস্কোপ দূরবর্তী বস্তুগুলোকে পরিষ্কারভাবে ও বড় আকারে দেখায়। জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণায় টেলিস্কোপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দূরবীন ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাকাশের বস্তুর বিভিন্ন তথ্য, যেমন তাদের দূরত্ব, আকার, গঠন, গতি ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। এই ডেটা তখন আমাদের চারপাশের মহাবিশ্বকে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য ব্যবহার করা হয়। মূলত বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের টেলিস্কোপ। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাজকে আরও সহজ করতে এবার অতি শক্তিশালী স্পেক্ট্রাল টেলিস্কোপ তৈরি করলো চীন।

চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেক্ট্রাল টেলিস্কোপটি ২০২৬ সালে সম্পূর্ণ কার্যক্রম শুরু করবে। ‘চিয়াওথং ইউনিভার্সিটি স্পেকট্রোস্কোপিক টেলিস্কোপ (জেইউএসটি)’ নামের এই দূরবীনটি ৪ দশমিক ৪ মিটার অ্যাপারচারের। দেশটির সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ডেইলির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

উত্তর-পশ্চিম চীনের ছিংহাই প্রদেশের সাইশিথেং অবস্থিত পর্বতে লেংহু অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেশন বেইসে স্থাপিত বৃহত-অ্যাপারচারের মাল্টি-ফাংশনাল এই টেলিস্কোপ তৈরি করছে শাংহাই চিয়াও থং ইউনিভার্সিটি।

হালকা ওজনের এবং একাধিক স্পেকট্রোমিটার দিয়ে সজ্জিত চিয়াওথং ইউনিভার্সিটি স্পেকট্রোস্কোপিক টেলিস্কোপটি টার্গেট সোর্সগুলো দ্রুত পরিবর্তন করতে এবং সময়মত স্পেকট্রোস্কোপিক পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করতে সক্ষম।

এটি একটি আর-সি অপটিক্যাল সিস্টেম এবং মোজাইক থিন-মিরর প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজ করবে। প্রাথমিক মিররটি ১৮টি হেক্সাগোনাল সাব-মিরর নিয়ে গঠিত। এর প্রতিটির আকার ১ দশমিক ১ মিটার। কার্যক্রম চলাকালে টেলিস্কোপটিতে সক্রিয় অপটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে রিয়েল-টাইম ক্লোজড-লুপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যুক্ত করা হবে। টেলিস্কোপের অপটিক্যাল সিস্টেমে দুটি ফিচার রয়েছে।

 

নির্মাণ কার্যক্রম সম্পন্ন হলে টেলিস্কোপটি অস্থায়ীভাবে জ্যোতির্বিদ্যা, এক্সোপ্ল্যানেট অনুসন্ধান, মহাজাগতিক গঠন এবং বিবর্তনের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গবেষণায় যুগান্তকারী অধ্যয়ের সূচনা করবে।

এটি ওয়াইড ফিল্ড সার্ভে টেলিস্কোপ মোজি এবং চাইনিজ স্পেস স্টেশন টেলিস্কোপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করবে। এর ফলে চীনের জ্যোতির্বিদ্যার উন্নয়নের জন্য পর্যবেক্ষণমূলক ডেটা সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী