চীনের অন্যরকম শিক্ষক চং কুয়াং ছুনের গল্প
2024-02-05 15:00:25

২০২৪ সালের বসন্ত উত্সব আসন্ন। চীনাদের জন্য বসন্ত উত্সব একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্সব। এটি কেবল আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মিলনের মুহূর্ত নয়, বরং গত বছরকে বিদায় জানানো এবং নতুন বছরের নতুন সাফল্য অর্জনের প্রত্যাশার সাথেও সম্পর্কিত। শিশু-কিশোরদের কাছে বসন্ত উত্সব একটু বেশি আনন্দের। কারণ, তাঁরা লাল খামে টাকা পাবে, নতুন কাপড়চোপড় পরবে, এবং অন্যান্য উপহার পাবে। বড়দের জন্য এ উত্সবের তাত্পর্য আলাদা। যারা বাবা-মার সাথে থাকেন না, এমন বড়দের জন্য শুধু বসন্ত উত্সব বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ। বসন্ত উত্সব বড় পরিবারের পুনর্মিলনের মুহূর্ত। তবে, যারা পরিবারের কোনো সদস্যকে হারিয়েছেন, তাদের জন্য বসন্ত উত্সব একটি দুঃখের সময়। কারণ, অন্যদের পরিবারে সবার পুনর্মিলন দেখে তাদের মনে দুঃখ লাগা স্বাভাবিক।

গত ৪ নভেম্বর চীনের চিয়াংসু প্রদেশের নানচিং শহরের রুইচিন উত্তর গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের প্রেসিডেন্ট চং কুয়াং ছুন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। টানা ২ বছর ধরে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতে হয়েছে এবং তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন মাত্র ৫৭ বছর বয়সে।

শিক্ষক চং কুয়াং ছুন অন্যান্য স্কুলের শিক্ষক ও নিজের স্কুলের শিক্ষার্থীদের মনে কী ধরনের শিক্ষক ছিলেন? আসুন, একটু জেনে নিই।

ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতা সৃষ্টিতে ও তাদেরকে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলতে শিক্ষক চং বিশেষ প্রস্তুতি নিতেন। যেমন, তাঁর ক্লাস শুরুর আগে তিনি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একটি তালিকা দিতেন, যাতে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের আগে নিজের পড়াশোনার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতো। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের প্রদর্শন, আলোচনা ও অনুশীলনসহ বিভিন্নভাবে তিনি শেখাতেন। তিনি ক্লাসরুমের পিছনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, যদি ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই পড়াশোনার বিষয় বুঝতে পারে বা সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম, তাহলে শিক্ষকদের কাজ থেকে অতিরিক্ত কোনো সাহায্য দেওয়ার দরকার নেই।

২০০৬ সাল থেকে শিক্ষক চংয়ের নেতৃত্বে শিশুদের প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে গুণগত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিস্তারিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নিজের শিক্ষকতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের নিজেদের প্রচেষ্টায় সংশ্লিষ্ট জ্ঞান অর্জন করা এবং ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে সবার সাথে পড়াশোনার অনুভূতি শেয়ার করা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের শুধু কিছু আনুষঙ্গিক কাজ করলেই চলে।

এমন নতুন শিক্ষাপদ্ধতি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। ১০ বছরের মধ্যে শিক্ষক চং এবং তাঁর সহকর্মীদের যৌথ প্রয়াসে, ‘নিজে নিজে পড়া’-র ধারণার ওপর ভিত্তি করে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি চীনের ১০টিরও বেশি প্রদেশের শতাধিক প্রাথমিক স্কুলের ২০ সহস্রাধিক শিক্ষকের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বস্তুত, এমন ক্লাসের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে পড়াশোনা করে থাকে, তাদের দৃঢ় জ্ঞানের ভিত্তি অর্জিত হয়, এবং নিজে নিজে পড়াশোনার দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। তখন তারা অজানা বিষয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন করতে উত্সাহিত হয়। এ সম্পর্কে বেইজিং দ্বিতীয় শিইয়ান প্রাথমিক স্কুলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুয়া ইং লং বলেন, শিক্ষক চংয়ের ক্লাসে বোরিং লাগে না, বরং শিক্ষার্থী মজা পায়।

চীনের শানতুং প্রদেশের জিবো শহরের কুয়ানচং প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ওয়াং লি সিয়া বলেন, ‘শিক্ষক চং সবসময় আমাদের বলেন যে, শিক্ষকরা যেন মৌমাছি পালনকারীর মতো ছাত্রছাত্রীদের ‘ফুটন্ত ফুলের জায়গায়’ নিয়ে যান; সেখানে পৌঁছার পর তারা নিজেরাই মধু সংগ্রহের কাজ করে। ২০১৪ সালে শিক্ষক চং জিবো শহরে গিয়ে শিক্ষক ওয়াংয়ের স্কুলে একটি ক্লাসে অংশ নেন। সেই ক্লাস ওয়াং’র ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। গত কয়েক বছরে তিনি মনোযোগ দিয়ে ‘পাঠ্যপুস্তকের ক্লাস’ থেকে ‘প্রাণবন্ত ক্লাস’-এ উত্তরণে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এভাবে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে বসে নতুন জ্ঞান অর্জনের সময় গল্প শোনার মতো আরও সহজভাবে তা অর্জন করতে পারে।

চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের তুংকুয়ান শহরের শিলং জেলার প্রাথমিক স্কুলের গণিত শিক্ষক তু চিউ’র দৃষ্টিতে শিক্ষক চংয়ের ‘সহকারী ক্লাস’ চিন্তাধারা বেশ বাস্তব ও কার্যকর। কারণ, এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, বরং এতে ক্লাসের পড়াশোনার মৌলিক কাঠামো নির্ধারিত হয়, এবং এভাবে শিক্ষকরা সহজে চর্চা করতে পারেন। শিক্ষক চং টানা ৩ বার শিলং জেলার প্রাথমিক স্কুলে আসেন। শিক্ষক তু চিউ’র দৃষ্টিতে ক্লাসের ডায়াসে দাঁড়িয়ে গেলে শিক্ষক চংয়ের বেশ উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় চেহারা দেখা যায়। তাঁর ক্লাস করে শিক্ষার্থীরা বেশ মজা পায়। প্রতি সেমিস্টারে স্কুলের ১০ জন শিক্ষক রুইপেই প্রাথমিক স্কুলে ইন্টারশিপ করতে যান। প্রতিবার এক মাস থাকেন। এভাবে গত কয়েক বছরে শিলং জেলার বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক চংয়ের ‘সহকারী ক্লাস’ পদ্ধতি চালু হয়েছে এবং জেলার ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ফলাফলও শহরে শীর্ষস্থানে দাঁড়িয়েছে।

২০২৩ সালে চীনের ইনার মঙ্গোলিয়ার উহাই শহরের হাইবোওয়ান এলাকার ২ নম্বর প্রাথমিক স্কুলের প্রেসিডেন্ট মা রং টানা ৩ বার শিক্ষকদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট ‘সহাকারী পড়াশোনা পদ্ধতি’ শিখতে রুইপেই প্রাথমিক স্কুলে আসেন। প্রতিবার শিক্ষক চং স্কুলের দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁদের স্বাগত জানান। শিক্ষক মা মনে করেন, শিক্ষক চংয়ের পড়াশোনার পদ্ধতি সহজ এবং ছাত্রছাত্রীদের নিজে নিজে পড়াশোনার দক্ষতার উন্নয়নে বেশ কার্যকর। মা যখন তৃতীয়বার রুইপেই প্রাথমিক স্কুলে যান, তখন শিক্ষক চংয়ের শরীরে অসুস্থতা খেয়াল করেন। তবে তিনি বিশ্রাম নেননি, বরং বাইরে থেকে আসা শিক্ষকদের সাথে তাঁর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। তিনি আরও বেশি শিক্ষকের কাছে তাঁর শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও চেতনা তুলে ধরতে চাইতেন। যখন শিক্ষক চংয়ের মৃত্যুর খবর পেলেন, তখন ইনার মঙ্গোলিয়ার হাইবোওয়ান ২ নম্বর প্রাথমিক স্কুলের অনেক শিক্ষক কাঁন্নাকাটি করেন। কারণ, শিক্ষক চং তাঁর শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহের জন্য সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।

চীনের বিভিন্ন এলাকার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের দৃষ্টিতে শিক্ষক চংয়ের ‘সহকারী পড়াশোনা ক্লাসের’ মাধ্যমে আরো বেশি শিক্ষার্থী স্বাধীন চিন্তাভাবনা ও নিজে নিজে পড়াশোনার দক্ষতা অর্জন করে। শিক্ষক চং সবসময় বলতেন, একটি আপেল ও আরেকটি আপেল যুক্ত হলে মাত্র ২টি আপেল হয়, তবে দু’জন শিক্ষার্থীর চিন্তাভাবনা যোগ হলে আরো বেশি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

এ সম্পর্কে রুইপেই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা গবেষণা বিভাগের পরিচালক শেন ছুন সিয়া বলেন, “আমাদের প্রাথমিক স্কুলের ক্লাসে বাচ্চারা ব্যাপক কথা বলার সুযোগ পায়। তাদের আত্মপ্রকাশের গড় সময় ৬৭.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা ক্লাসে বড় ভুমিকা রাখে।”

শিক্ষক চংকে স্মরণ করে চিয়াংসু প্রদেশের শিক্ষা ও বিজ্ঞান একাডেমির ভাইস প্রেসিডেন্ট চাং সিয়াও তুং বলেন, ‘শিক্ষক চংয়ের বিশেষ কারিশমা ছিল। তাঁর আন্তরিকতা ও সরলতা বেশ মুগ্ধকর।’

ছেলের স্মৃতিতে বাবা

শিক্ষক চং কুয়াং ছুনের ছেলে চং থিয়ান ছি একজন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষক। প্রতিদিন তাঁকে গবেষণার কাজে অনেক ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। ছোটবেলায় বাবার সাথে তার স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, “যখন আমি দুষ্টুমি করতাম, আমার বাবা কখনও আমাকে মারতেন না। তিনি মনে করতেন, বাবা-মার কখনও বাচ্চাকে পিটুনি তেওয়া উচিত নয়। পিটুনি পিতামাতার পরিবারিক শিক্ষার ব্যর্থতার প্রতিফলন।” ছোটবেলার গল্প স্মরণ করে গবেষক চং থিয়ান ছি বলেন, “একবার আমার দুষ্টুমির কারণে শিক্ষক বাবাকে স্কুলে ডাকলেন। বাবা আমাকে পিটুনি দিলেন না। তবে, আমার সাথে শিক্ষকের কার্যালয়ের বাইরে ১০ মিনিট দাঁড়িয়েছিলেন। বাসায় ফিরে আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম। তবে, বাবা বললেন, তুমি শিক্ষকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে একটি চিঠি লিখে দাও। পরে তিনি বই পড়তে পড়তে আমার চিঠির অপেক্ষা করতে থাকেন। সেই স্মৃতি আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে।”

ছেলে চং আরও বলেন, ওই ঘটনার পর তিনি বাবার পাশে বসে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করেন। বিদেশে পড়াশোনার সময় চং থিয়ান ছি বাবার ‘সহকারী পড়াশোনা ক্লাসের’ প্রকল্প সম্পর্কে জানতে পারেন। বাবার নিরলস প্রচেষ্টা তাঁকে আরও মনোযোগ দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা করতে উত্সাহ দিয়েছে। তিনিও বাবার মতো মনোযোগ দিয়ে আরও অনেক তাত্পর্যপূর্ণ কাজ করতে চান।

গত বছরের অক্টোবর মাসে শরীরের অসুস্থতার কারণে শিক্ষক চং হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে, বই ও কম্পিউটার নিয়ে যান হাসপাতালে। তাঁর স্ত্রী ইয়ু সু ছিন বলেন, “আমার স্বামী যত দ্রুত সম্ভব তাঁর শিক্ষাদানসংশ্লিষ্ট গবেষণার ফলাফল সংগ্রহ করতে চান। আরও বেশি শিক্ষার্থীর উপকার করতে চান।” অক্টোবর মাসে অসুস্থতার কারণে কেবল বিছানায় শুয়ে থাকেন শিক্ষক চং। তবে, যতক্ষণ জেগে থাকতেন, ততক্ষণ তিনি স্কুলের উন্নয়নের পরিকল্পনা করতেন। শিক্ষক চং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ৩০০ জনেরও বেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তাকে দেখতে যান। প্রতিদিন তাঁর রুমে লোকের আনাগোনা ছিল। তবে এক মাস পর তিনি দুনিয়া থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নেন।

শিক্ষক চংয়ের বড় ভাই সংবাদদাতাকে বলেন যে, ছোটবেলায় তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল ছিল, তাই পড়াশোনার মাধ্যমে ছোট ভাই চং কুয়াং ছুন নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেন। শিক্ষকতা তাঁর জন্য বিশেষ তাত্পর্য বহন করতো। তিনি এ পেশাটি বেশ ভালোবাসতেন। অসুস্থতার মধ্যেও তিনি শিক্ষকতার কাজ করার চেষ্টা করতেন। সেটিও তাঁর ছেলে চং থিয়ান ছির জন্য বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি বাবার মতো মন দিয়ে প্রিয় কাজ করতে শিখেছেন।

২০২৩ সালের পয়লা নভেম্বর শিক্ষক চং কুয়াং ছুনের জন্মদিন। হাসপাতালে তিনি পরিবারের সদস্যদের সাথে জন্মদিন পালন করেন। তবে, পরের কয়েক দিন কোনো খাবার খেতে পারেননি। ৪ নভেম্বর তিনি এই দুনিয়া ছেড়ে অন্য দুনিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ছেলে চং থিয়ান ছি বাবার প্রিয় কবিতার বই ‘বাচ্চাকে রক্ষার দূরত্ব’ পড়েন এবং কবিতা পড়তে পড়তে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।