চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব
2024-01-29 16:24:44

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৫৫তম পর্বে যা থাকছে:

* চীনে প্রাচীনতম বহুকোষী ইউক্যারিওটের জীবাশ্ম আবিষ্কার

* চীনে এশিয়ার বৃহত্তম লিথিয়াম আকরিকের মজুত আবিষ্কার

* চীনে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নতুন কৌশল আবিষ্কার

বহুকোষী বা মাল্টিসেলুলার ইউক্যারিওটের জীবাশ্মের একটি ব্যাচ আবিষ্কার করেছেন চীনা প্রত্নতাত্ত্বিকরা। জীবাশ্মগুলো ১৬৩ কোটি বছর আগের। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন এটিই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বহুকোষী জীবাশ্ম। তারা এ আণুবীক্ষণিক জীবাশ্মের নাম দিয়েছেন ছিংশানিয়া ম্যাগনিফিকা।

উত্তর চীনের ইয়ানশান পর্বতমালায় পাওয়া গেছে বহুকোষী বা মাল্টিসেলুলার ইউক্যারিওটের জীবাশ্মগুলো। সম্প্রতি একটি সায়েন্স জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

বহুকোষী ইউক্যারিওট জীবাশ্মগুলো পেয়েছেন চীনের বিজ্ঞান একাডেমি অধিভুক্ত নানচিং ইন্সটিটিউট অব জিওলজি অ্যান্ড প্যালিওন্টোলজির গবেষকরা। এর আগে ২০১৬ সালে এই অঞ্চলে ডেসিমিটার-আকারের বহুকোষী ইউক্যারিওটের জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন তারা।

 

নানচিং ইন্সটিটিউট অব জিওলজি অ্যান্ড প্যালিওন্টোলজির গবেষক চু মাওয়ান জানান, তারা ২৭৮টি বহুকোষী ইউক্যারিওটের জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন। এগুলোর মধ্যে প্রজনন স্পোর পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এই ধরনের জীবগুলো পরবর্তীতে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রজনন কোষে এনে দিয়েছিল বৈচিত্র্য।

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া এককোষী ইউক্যারিওটিক জীবাশ্মগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম ফসিলটি ছিল উত্তর চীন এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া এককোষী ইউক্যারিওটিকের। ওটার বয়স ছিল ১৬৫ কোটি বছর।

নতুন আবিষ্কার করা জীবাশ্মগুলোর ব্যাস ১৯০ মাইক্রোমিটার। এগুলো একক ও শাখাবিহীন ফিলামেন্ট নিয়ে গঠিত। গবেষকরা ধারণা করেছেন, জীবাশ্মগুলো সম্ভবত সালোকসংশ্লেষী শৈবাল ছিল।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

চীনের বিজ্ঞানীদের নতুন খনিজ আবিষ্কার

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিছুয়ান প্রদেশের ইয়াচিয়াংয়ে পাওয়া গেছে প্রায় দশ লাখ মেট্রিক টন লিথিয়ামের মজুত। এটি এশিয়ার বৃহত্তম পেগমাটাইট ঘরানার মনোমেরিক লিথিয়াম আকরিকের মজুত। সম্প্রতি চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে এ তথ্য।

লিথিয়ামকে বলা হয় এ যুগের স্বর্ণ। মৌলিক এ পদার্থটির সঙ্গে মানুষের পরিচয় দুই’শ বছর আগে হলেও মানুষ এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করছে আরও অনেক পরে। মোবাইল ফোন থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি--সবখানেই ব্যাটারির উপকরণ হিসেবে লিথিয়ামের জয়জয়কার। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ছাড়া এখনকার ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিগুলোর কথা কল্পনাই করা যায় না। এই লিথিয়াম খনি থেকে সংগ্রহ করা হলেও পৃথিবীর সব স্থানে এটি পাওয়া যায় না। আন্দিয়ান ও আমেরিকান দেশগুলোতেই এতদিন লিথিয়ামের বড় মজুতের কথা জানা ছিল।

