চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
2024-02-05 20:40:33

 

৫৬তম পর্বে যা থাকছে:

 

* মস্তিষ্কের অক্সিজেন পর্যবেক্ষণে সক্ষম ক্ষুদ্র রোবট তৈরি

* চীনে ১৪ মিটার লম্বা ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কার

* এইপ বিলুপ্তির রহস্য উদঘাটন

 

 

মস্তিষ্কের অক্সিজেন পর্যবেক্ষণে সক্ষম ক্ষুদ্র রোবট তৈরি

মস্তিষ্কের কাজে জ্বালানি হলো অক্সিজেন। প্রাণীদেহে মস্তিষ্কই সবচেয়ে বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করে। যদি কোনও  প্রাণীর মস্তিস্কে অক্সিজেন প্রবেশ বাধা প্রাপ্ত হয় কিংবা এর মাত্রায় তারতম্য ঘটে তখনই দেখা দেয় প্রাণহানির আশঙ্কা। এক মিনিটের মধ্যেই অক্সিজেনের অভাবে মরতে শুরু করে মস্তিষ্কের কোষগুলো। তিন মিনিটের মাথায় নিউরনগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৫ মিনিট অক্সিজেন ছাড়া থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পর্যবেক্ষণে এবার চীনের বিজ্ঞানীরা ক্ষুদ্র একটি রোবট তৈরি করেছেন।

মস্তিষ্কের রোগ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি দ্রুত মস্তিষ্কে অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয় করতে সক্ষম এমন একটি ক্ষুদ্র রোবট তৈরি করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি নেচার ফটোনিক্স জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিস্থাপনযোগ্য এ ক্ষুদ্র রোবটটির ব্যাস প্রায় ৩০০ মাইক্রন। এটি আলো-নিঃসরণকারী ডায়োড এবং একটি ফটোডিটেক্টর নিয়ে বানানো। এ ছাড়া রোবটটি অক্সিজেনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি ফসফরেসেন্ট ফিল্মের প্রলেপযুক্ত।

রোবটটি ফসফোরেসেন্স নির্গত করে এবং আলোর ঔজ্জ্বল্যের মাধ্যমে অক্সিজেনের মাত্রা বের করে। অক্সিজেনের মাত্রা কমলে এটি আলো ছড়াবে এবং বাড়লে আলো কমাবে।

গবেষণাপত্রের লেখক এবং গবেষকদলের সদস্য শেং সিং জানান, যখন মস্তিষ্কের টিস্যুতে হাইপোক্সিয়া তথা অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়, তখন রোবটটি থেকে শক্তিশালী আলো নির্গত হবে। এ প্রতিক্রিয়া জানাতে এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগবে রোবটটির।

ওয়্যারলেস রোবটটি ইঁদুরের মস্তিষ্কে অক্সিজেনের স্তর সফলভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। পরীক্ষার সময় ইঁদুরটি মুক্তভাবে চলাচল করছিল। রোবটটি ইস্কেমিয়াসহ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রিব্রাল হাইপোক্সিয়া অবস্থা  শনাক্ত করতে পারে।

এ রোবটটি মানব মস্তিকসহ নানা ধরনের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে মৃগী, মস্তিষ্কের টিউমার, স্ট্রোক এবং ইন্ট্রাক্রানিয়াল ট্রমা রোগীদের জন্য ক্ষুদ্র এই রোবটটি সম্ভাবনাময় চিকিৎসা সরঞ্জাম হিসেবে কাজ করবে।

ক্যাপিটাল মেডিকেল ইউনিভার্সিটি এবং বেইজিং ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির সঙ্গে যুক্ত সুয়ানউ হাসপাতালসহ আরও কিছু চীনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একজোট হয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির গবেষকরা।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

চীনে ১৪ মিটার লম্বা ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কার

সাড়ে ২৪ কোটি বছর আগে থেকে শুরু তাদের পথচলা। এরপর সাড়ে আঠার কোটি বছরেরও বেশি সময় পৃথিবীতে ছিল তাদের রাজত্ব। বলছিলাম ডাইনোসরের কথা। ধারণা করা হয় পৃথিবীতে ছিল মোট হাজার প্রজাতির ডায়নোসর। তাদের নিয়ে লেখা হয়েছে হাজারো বই, তৈরি হয়েছে ব্লকবাস্টার সব চলচ্চিত্র। এমনকি এ যুগেও ডায়নোসর নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান থেমে নেই। বরং পাওয়া যাচ্ছে নিত্য নতুন সব তথ্য । সম্প্রতি ডাইনোসরের নতুন এক প্রজাতির সন্ধান পেয়েছে চীনা বিজ্ঞানীরা।

১৪ মিটার লম্বা ডাইনোসরের একটি নতুন প্রজাতির জীবাশ্ব আবিষ্কার করেছেন চীনের জীবাশ্ববিদরা। তারা এর নাম দিয়েছেন গানডিটাইটান ক্যাভোকডাটাস। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণার ফলাফল জার্নাল অব সিস্টেম্যাটিক প্যালিওন্টোলজির সর্বশেষ সংস্করণে প্রকাশ করা হয়েছে।

২০২১ সালের জুনে পূর্ব চীনের চিয়াংসি প্রদেশের কানচৌয়ের কানসিয়ান জেলায় একটি প্রকল্পে চলছিল নির্মাণ কাজ। আর সে সময় জীবাশ্মগুলো নজরে আসে। দেশটির চিয়াংসি প্রদেশের ভূতাত্ত্বিক যাদুঘর জানিয়েছে এ তথ্য।

নির্মাণাধীন সাইটে আবিষ্কার করা হাড়গুলো পুনরুদ্ধার ও গবেষণার জন্য জাদুঘরকে সহযোগিতা করেছে উহানের চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্সেস এবং চিয়াংসি জিওলজিক্যাল সার্ভে অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশন ইনস্টিটিউট।

এ প্রকল্পের প্রধান গবেষক চায়না ইউনিভার্সিটির হান ফেংলু জানান, নতুন প্রজাতিটি টাইটানোসরিয়ান সরোপড প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।

আবিষ্কৃত হাড়গুলো মিলিয়ে দেখা গেল এতে ডাইনোসরের কঙ্কালের প্রায় ৪০ শতাংশই আছে। এমন পরিপূর্ণ দেহাবশেষ পাওয়ার ঘটনা বিশ্বে বিরল।

গবেষকরা প্রাথমিকভাবে অনুমান করছেন এই ডাইনোসরের একটি বড় ঘাড় ও ৫ মিটার লম্বা লেজ ছিল।

বিজ্ঞানী বলছেন, প্রায় ২০ কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগের প্রথম দিকে সরোপড ডাইনোসরের আবির্ভাব ঘটে। ক্রিটেসিয়াস যুগের শেষ অবধি এদের বিচরণ ছিল।

এর আগে মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশে কামানের গোলা আকারের ডাইনোসরের ৩১টি ডিমের জীবাশ্ম বা ফসিল আবিষ্কার করেছিলেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে তিনটি ডিমের মধ্যে ভেতরের খনিজগুলো ক্রিস্টাল অবস্থায় পেয়েছেন তারা।

এ ছাড়া বিশ্বের প্রাচীনতম দন্তহীন উড়ন্ত সরীসৃপ টেরোসরের নতুন এক প্রজাতির ফসিলের সন্ধানও পান আরেক দল চীনা বিজ্ঞানী।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

এইপ বিলুপ্তির রহস্য উদঘাটন

বানরের মতো দেখতে লেজবিহীন প্রজাতি হলো 'এইপ'। গরিলা, ওরাং-ওটাং, শিম্পাঞ্জি এসব প্রাণী ‘এইপ'-এর অন্তর্ভুক্ত, এবং উল্লুক হচ্ছে সবচেয়ে ছোট জাতের 'এইপ'। এই এইপের মধ্যে একটি এইপ ছিল বিশালাকৃতির। যাকে বলা হতো জায়ান্ট এইপ। পৃথিবী থেকে এই অতিকায় এইপের বিলুপ্তির কারণ নিয়ে গবেষকদের কৌতূহলের অন্ত নেই। সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী উদঘাটন করেছেন এইপ রহস্য।

এক সময় দক্ষিণ চীনের কার্স্ট সমভূমিতে বিচরণ করত জাইগান্টোপিথেকাস ব্ল্যাকি, বা জি ব্ল্যাকি নামে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এইপ। তিন মিটার লম্বা এ প্রাইমেটগুলোর ওজন হতো ৩০০ কেজিরও বেশি। অঞ্চলটিতে মানুষের আগমনের বহু আগে ২ লাখ ৯৫ থেকে ২ লাখ ১৫ হাজার বছর আগেই এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এইপটি কখন ও কীভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল সেই রহস্যটাই এবার জানা গেল চীন, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের গবেষণায়। সম্প্রতি নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এ গবেষণার বিস্তারিত।

এ রহস্য উদঘাটনের ফলে এইপের বিলুপ্তি নিয়ে প্রচলিত গল্পগাথাওদূর হয়ে যাবে।

১৯৩৫ সালে প্যালিওনথ্রোপোলজিস্ট রাল্ফ ফন কোয়েনিগসওয়াল্ড দীর্ঘকায় এইপের নামকরণ করেন জি. ব্ল্যাকি। ‘ব্লাকি’ দেওয়া হয়েছিল কানাডিয়ান অ্যানাটমিস্ট ডেভিডসন ব্ল্যাকের সম্মানে, যিনি চীনে মানব বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রায় দুই সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের একটি দাঁতের উপর ভিত্তি করে এ রহস্য উদঘাটন করেছেন গবেষকরা।

১৯৫০ সাল থেকে কুয়াংসি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে ওই এইপের প্রায় ২ হাজার দাঁতের জীবাশ্ম এবং চারটি চোয়ালের হাড় পাওয়া গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত ঘাড়ের নিচের বা চোয়াল পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি।

চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের মেরুদণ্ডী জীবাশ্মবিদ্যা এবং প্যালিওনথ্রোপলজি ইন্সটিটিউটের গবেষণাপত্রের সহ-প্রধান লেখক, চাং ইংছি জানান, জি. ব্ল্যাকির গল্পটি প্যালিওনথ্রোপলজিতে একটি রহস্যময় বিষয়।

২০১৫ সালে চাং এবং তার সহকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেন। তারা কুয়াংসির বিভিন্ন পাহাড়ের মধ্যে একটি গভীর অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অনুসন্ধান করে ২২টি গুহা সাইট থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করেন গবেষকরা। এর মধ্যে অর্ধেক সাইটে জি. ব্ল্যাকির তথ্য পাওয়া গেছে এবং ১১টিতে যেখানে কোনও তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গবেষক দলটি গুহার পলি এবং জীবাশ্মের জন্য ছয়টি ডেটিং কৌশল ব্যবহার করেছেন। ১৫৭টি ফলাফলে দেখা গেছে এই প্রজাতিটি ২ লাখ ৯৫ বা ২ লাখ ১৫ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে।

দৈত্যকার প্রাণী ঘন অরণ্যে ঘুরে বেড়িয়েছিল ৭ লাখ বছর আগে। যদিও পরবর্তী ৪ লাখ বছরে, তাদের পছন্দের আবাসস্থলগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠতে থাকায় তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে শুরু করে।

অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটির রেনড জোয়ানেস-বয়াউ জানান, দাঁত পর্যবেক্ষণ করে প্রাণীগুলোর আচরণের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। এর মাধ্যমে তাদের মানসিক চাপ, খাদ্য, খাদ্যের উৎস, বৈচিত্র্য এবং আচরণের তথ্য মিলেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, জি. ব্ল্যাকি কম পুষ্টিকর, উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের ওপর নির্ভর করতো। তবে বাসস্থান ও খাবার কমে আসায় ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী