আজ চীনের ড্রাগন-বর্ষের বসন্ত উত্সবের তৃতীয় দিন। এদিন সাধারণত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া এবং সবাই একসাথে আড্ডা করা ও খাবার খাওয়ার রীতি রয়েছে চীনাদের। এ থেকে বোঝা যায়, চীনারা পারিবারির সুসম্পর্ক ও মৈত্রীর ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যুব পরামর্শকদের গল্প তুলে ধরবো। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের, বিশেষভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এভাবে শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের সুসম্পর্কও গড়ে ওঠে। চলুন, শোনা যাক তাদের গল্প।
২৭ বছর বয়সের মেয়ে ওয়েন ছেন ইয়াং এখন লানচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ও প্রকৌশল একাডেমির সবচেয়ে জুনিয়র পরামর্শক, যিনি ৩ বছর আগে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন। প্রতিদিন তাঁর প্রধান কাজ স্নাতক শিক্ষার্থীদের চাকরি-বাকরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া। যদিও অনেকের দৃষ্টিতে তার কাজ ব্যস্ততার ও নগণ্য, তবে তিনি আগ্রহের সাথে এ কাজ করে থাকেন। তার দৃষ্টিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য আলাদা, তারা ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন পরিবারে বড় হয়েছে এবং প্রত্যেকের মানসিক অবস্থা ও চরিত্র ভিন্ন; তাই নির্দিষ্ট অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চরিত্র ও চলাফেলার বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে তাদের পরামর্শকদের কাছ থেকে তা জানা সম্ভব। কারণ, পরামর্শকরা শিক্ষার্থীদের দৈনিক জীবনযাপনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। বস্তুত, তাদের কাজ কেবল ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ও জীবনসংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধান করা নয়, বরং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়তা দেওয়া।
কেউ কেউ মনে করেন, নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অবস্থা অতীতকালের ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় আরও দুর্বল ও সংবেদনশীল; তাই, নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট পরামর্শ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ে পরামর্শক দল গঠন নীতিমালা’ প্রকাশিত হয়। তাতে পরামর্শকদের কাজের গুরুত্ব ও ভুমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। পরামর্শকরা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পরামর্শ দেয় না, বরং তাদের দৈনিক জীবনযাপনের পদ্ধতি ও সঠিক মূল্যবোধ গঠনের ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
বর্তমানে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরামর্শকদের কাজে আরও পেশাদারিত্ব এসেছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এমন পরামর্শকের সংখ্যা ২ লাখ ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
চীনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিষয়ক মাস্টার্স একাডেমির পরামর্শদাতা সু ইয়ু প্রতি সপ্তাহের বুধবার তার পরামর্শক অফিসে কাজ করেন। এ অফিস রুম বড় নয়, তবে অনেক ছাত্রছাত্রী এখানে আসতে আগ্রহী। তারা মনে করে, নিজের মানসিক সমস্যা ও পড়াশোনার চাপ নিয়ন্ত্রণে পরামর্শক সু ইয়ু গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।
২০১৭ সালে শিক্ষক সু ইয়ু এ পরামর্শক অফিস চালু করেন। এর মূল উদ্দেশ্য, স্নাতক হওয়া ছাত্রছাত্রীদের উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পেতে সহায়তা করা। তবে, ধীরে ধীরে তিনি খেয়াল করেন যে, অনেক শিক্ষার্থীর কাছে চাকরি খুঁজে পাওয়া মূল সমস্যা নয়, তাদের মূল সমস্যার সাথে মানসিক দিকটা জড়িত। যখন তারা বুঝতে পারেন না, বড় হলে ঠিক কী করবেন, তখনই তারা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন।
সু ইয়ু মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের সাথে উচ্চবিদ্যালয়ের জীবনের অনেক পার্থক্য রয়েছে। অনেক ছাত্রছাত্রী হোস্টেলে থাকে এবং বাড়ির সাথে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাই যখন মনে দুঃখ পায়, তখন তারা দ্রুত পিতামাতার কাছ থেকে পরামর্শ বা সান্ত্বনা পেতে পারে না। একবার শিক্ষক সু খেয়াল করেন যে, একটি মেয়ের পরিবার হঠাত্ আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এতে তার মানসিক অবস্থা অনেক দুর্বল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে, মেয়েটি চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিজের দুঃখের কথা প্রকাশ করে। মেয়ের গল্প শুনে শিক্ষক সু তার দুঃখ বুঝতে পারেন। তখন তার আচরণ ছিল একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো।
এ সম্পর্কে শিক্ষক সু মনে করেন, ছাত্রছাত্রীদের সাথে সহমর্মিতা ও সমঝোতা হবে পরামর্শকের প্রথম কাজ। যদি শিক্ষকের দৃষ্টিতে মনে হয় কথাবার্তা বা আড্ডা দিয়েই কাজ শেষ করা যায়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক দুঃখ ও বিভ্রান্তি অনুভব করা মুশকিল হবে। ছাত্রছাত্রীদের বিভ্রান্তি সাধারণত তাদের আবেগ ও অনুভূতির সাথে জড়িত।
শিক্ষক ওয়েন ছেন ইয়াং মনে করেন, পরামর্শকদের কাজ কঠিন নয়, তবে তাদের কাজে আরও বেশি আবেগ দরকার। বর্তমানে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি ২০০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য একজন পরামর্শক আছেন। তাই প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর মানসিক অবস্থার ওপর খেয়াল রাখা পরামর্শকের জন্য সহজ নয়।
শিক্ষক সু ইয়ু নিজের কাজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, একবার একজন অন্তর্মূখী ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করে, কেন সে ক্লাসের সহপাঠীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না? কেন সবার সাথে সহাবস্থান তার জন্য এতো কঠিন ব্যাপার? শিক্ষক সু তার কথা শুনে প্রায় দুই ঘন্টা ক্লাসের পরিবেশ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করেন। ফলে তিনি জানতে পারেন যে, এ ছাত্র পর পর কয়েকটি অনুষ্ঠানে ক্লাসের সহপাঠীদের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি। ফলে তারা মনে করে সে একা থাকতেই পছন্দ করে। তাই পরের অনুষ্ঠানে তারা তাকে আর ডাকেনি। এটি আসলে একটি ভুল বোঝাবুঝির ফল। পরে তিনি একটি বিশেষ ক্লাস মিটিং আয়োজন করেন। সবাইকে আত্মপ্রকাশের গুরুত্ব ও অন্যদের সাথে আড্ডার পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। পরে এ ছাত্রের সমস্যার সমাধান হয়।
শিক্ষক ওয়েনের দৃষ্টিতে অন্তর্মুখী বাচ্চারা যদি মেজাজের সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন তারা অন্যদের সাথে ভাব বিনিময় করতে চায় না। দীর্ঘকাল ধরে নিজেই এমন সমস্যার সম্মুখীন হলে, তাদের মানসিক সমস্যা সহজে ঘটে এবং এটি বোমা বিস্ফোরণের মতো, যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে। এ সমস্যার সমাধানে শিক্ষক ওয়েন সবার সাথে খেলতে চেষ্টা করেন। একাডেমির সমর্থনে তিনি একটি বহুমুখী মিডিয়া দল গঠন করেন। তারা বৈশিষ্ট্যময় সাংস্কৃতিক ডিজাইন বা অনুষ্ঠান করে। এ কাজের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের কল্পনা ও উদ্ভাবনক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। নিজেদের মধ্যে সহায়তা ও মত বিনিময়ের অভ্যাসও তৈরি হয়। টানা কয়েক মাস ধরে তারা বুকমার্ক, ব্যাগ ও মাউস প্যাডসহ বিভিন্ন জিনিস ডিজাইন করেছে।
বেইজিং চিয়াওথং বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি মানসিক সমস্যা ও বিভ্রান্তি মোকাবিলার রুম রয়েছে। এর নাম ‘থিয়ান ইয়ো বিকেল চা রুম’। তারা নিয়মিতভাবে চীনের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ জানায়, তাদের বড় হওয়ার গল্প ও সম্মুখীন সমস্যার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে অনুরোধ করে।