গ্রিক শব্দ লিথোস। যার অর্থ ‘পাথর’। আর এ থেকেই নাম রাখা হয়েছে লিথিয়ামের। নরম, রুপালি-সাদা রঙের একটি ক্ষার ধাতু লিথিয়াম। আদর্শ তাপ ও চাপে লিথিয়াম সবচেয়ে হালকা কঠিন পদার্থ ও সবচেয়ে হালকা ধাতু।

পর্যায় সারণিতে তাকালে চোখে পড়ে লিথিয়ামের নানান বৈশিষ্ট্য। সাধারণ তাপমাত্রায় প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে লিথিয়ামের ঘনত্ব মাত্র শূন্য দশমিক ৫৩ গ্রাম। অর্থাৎ ধাতু হয়েও এটি দিব্যি ভেসে থাকবে পানিতে।

অবশ্য একে পানির মধ্যে ছেড়ে দিলেই শুরু করবে বিক্রিয়া।  এমনকি খোলা বাতাসেও এটি দ্রুত বিক্রিয়া করে তৈরি করে কয়েক ধরনের অক্সাইড। আর্দ্র বায়ুর প্রভাবে জারিত হয়ে এর রং হয়ে যায় হালকা রুপালি ধূসর।

অন্যান্য ক্ষার ধাতুর মতো লিথিয়ামও বেশ দাহ্য পদার্থ। তাই একে খনিজ তেলে সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। খনিতে যখন এটাকে কাটা হয়, তখন এ থেকে এক ধরনের দীপ্তি ছড়ায়। সমুদ্রের লোনা পানিতেও পাওয়া যায় এটি। লিথিয়াম ক্লোরাইড ও পটাশিয়াম ক্লোরাইডের মিশ্রণে তড়িৎ বিশ্লেষণ ঘটিয়ে আলাদা করা যায় লিথিয়াম।

লিথিয়ামের বেশি ব্যবহার দেখা যায় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ও ইলেকট্রিক ডিভাইসের রিচার্জেবল ব্যাটারিতে। এ ছাড়া হৃৎপিণ্ডের পেসমেকার, খেলনা, ঘড়ি ইত্যাদিতেও নন-রিচার্জেবল ব্যাটারি হিসেবে লিথিয়াম ব্যবহৃত হয়।

লিথিয়ামকে অ্যালুমিনিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের সঙ্গে সংকর ধাতু হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। ম্যাগনেসিয়াম-লিথিয়াম সংকর ধাতু আর্মার প্লেটিং হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

অ্যালুমিনিয়াম-লিথিয়াম সংকর ধাতু উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে সাইকেলের ফ্রেম এবং দ্রুতগতির ট্রেনেও ব্যবহার করা হয়।

লিথিয়াম অক্সাইডের ব্যবহার দেখা যায় কাচশিল্পে।  এয়ারকন্ডিশনিং ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ড্রাইং সিস্টেমে বহুল প্রচলিত বস্তুটি হলো লিথিয়াম ক্লোরাইড। লিথিয়াম স্টিয়ারেটকে উচ্চ তাপমাত্রার লুব্রিকেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার বিষণ্নতার ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম কার্বনেট।

এ ছাড়া, হাইড্রোজেন জ্বালানি সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম হাইড্রাইড।

আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি, অস্ট্রেলিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রে লিথিয়ামের মজুতের সন্ধান পাওয়া গেলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ খনিজ খুব একটা পাওয়া যায় না।

লিথিয়াম সরবরাহকে শক্তিশালী করতে এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ নিয়ে আস্থা বাড়াতে লিথিয়ামের অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয় ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একুশ শতকের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে চীনকে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনে লিথিয়ামের এ মজুত বেশ বড় ভূমিকা রাখবে।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

চীনে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নতুন কৌশল আবিষ্কার

সুস্থ দেহ থেকে কোনো বিশেষ অঙ্গ বা টিস্যু অন্য দেহে বসানোই হলো অঙ্গ প্রতিস্থাপন। তবে কাজটা মোটেও সহজ নয়। প্রতিস্থাপনের আগে ও পরে অঙ্গটির যত্নে সামান্য ত্রুটিও রাখা যায় না। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার পর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নতুন এক কৌশল আবিষ্কার করেছেন চীনের একদল গবেষক।

বলা হয়, অঙ্গ প্রতিস্থাপনই হলো আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের সেরা আবিষ্কার। এ পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত কিডনি, হৃপিণ্ড, ত্বক, হাত, অস্থিমজ্জা, যকৃত, ফুসফুস, ককলিয়া, কর্নিয়া, লিগামেন্টসহ আরও বেশকিছু অঙ্গ সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।

তবে প্রতিস্থাপনের আগে দাতার অঙ্গটিকে পুরোপুরি সচল রাখাটা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

 

প্রথাগত অঙ্গ প্রতিস্থাপনে দাতার অঙ্গটিকে বরফ বা বিশেষ শীতল চেম্বারে সংরক্ষণ করার পর রোগীর শরীরে বসানো হয়। এ সময় অঙ্গটির মধ্যে রক্ত সরবরাহ পুরোপুরি ব্যাহত হয়। এতে করে ওই অঙ্গটির ইস্কেমিক ক্ষতি বাড়তে থাকে। এতে অনেক সময় অচলও হয়ে যায় অঙ্গটি।

চীনা গবেষকদের দলটি বেশ ক’বছর ধরেই প্রথাগত অঙ্গ প্রতিস্থাপনের এ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। ২০১৬ সালে তারা একটি ‘মাল্টি-অর্গান নর্মাথার্মিক পারফিউশন ডিভাইস’ তৈরি করেন। ওই যন্ত্রটি দিয়ে দাতার অঙ্গে স্বাভাবিক মানবদেহের মতোই রক্ত ও পুষ্টি সরবরাহ করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যন্ত্রটি দীর্ঘ সময়ের জন্য অঙ্গটিকে ‘কার্যকর’ বা ‘সতেজ’ রাখতে পেরেছে।

অঙ্গ প্রতিস্থাপনে চীনা বিজ্ঞানীদের এ আবিষ্কার ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী তুমুল প্রসংশা কুড়িয়েছে।

গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশ হয়েছে আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালেও।

দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশের রাজধানী কুয়াংচৌয়ের সুন ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত একটি হাসপাতালের অধ্যাপক হে শিয়াওশুন ও তার দল আবিষ্কার করেন এ কৌশল। তারা নতুন কৌশলটির নাম দিয়েছেন ইস্কেমিয়া-ফ্রি অরগান ট্রান্সপ্লান্টেশন (আইএফওটি)। গত ডিসেম্বরে একটি অস্ত্রোপচারে এ কৌশলটির সফল প্রয়োগ করেন তারা। যকৃত প্রতিস্থাপনের ওই অস্ত্রোপচারটি পর্যবেক্ষণ করতে হাসপাতালে ছিলেন জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অঙ্গ প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞরা।

জার্মান ট্রান্সপ্লান্টেশন সোসাইটির সাবেক সভাপতি বিজর্ন নাশান। নতুন এ যন্ত্রের সাহায্যে অস্ত্রোপচার পর্যবেক্ষণ করতে একাধিকবার কুয়াংচৌতে গিয়েছিলেন তিনি। নাশান জানান, এই প্রযুক্তিটি নিরাপদ এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনে প্রচলিত অনেক সমস্যার সমাধান হবে এতে।

নাশান একটি হাসপাতালে অঙ্গ প্রতিস্থাপন কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে কাজ করতে ২০১৭ সালে চীনে আসেন। চীনের এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন কৌশলের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী তিনি।

ভবিষ্যতে জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে এ প্রযুক্তি নিয়ে যাওয়ার জন্য চীনা এ গবেষক দলের সঙ্গে কাজ করবেন বলেও জানান তিনি।

ট্রান্সপ্লান্টেশন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট জন ফুং বলেন, “অধ্যাপক হে এবং তার দল দেখিয়েছেন, তারা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। চীনের বাইরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন চিকিৎসার জন্য নতুন প্রযুক্তিটির প্রচার চালানো যেতে পারে।”

এই যন্ত্রের সাহায্যে চীনের গবেষণা দলটি ২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী প্রথম ইস্কেমিয়া-মুক্ত লিভার, কিডনি এবং হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন।

নতুন প্রযুক্তিটি অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতাগুলোকেও উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পেরেছে এবং প্রতিস্থাপিত অঙ্গের কার্যকারিতাও বাড়িয়েছে।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী