বেইজিং-থিয়ান চিন-হ্য পেইয়ের সমন্বিত উন্নয়নের গল্প
2024-01-31 09:38:37

গত ১৬ জানুয়ারি গভীর রাতে, এক বিশাল জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে চীনের থিয়ান চিন বন্দরে পৌঁছায়। এ জাহাজে আছে আড়াই হাজার টন চিলির চেরি। অর্ধেক পৃথিবীর দূরত্ব থেকে আসা এ চেরি পরের দিনে চীনের থিয়ান চিন, বেইজিং ও হ্যপেই প্রদেশের বাজারে পৌঁছে যাবে। 

এটি দক্ষিণ আমেরিকা এবং বেইজিং-থিয়ান চিন-হ্য পেইর মধ্যে প্রথম চেরি এক্সপ্রেস জাহাজ। চীনের এ তিনটি জায়গার মানুষ দক্ষিণ আমেরিকার তরতাজা ও মিষ্টি এ ফল খেতে পারছে এবং এটি ১০ বছরে এ তিনটি জায়গার সমন্বিত উন্নয়নের প্রতিফলন।

সতের জানুয়ারি, থিয়ান চিন শহর ঘন তুষার ঢাকা ছিল। তার মধ্যেই থিয়ান চিন ‘প্রশান্ত মহাসাগর আন্তর্জাতিক কন্টেইনার বন্দর’ লাল রং দিয়ে সাজানো হয়। সেখানেই চেরি এক্সপ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। থিয়ান চিন ও চিলির প্রতিনিধিরা এক্সপ্রেসটি উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড যৌথ নির্মাণ ও বাণিজ্য আন্তঃযোগযোগ জোরদার’।

গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘বাখ’ নামের এ জাহাজটি চিলির সান আন্তোনিও বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১০ হাজার নটিক্যাল মাইল অতিক্রম করে থিয়ান চিন বন্দরে পৌঁছায় জাহাজটি, যেটি এখানে আসে প্রথম চেরি এক্সপ্রেস জাহাজ।

থিয়ান চিন বন্দর লজিস্টিক কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক চাং লেই বলেন, চেরি সতেজ রাখা কঠিন এক ব্যাপার। এর জন্য বন্দরের উচ্চ ব্যবস্থাপনা ও লজিস্টিক দক্ষতার প্রয়োজন। কোনও বন্দর দিয়ে সরাসরি চেরি পরিবহন করা হবে কি না তা তাদের ফল পরিবহন দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। এর আগে চীনে কেবল শাংহাই ও কুয়াং তুংয়ের কিছু বন্দরের সরাসরি চেরি পরিবহনে সক্ষম ছিল। ওখানে চেরি আনলোড করার পর বেইজিং, থিয়ান চিন ও হ্য পেই প্রদেশে পাঠাতে সড়কেই দুদিন লাগে।  

চেরি সংরক্ষণ করা কঠিন কাজ এবং এ ফল সহজে নষ্ট হয়ে যায়। বেইজিং, থিয়ান চিন ও হ্য পেই প্রদেশের মানুষদেরকে সতেজ চেরি খাওয়াতে ২০২৩ সালের শুরু দিকে চিলি-থিয়ান চিন এক্সপ্রেস চালুর একটি কর্ম গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ গ্রুপটি চিলি সরকার, বিশ্বের শীর্ষ ১০টি জাহাজ কোম্পানি, চীন ও তার বাইরের ব্যবসায়ী এবং চীনের স্থানীয় মার্কেটের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাজারের মূল চাহিদা বোঝে।

চীনের বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী উত্সব, বসন্ত উত্সবের প্রাক্কালে প্রথম চেরি এক্সপ্রেস জাহাজটি চীনে এসেছে। তারপর আরও দুটিও এসেছে। মোট ৮ হাজার ৩শ টন চেরি ও অন্য দক্ষিণ আমেরিকান পণ্য চীনের বাজারে প্রবেশ করেছে।

