ইউয়ে অপেরার অভিনেত্রী ছেন লি চুন
2024-02-01 17:29:00

সম্প্রতি চীনের একজন ইউয়ে অপেরার অভিনেত্রী বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। ২০২৩ সালের মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত ‘সিনলোংমেন সরাইখানা’ নামে তার অভিনীত একটি অপেরা ১৩০ বারেরও বেশি মঞ্চস্থ হয়েছে এবং প্রতিবারই দর্শকদের ভিড় ছিলো। সম্প্রতি ইন্টারনেটে তার অভিনীত এ অপেরার সরাসরি সম্প্রচারটি কোটি কোটি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

ছেন লি চুন এবং তার দলের প্রচেষ্টায় অনেক তরুণ দর্শক ইউয়ে অপেরা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এ অপেরাকে পছন্দ করতে শুরু করেন।

চীনের অপেরার কথা আসলে সবার মনে হয়তো ধীর গতির সুর ও সেকেলে নানা শব্দ মনে পড়ে। মানুষের পুরনো চিন্তাধারা হলো শুধুমাত্র বয়স্ক লোকেরা অপেরা শুনতে পছন্দ করেন। তবে এখন এমন ধারণা আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে।

১৯৯২ সালের মে মাসে চীনের চেচিয়াং প্রদেশের শেংচৌ শহরে জন্মগ্রহণ করেন ছেন লি চুন। তার জন্মস্থান ইউয়ে অপেরার উত্সস্থান হিসেবে পরিচিত।

মা-বাবার প্রভাবে শৈশবকালে ছেন লিচুন ইউয়ে অপেরায় আগ্রহী হন। ছোটবেলায় তিনি মা-বাবার সঙ্গে স্থানীয় অপেরা দলের পরিবেশনা উপভোগ করতেন।

মঞ্চে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জমকালো পারফরমেন্স তাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করতো। তখন ছোট ছেন লিচুন কল্পনা করতেন যে, ভবিষ্যতে একদিনে তিনি তাদের মতো মঞ্চে পরিবেশন করবেন।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ছেন লিচুনের সঙ্গীত শিক্ষক ইউয়ে অপেরা শিক্ষার ক্ষেত্রে তার জন্মগত প্রতিভা আবিষ্কার করেন। শিক্ষকের সুপারিশে ইউয়ে অপেরার সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য যাত্রা শুরু হয়। মেয়ের অপেরা শিখতে চাওয়ার কথা শোনার পর মা-বাবা একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। কারণ তারা জানতেন, অপেরা শেখা খুব কষ্টকর একটি পথ। তবে মাত্র ১৩ বছর বয়সী ছেন লিচুন মা-বাবাকে আন্তরিকভাবে বলেন, নিজের এই পছন্দ নিয়ে তিনি অনুতাপ করবেন না। এভাবে অনেক আবেগের সঙ্গে ছেন লিচুনের অপেরা শেখার যাত্রা শুরু হয়।

শুরুতে ছেন লিচুনের মৌলিক দক্ষতায় কিছুটা দুর্বল ছিলেন। পরিবেশনের সময় তিনি মাঝেমাঝে নিজের কথা বা মুভমেন্ট ভুলে যেতেন। শিক্ষক ও সহপাঠীরা মজা করে তাকে ‘আনাড়ি ছোট হাঁস’ বলে ডাকতেন।

প্রতিবন্ধকতা ছেন লিচুনকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। তিনি প্রতিদিন অনেক আগে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আয়নার সামনে বারবার মৌলিক দক্ষতার চর্চা করতেন। অনেক পরিশ্রমের পর তিনি খুব শক্ত মৌলিক দক্ষতা আয়ত্ত করেন।

অবশেষে প্রতিভা ও অধ্যবসায় উভয়ের অধিকারী ছেন লিচুন চেচিয়াং প্রদেশের ইউয়ে অপেরা দলে যোগদান করেন। অপেরা দলে তিনি ক্ষুদ্র সহায়ক চরিত্র থেকে শুরু করেন। প্রতিবার অনুশীলন বা পরিবেশনায় তিনি মঞ্চের দুপাশের পর্দার পিছনে মনোযোগ দিয়ে প্রবীণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পরিবেশনা পর্যবেক্ষণ করেন।

