পুরান বই কোথায় যায়?
2024-02-07 16:07:06

২০২৩ সালের শরত্কাল থেকে শাংহাই শহরের সু চৌ নদীর পাশে চেরি ফুল ভ্যালি পুরান বইয়ের মেলা চালু হয়। মেলায় আসেন দুই প্রবীণ ব্যক্তি। তবে সেখানে তারা পুরান বই কেনেন না, বরং নিজের পুরান বইয়ের জন্য একটি নতুন ‘বাসা’ খোঁজেন। সু দাদা জানান, তিনি ও তার স্ত্রী বই ভালবাসেন এবং বিয়ের সময় থেকে দুজন অনেক বই কিনেছেন। বাসায় বইগুলো রাখতে বড় দুটো বইয়ের আলমারি কিনেছিলেন। এখন তাদের বয়স হয়েছে এবং যুবকরা তেমন বই পড়েন না। তাই তারা নিজেদের বইয়ের জন্য একজন নতুন মালিক খুঁজতে চান।

 

২০২৩ সালে, শাংহাইয়ের একটি প্রাচীন পত্র ও বইয়ের দোকানে আসেন একটি দম্পতি। তারা হংকংয়ে বাস করেন। তাদের ৯০ বছর বয়সী বাবা তাদের জন্য অনেক পুরান বই রেখে গেছেন। তার বাবা জানিয়েছেন, তিনি শাংহাইয়ের এ দোকান থেকে সব বই কিনেছিলেন এবং তাদেরকে বইগুলো দোকানে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তাদের মতো অবস্থা চীনে এখন খুব স্বাভাবিক। প্রবীণ ব্যক্তিরা মারা যাবার পর তাদের ছেলে-মেয়েরা এ বইগুলো এমন জায়গায় দিতে চান, যেখানে এগুলো কাজে লাগে।

 

একই বছর, শাংহাইয়ের একটি জাদুঘরের ডকুমেন্টেশন বিভাগের উপ-পরিচালক লিউ মিং হুই নাগরিক হটলাইনে একটি কল পান। কলটি করেছেন ওয়াং লিয়ান লিন নামের ৮০ বছর বয়সী এক ভদ্রমহিলা। তিনি ওই সংস্থাকে অপেরা সম্পর্কিত পাণ্ডুলিপি ও প্রকাশনা দান করতে চান। এসব বই তার স্বামী সংরক্ষণ করেছিলেন। তিনি একজন সংগীত অনুবাদক এবং শাংহাই অর্কেস্ট্রার পরামর্শদাতা ছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশি অপেরা ও সংগীত অনুবাদ করেছিলেন। ২০২২ সালের জুলাই মাসে তিনি মারা যাওয়ার পর স্বামীর এসব সংরক্ষণ কার কাছে রাখবেন এ ব্যাপার নিয়ে ওয়াং লিয়ান লিং চিন্তিত হয়ে পড়েন।

 

লিউ মিং হুই সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে দাদি ওয়াংয়ের বাসায় গিয়ে এসব স্ক্রিপ্ট দেখেন। দেখেশুনে তারা জানান, এগুলোর মধ্যে ১ বাক্স হাত লেখা স্ক্রিপ্ট তাদের যাদুঘরে সংরক্ষণ করা সম্ভব, তবে বাকি প্রায় ৩০ বাক্স বই তারা নিতে পারবেন না। ওয়াং লিয়ান লিন চান আরও বেশি মানুষ এসব বই দেখুক। তাই প্রতিদিন তিনি বিভিন্ন সংস্থাকে ফোন দেন এবং আশা করেন, তারা এ বই নিবেন। পরে একটি প্রবীণ কমিউনিটি এ বইয়ের কিছু অংশ গ্রহণ করে এবং কমিউনিটি যাদুঘরে বিনামূল্যে প্রবীণদেরকে এ বই পড়ার সেবা প্রদান করে।

 

বই সংবেদনশীল মূল্য বহন করে, তবে সবাই এটা বুঝতে পারে না। তাই কে পুরান বই সংগ্রহ করতে পারেন, সেটা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন।

 

সিয়াও চু বুক শপ শাংহাইয়ের বৃহত্তম ব্যক্তিগত বইয়ের দোকান। ২০২৩ সালের শেষ দিকে এ দোকান বড় সংকটে পড়ে। তাদের দুটি গুদামের ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয় এবং তাদের ১ লাখ ৮ হাজার বই রাখার জন্য জায়গার দরকার হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্যে সিয়াও চু বই দোকানের মালিক চু ফেং থাও ১ লাখ বই হুনান প্রদেশের ইউয়ে ইয়াং শহরে দান করেন। বইগুলো নিয়ে কয়েকটি ট্রাক হাজার কিলোমিটার দূরে ইউয়ে ইয়াং শহরে যায়। অন্যদিকে সিয়াও চু বইয়ের দোকানের খবর শুনে অনেক পাঠক সাহায্যে এগিয়ে আসেন। একটি আর্ট পার্ক বই রাখার জন্য চুকে একটি জায়গা দেয়। ভবিষ্যতে এ আর্ট পার্কে একটি সিয়াও চু বইয়ের দোকান চালু হবে।

 