চাং লেই বলেন, চিলি-থিয়ান চিন চেরি এক্সপ্রেস চালু হবার পর উত্তর চীনে আমদানিকৃত ফলের আরও নিরাপদ, সুবিধাজনক ও কার্যকর লজিস্টিক চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উত্তর চীনে আরও তাজা আমদানিকৃত ফল পাওয়া যাবে স্থায়ীভাবে।

ষোল জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে, বাখ জাহাজটি থিয়ান চিন বন্দরে ভেড়ে। বন্দর, শুল্ক, লজিস্টিক কোম্পানিসহ সবাই প্রস্তুত এবং একটু পরে ধারাবাহিক কাজ শুরু হবে।

তুং চিয়াং মেরিটাইম ব্যুরো চিলি থেকে থিয়ান চিন পর্যন্ত বাখ জাহাজের পুরো যাত্রার ওপর নজর রাখে। চীনের পো হাই সাগরে প্রবেশ করার পর ইলেকট্রনিক ক্রুজের মাধ্যমে বাখ জাহাজটিকে পর্যবেক্ষণ করে এবং দূরবর্তী প্রি-ট্রায়াল পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক আমদানি ও রপ্তানি বিষয়ক অনুমোদনের সবুজ চ্যানেল খোলে। বন্দরে ভেড়ার করার প্রক্রিয়ায় ২ ঘন্টার মতো সময় লাগে। জাহাজ বন্দরে ভেড়ার পর তিনটি উত্পাদন লাইন একসাথে কাজ শুরু করে। এদিন থিয়ান চিন বন্দর লজিস্টিকের গতি দ্রুত করে। বিশ মিনিটের মধ্যেই প্রতিটি কন্টেইনার চেরি খালাস করা হয় এবং ৩০ মিনিটের মধ্যে প্রতিটি কন্টেইনার পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। বন্দরে ১৫০টি ট্রাক আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকে। পরে তারা তাজা চেরি নিয়ে নানা বাজারে যাবে।

অল্প সময়ে একেকটি ট্রাক থিয়ান চিন বন্দর থেকে বিদায় নিয়ে বেইজিং ও হ্যপেইয়ের পাইকারী ফল বাজারে যাবে। থিয়ান চিন থেকে হ্য পেই প্রদেশের কাও পেই তিয়ান জেলার দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। চার ঘন্টার মধ্যে চেরি সেখানে পৌঁছে দিতে হবে। এটা দক্ষিণ চীন থেকে পরিবহনের তুলনায় বেশি সময়-সাশ্রয়ী। এ চেরিগুলো ৫ ঘন্টার মধ্যে বেইজিং, থিয়ান চিন ও হ্য পেই প্রদেশের মূল ফল বাজারে পৌঁছাবে এবং উত্তর-পূর্ব চীন ও  অন্তমঙ্গোলিয়া মানুষও আর এক দিনের মধ্যে সতেজ চেরি খেতে পারবেন।

হ্য পেই প্রদেশের একটি বাজারে ১৭ জানুয়ারি সকাল ৭টা। দিনটি মাত্র শুরু হয়েছে। ফলের ডিলাররা ট্রাক থেকে চেরিগুলো খালাস করা শেষ করেছেন। একটি কৃষি পণ্য ক্রয় ও বিক্রয় কোম্পানির বিক্রয় ব্যবস্থাপক সং ইয়াও বলেন, খুব সকালেই আমাদের ৭০ শতাংশ চেরি বুকিং হয়ে গেছে। এখন চিলি চেরির ফলনের সময় এবং চীনের বসন্ত উত্সবের প্রাক্কালে চীনা বাজারে চাহিদাও বাড়ছে।