চীনে একটা কথা আছে, মঞ্চে ১ মিনিটের পরিবেশনার জন্য মঞ্চের বাইরে ১০ বছরের কঠোর পরিশ্রম লাগে। ইউয়ে অপেরার জন্ম চেচিয়াং প্রদেশের শেং জেলায়, চীনের ছিং রাজবংশের শাসনামলের মাঝামাঝি ও শেষের দিকে। এ অপেরাটি নরদার্ন অপেরা এবং হাই ইয়েন টোনের গান ও বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে ধাপে ধাপে নিজের বৈশিষ্ট প্রতিষ্ঠা করে।

ইউয়ে অপেরার চরিত্রগুলো মূলত ঐতিহ্যগত অপেরার সেটিংস অনুসরণ করেছিল এবং পুরুষ চরিত্র, নারী চরিত্র, পেইন্ডেট চরিত্র এবং ভাঁড় - এ চারটি চরিত্রে বিভক্ত। সাধারণত পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেন পুরুষ এবং তারা পণ্ডিত ও বীরসহ ইতিবাচক ব্যক্তিদের ভূমিকায় অভিনয় করেন। নারীরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেন।

তবে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই সেটিংস এখন আর উপযুক্ত নয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোনও কোনও নারী চরিত্রের অভিনয়শিল্পী ট্রান্সজেন্ডার অভিনয় করার চেষ্টা করতে শুরু করেন। এমন ধরনের অভিনয়ের পদ্ধতির জন্য একটি পেশাগত শব্দ আছে, চীনা ভাষায় ‘ফান ছুয়েন’ বা ক্রস-ড্রেসিং, অর্থাৎ নারী শিল্পীরা মঞ্চে পুরুষের চরিত্রে অভিনয় করেন।

ছেন লিচুনের জন্য জীবনের বড় চ্যালেঞ্জ শুরু হয় যখন তিনি নারী চরিত্র থেকে পুরুষ চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন । ২০০৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সী ছেন লিচুন পুরুষ চরিত্রে অভিনয়ের দক্ষতা শিখতে শুরু করেন।

২০১৩ সালে ছেন লিচুন একজন পেশাদার ইউয়ে অপেরার শিল্পী হয়ে ওঠেন। একই বছর তার জন্য দারুণ এক সুযোগ আসে। চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বা সিসিটিভি’র বড় আকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করার আমন্ত্রণ পান তিনি। আরও ভালোভাবে এ অনুষ্ঠানে নিজেকে উপস্থাপনের জন্য লিচুন দিনরাত ধরে কঠোর প্রশিক্ষণ নেন। অবশেষে তার পরিবেশনা অসংখ্য দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম হয়। তারপর লিচুন সিসিটিভি’র নিয়মিত অতিথি হিসেবে নানা অপেরা অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।

টিভি অনুষ্ঠানে ঘন ঘন আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লিচুনের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। তবে তিনি সফলতা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন না। তিনি যে বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তা করছেন তা হলো এই প্রাচীন শিল্পে প্রতি কীভাবে আরও বেশি দর্শক আকৃষ্ট হবে।

২০০৮ সালে সিসিটিভি’র বসন্ত উত্সব গালাতে লিচুন একজন পপ সঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গে সহযোগিতা করে শাওশিং অপেরা ও পপ সঙ্গীতের সমন্বিত এক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন এবং এ অনুষ্ঠানটি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

তখন লিচুন উপলব্ধি করেন যে, ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রতি তরুণ-তরুণীদের আগ্রহ আসলে কম নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে উপস্থাপন ও উদ্ভাবন করা। লিচুন অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে শাওশিং অপেরার সমন্বয় করার চেষ্টা শুরু করেন। তিনি মনে করেন, তার মতো তরুণ প্রজন্মের অপেরা শিল্পীদের সৃজনশীল উপায়ে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি প্রকাশ করা উচিত।

লিলি/রহমান