বইয়ের দোকানের মালিক চু ফেং থাওয়ের বয়স এখন ৬৬ বছর। তার বাবা গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে শাংহাই শহরে এসেছিলেন। প্রথমে সড়কে ছোট একটি বইয়ের স্টল খুলেছিলেন। ১৯৮০ দশকে চু ফেং থাও বইয়ের ব্যবসায় যোগ দেন। নব্বইয়ের দশকে যখন শাংহাইয়ে সাবওয়েতে প্রথম বইয়ের দোকান চালু হয়, তখন ৪০ বছর বয়সী চু ফেং থাও ছিলেন এ দোকানের প্রথম দায়িত্বশীল ব্যক্তি।

 

২০১১ সালে দোকানের ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয়। একটি কমিউনিটি বিনা ভাড়ায় চুকে একটি দোকান দেয়। সেকারণে চু তার বইয়ের দোকানে থাং ছিয়াও কমিউনিটিতে স্থানান্তর করেন। কঠিন হলেও সিয়াও চু বইয়ের ব্যবসা অব্যাহত রাখেন। এখন চু ফেং থাওয়ের ছেলে চু চুন ফেং বাবাকে দোকান ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করেন। তবে তার পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম এ ব্যবসা ধরে রাখবে কিনা তা নিশ্চিত নয়।

 

পুরান বইয়ের সংগ্রহ সহজ ব্যাপার নয়। সাধারণ মানুষ প্রশিক্ষণ না নিলে এ কাজ করতে পারেন না। পেশাদার ব্যক্তিরা সহজেই বইয়ের দাম বুঝতে পারেন এবং বইকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করতে পারেন। তারা কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং তা যুবকদের শিখিয়ে দেন।

 

পুরান বইমেলার দর্শকের মধ্যে অধিকাংশ প্রবীণ। যুবক-যুবতীরা প্রধানত দেখতে আসেন এবং পুরান বইয়ের প্রতি তাদের তেমন আগ্রহ নেই। তবে সেকেন্ড-হ্যান্ড ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে যুবকরা পুরান বই বিনিময় বা বিক্রয়-ক্রয় করেন। ২০১৭ সালে তুও চুয়া ইউয়ু নামে একটি  সেকেন্ড-হ্যান্ড ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম চালু হয়। কিউআর কোড স্ক্যান করে ওয়েচ্যাট থেকে এ প্ল্যাটফর্মে ঢোকা যায়। পুরান বইয়ের বারকোড স্ক্যান করলে বইয়ের সব তথ্য দেখা যায় এবং প্ল্যাটফর্মও জানাতে পারে এ বই তাদের সংগ্রহ আছে কিনা বা না থাকলে সংগ্রহ করতে পারবে কিনা। এ প্ল্যাটফর্ম বই সংগ্রহ করে জীবাণুমুক্তকরণ এবং প্যাকেজিং করার পর আবার বিক্রি করে। এখানে নিজের পছন্দের বইয়ের নাম দিয়ে সার্চ করা যায় এবং সে বই থাকলে, কম দামে কেনা যায়। যদি না থাকে তাহলে তারা আপনার চাহিদা রেকর্ড করবে, যখন এ বই আসবে আপনাকে ম্যাসেজ পাঠাবে। এমন পদ্ধতি যুব মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

 

২০২০ সালে তুও চুয়া ইউয়ু একটি দোকান খোলেন। ৬৮১ বর্গমিটারের এ দোকানে দ্বিতীয় তলায় বিক্রি হয় পুরান বই আর তৃতীয় তলায় পুরান পোশাক। যুবক-যুবতীরা এখানে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। তবে প্রবীণদের জন্য অনলাইন কেনাকাটা পরিচিত পদ্ধতি নয়। তাছাড়া গত শতাব্দীর নব্বইয়ে দশক বা তার আগে প্রকাশিত বইয়ের বারর্কোড অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারে না।

 

শাংহাইয়ে যুবাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গন্ডার নামে একটি বইয়ের দোকান। এর মালিক চুয়াং চিয়ান কুও ১৭ বছর বয়সে শাংহাইয়ে কাজ শুরু করেন। তার প্রথম চাকরি ছিল গন্ডার নামের একটি বইয়ের দোকানে। তাই পরে তিনি যখন নিজের বইয়ের দোকান খোলেন তখন গন্ডার নামটিই ব্যবহার করেন।

 

চুয়াং শুধু বই বিক্রি করেন না, তিনি একজন কবিতা অনুরাগী এবং পাঠকের জন্য ভাল বইয়ের সুপারিশ করতে পারেন। তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিনের কাজ রেকর্ড করেন। একদিনে কত পুরান বই বিক্রয় করেন বা সংগ্রহ করেন তা সব রেকর্ড করেন।

 

গত বছরের ২৭ মে, শাংহাই জাদুঘরের উদ্যোগে একটি বই বিনিময় অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। নাগরিকরা দুটি পুরান বই দিয়ে একটি নতুন বই বিনিময় করতে পারেন। এদিন দুটি জায়গায় এ আনুষ্ঠান হয় এবং মোট ৫ হাজার পুরান বই বিনিময় হয়। অনেকে আশা করেন, এমন অনুষ্ঠান পরে যাদুঘর, বইয়ের দোকান ও ক্যাফেতে আরও হবে।(শিশির/রহমান/রুবি)