ফল বিক্রির চেইন স্টোর পাই কুও ইউয়ানের থিয়ান চিন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মেং ফান পেং বলেন, নৌপথে চীনে পরিবহন করা চেরি ফলের খরচ কম। দামের দিক থেকে বিমানে বহন করা চেরির তুলনায় এগুলোর সুবিধা রয়েছে। চীনা বাজারে এসব চেরির দাম ৫০ শতাংশ কম হতে পারে।

লাল ও মিষ্টি চেরি ফল চীনে বেশ জনপ্রিয়। বিদেশের চেরি যে চীনে বিক্রি হয় সেটা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এ অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সঙ্গে চীনের অর্থ-বাণিজ্য সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবার একটি প্রমাণ। ২০১৭ সালে চীন ও চিলি হালনাগাদ অবাধ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং চীনে আমদানিকৃত ৯৮ শতাংশ চিলির পণ্য শূন্য শুল্ক সুবিধা উপভোগ করে। চিলির চেরি সমিতির ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গেল ৭ বছরে চীনে চিলি চেরি রপ্তানি বার্ষিক হারে গড়ে ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দশ বছর আগে বেইজিং-থিয়ান চিন-হ্য পেই সমন্বিত উন্নয়ন নীতি কার্যকর হওয়া এবং এবার চেরি এক্সপ্রেস চালু হওয়া এই তিনটি জায়গার মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের চমৎকার উদাহরণ। বন্দর, লজিস্টিক ও বাজারের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার মাধ্যমে চেরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

জাতীয় পর্যায়ের কোল্ড চেইন লজিস্টিক বেইস হিসেবে থিয়ান চিন তুং চিয়াং সমন্বিত বন্ডেড জোন বন্দর, অবাধ এলাকা ও বন্ডেড জোনের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বেইজিং-থিয়ান চিন-হ্যপেইর জন্য শহরের রেফ্রিজারেটর হিসেবে কাজ করে। সুস্বাদু আমদানিকৃত খাবারগুলো এ তিনটি জায়গার মানুষের টেবিলে পৌঁছে দিতে কাজ করে।

তুং চিয়াং সমন্বিত বন্ডেড জোনের বাণিজ্য বিভাগের উপ-প্রধান চাও ই বলেন, বাজারের সুযোগ ও ভোক্তার চাহিদা জানতে তুং চিয়াং ২০২৩ সাল থেকে কোল্ড চেইন আমদানি বাণিজ্যের ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়ে আসছে, চেরিসহ উচ্চ মানের ফল ও স্পান হ্যামসহ উচ্চ মানের মাংস চীনা বাজারে বয়ে আনছে এবং শহরের রেফ্রিজারেটরে আরও বৈশিষ্ট্যময় পণ্য রাখার চেষ্টা করছে।

নানা বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। সতের জানুয়ারি থিয়ান চিন বন্দর লজিস্টিক কোম্পানি ও চিলির ফল রপ্তানি সমিতি, থিয়ান চিন তুং চিয়াং সমন্বিত বন্ডেড জোনের বাণিজ্য উন্নয়ন ব্যুরো এবং বেইজিং সিনফাতি পাইকারী বাজারের মধ্যে একটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ভবিষ্যতে তারা আরও কার্যকর ও সুবিধাজনক ফল সরবরাহ চেইন তৈরি করবে।

নতুন সহযোগিতায় বন্দর আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বেইজিং-থিয়ান চিন-হ্যপেই এলাকার সমুদ্রের প্রবেশদ্বার হিসেবে থিয়ান চিন বন্দর চেরি এক্সপ্রেস দিয়ে আরও বেশি বৈশিষ্ট্যময় বিদেশি ফল চীনা বাজারে বয়ে আনবে। বন্দর যোগ লজিস্টিক সুবিধা আরও বেশি ফল সবররাহ ব্যবসায়ীকে থিয়ান চিনে আকর্ষণ করবে এবং থিয়ান চিন বন্দর পণ্য পরিবহন চ্যানেল থেকে অর্থনৈতিক করিডোরে পরিণত হবে।(শিশির/রহমান/রুবি)