এ সম্পর্কে পরামর্শক ওয়াং সিন ই বলেন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিজেদের প্রিয় কাজ খুঁজে পাওয়া এবং নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে যাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শখ, মূল্যবোধ, দক্ষতা ও চরিত্র এ চার দিক থেকে ছাত্রছাত্রীদের উন্নয়নের সম্ভাবনা বিবেচনা করেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে অনেক ছাত্রছাত্রী কাওখাও পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেজর বেছে নেওয়ার সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে তারা বিভ্রান্ত হয়।
তাই এমন অবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের মানসিক সহনশীলতা ও দৃঢ়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন যে, একবার একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফলাফলের কারণে দুঃখ পায়। তার দৃষ্টিতে পরীক্ষার ফলাফল ভালো নয়, বাবা-মাকে সরি বলা উচিত। কারণ, সে আরো ভালো করে বেশি টাকা উপার্জন করে বাবা-মার ঋণ শোধ করতে চেয়েছিল। তার কথা শুনে শিক্ষক ওয়াং অবাক হন। কারণ, এ ছাত্র শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ তার নিজের দক্ষতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। আত্মবিশ্বাস ও ভালো চাকরির মানদন্ড এবং মানুষের জীবনের তাত্পর্য সম্পর্কেও তার সঠিক ধারণা নেই। তাই পরামর্শক হিসেবে তাদের উপযোগী ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া জরুরি।
চীনের হারবিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শক লিউ থিয়ে বলেন, স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মজীবনের পরিকল্পনা প্রণয়ন নিয়ে একটি ক্লাস নেন তিনি। তাতে চাকরির সাক্ষাত্কারের পদ্ধতি ও উপযোগী চাকরি খুঁজে পাওয়ার পদ্ধতি এবং সিভি রচনার টিপসসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। তবে অনেক ছাত্রছাত্রী এ ক্লাসের ওপর গুরুত্ব দেয় না। তারা মোবাইল ফোনে গেমস খেলে বা হোমওয়ার্ক করে। মনোযোগ দিয়ে তার ক্লাস শুনতে চায় না। তাই ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরামর্শ দেওয়া এবং তাদের মনোযোগ দিয়ে পরামর্শকের কথা শোনার পদ্ধতি নিয়ে আরো গবেষণা করতে হবে।
শিক্ষক ওয়াং সিন ই খেয়াল করেন যে, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। তাই তাদের মানসিক চাহিদাও ভিন্ন। একজন শিক্ষার্থীর ভিন্ন পর্যায়ের মানসিক চাহিদা ও বিভ্রান্তির বিষয়ও ভিন্ন। যেমন, অনার্স শিক্ষার্থীদের প্রথম বর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর সময়। তখন আশেপাশের নতুন বিষয় নিয়ে তাদের ব্যাপক কৌতুহল থাকে। দ্বিতীয় বর্ষে তাদের পরীক্ষা, প্রেম, সহপাঠীদের সাথে সম্পর্কসহ বিভিন্ন চাপের সম্মুখীন হতে হয়; তৃতীয় বর্ষে অনেক ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় এবং স্নাতক হওয়ার পর কর্মজীবনের জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
যদি পরামর্শকরা ভিন্ন পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের মানসিক চাহিদা ও চেতনা সঠিক বুঝেন, তাহলে তাদের জন্য উপযোগী পরামর্শ দিতে পারেন। এমন বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে শিক্ষক লিউ থিয়ে প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আরো উপযোগী শিক্ষার বিষয় যুক্ত করেছেন। যেমন, জাতীয় উন্নয়নের কৌশল, পেশাদার ভবিষ্যত বিশ্লেষণ, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ইত্যাদি। এভাবে তার কর্মজীবন পরিকল্পনা ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ক্লাসে পরিণত হয়েছে। তিনি ২০২১ সালে চীনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পরামর্শকের পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি মনে করেন, যুবক-যুবতীদের বড় হওয়ার পথে সহায়তা দেওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার এবং পরামর্শকদের জন্য এটা ভারী দায়িত্ব। ছাত্রছাত্রীদের মনের কাছাকাছি যেতে হবে, আর তখনই তাদের উপযুক্ত পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা সম্ভব।
(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)