চীনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিদর্শন-চাহিদা বনাম পড়াশোনার পরিবেশ
2024-01-22 16:30:49

সম্প্রতি চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আবারও সমাজের বিভিন্ন মহলের পরিদর্শনের জন্য খোলা হয়েছে। বিষয়টি চীনাদের ব্যাপক মনোযোগ পেয়েছে। বস্তুত, কোভিড মহামারীর আগে চীনের বিভিন্ন প্রদেশ বা মহানগরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পরিদর্শনের জন্য অনলাইনে বুকিং করা যেত। একটি শহরের সুবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করা অনেকের কাছে আকর্ষণীয় ব্যাপার। তবে, মহামারীর সময় এ পরিদর্শন-ব্যবস্থা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

তবে, ২০২৩ সাল থেকে, বেইজিং, কুয়াংতুং ও ছোংছিং-সহ বিভিন্ন এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শন-ব্যবস্থা ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হয়। আজকাল অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে নিজেদের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট চালু করেছে। এভাবে আগ্রহী পরিদর্শকরা সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট বা অ্যাকাউন্টে ঢুকে পরিদর্শনের সময় বুকিং দিতে পারে। তাঁরা আইডি কার্ড ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট বুকিং বা নিবন্ধনকাজ করতে পারে। প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক দর্শক পরিদর্শনের অনুমতি পান। সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশ ঠিক রাখা। আজকের অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দশর্কদের জন্য খুলে দেওয়া এবং এর সামাজিক তাত্পর্য নিয়ে কিছু আলোচনা করবো।

অনুষ্ঠানের শুরুতে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য কাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাই। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার জন্য একাধিক দরজা সবসময় খোলা থাকে। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অনেক বড়; বিভিন্ন শিক্ষাভবন ও হল রয়েছে; বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষাভবন ক্যাম্পাসের প্রধান শিক্ষাভবনের কাছেই নির্মিত। তাই, রিকশা, গাড়ি ও পর্যটকরা সহজে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেন। তবে, চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মীদের আইডি কার্ড দেখাতে হয়। তা না হলে তাঁরা ঢুকতে পারে না। এর মানে, পূর্বানুমতি ছাড়া বাইরের লোকজনের ঢোকা প্রায় অসম্ভব। তাঁরা অনলাইনে ভিজিটের জন্য নিবন্ধন করতে পারেন। কেবল তখনই নির্দিষ্ট তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করা সম্ভব।

২০২০ সালের পর, কোভিড মহামারীর কারণে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য রক্ষায়, ক্যাম্পাস বাইরের লোকজনের জন্য বন্ধ করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে আসা পর্যটক বা শহরবাসীদের পরিদর্শন-ব্যবস্থা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

যাই হোক, চলতি বছর বেইজিং পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেইজিং বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়, চোংশান বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় দর্শকদের জন্য আবার খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরনের পরিদর্শনব্যবস্থা চালু করেছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়েছে স্বাভাবিক পড়াশোনার পরিবেশ ঠিক রাখার ওপর। পরিদর্শকদের আনাগোনা যাতে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট না করতে পারে।

কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শকরা তাদের আইডি কার্ডের তথ্য নিবন্ধন করে একটি কিউআর কোড নেন এবং ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেন। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শকরা শুধু দর্শকের আইডি কার্ড নিয়ে চেহারা স্ক্যান করে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেন।

পরিদর্শকদের জন্য ক্যাম্পাস পরিদর্শনব্যবস্থা পুনরায় চালু করা একটি সুবিধাজনক ব্যাপার। এতে সাধারণ চীনারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেজ অনুভব করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিভাবে এ ব্যাপারটি দেখেন? ছোংছিং মহানগরের দক্ষিণ-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ ও মিডিয়া একাডেমির শিক্ষার্থী চেং ইউয়ে মনে করেন, বাইরে থেকে আসা পরিদর্শকরা যদি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় আইডি কার্ড ব্যবহার করেন এবং ক্যাম্পাসে কম গতিতে গাড়ি চালান, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকলে পরিদশর্ক ও শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবার কথা না।

চীনের হুনান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সু সংবাদদাতাকে বলেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় হুনান প্রদেশের সুবিখ্যাত ইউয়েলু পাহাড়ের দর্শনীয় এলাকার কাছে অবস্থিত। তাই প্রতিবছর পর্যটনের মৌসুমে বহু পর্যটক ও গাড়ি দেখা যায়। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাভবন ও গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত বিশেষ আইডি কার্ড দেখাতে হয়। তাই, তাদের পড়াশোনার ওপর পর্যটকদের প্রভাব সামান্যই। তার দৃষ্টিতে, বিশ্ববিদ্যালয় বাইরের মানুষের জন্য খোলা থাকলে কিছু ঝুঁকি থাকা স্বাভাবিক। তবে, গাড়ি ও পর্যটকদের নিবন্ধনব্যবস্থার মাধ্যমে এই ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শহরবাসীদের জন্য পুনরায় খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের শিক্ষা বিভাগের নিরাপত্তা কার্যালয়ের পরিচালক চিয়াং ছুন ইয়ু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বাইরের মানুষের জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া ছিল কেবল কোভিড মহামারীর সময়কালের বিশেষ ব্যবস্থা। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাইরের মানুষের জন্য পুরোপুরি বন্ধ রাখা ঠিক নয়। তবে, একেক বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থা অনুসারে একেক ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বশর্ত নির্ধারণ করে দর্শকদের জন্য খোলা হয়েছে। এ সম্পর্কে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইয়াং শাং তুং বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার কাজ করা হয়। তাই এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো পড়াশোনার পরিবেশ থাকা জরুরি। প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক পরিদর্শককে ক্যাম্পাসে আসতে দেওয়া যেতে পারে। তবে, তাদের সংখ্যা, সময়, ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ নিয়মকানুন নির্ধারণ করা জরুরি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের চাহিদা ও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশের মধ্যে একটা ভারসাম্যতা বজায় থাকবে।

সম্প্রতি চীনের সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় দর্শকদের জন্য খোলা থাকবে কি না, এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলে। অনেক পর্যটক ও পরিদর্শক বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ ও পরিদর্শনের নিয়ম আলাদা, তাই সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন সহজ ব্যাপার নয়। বেইজিং, কুয়াংতুং এবং ছোংছিংসহ কয়েকটি বড় শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে খোঁজ-খবর নেওয়ার পর সংবাদদাতা খেয়াল করেন যে, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শুধু স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য পরিদর্শনের ব্যবস্থা রেখেছে, সাধারণ দর্শকরা সেখানে যেতে পারেন না। পরিদর্শনের আবেদন জমা দেওয়ার পর অনুমোদন কোডের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

বেইজিংয়ের বাসিন্দা ম্যাডাম লিউ বলেন, তার বাড়ির কাছে কয়েকটি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। গত কয়েক বছরে মহামারীর কারণে ক্যাম্পাসে ঢোকা যেতো না। তাই, বাচ্চাদের খেলাধুলার জায়গা অনেক কমে যায়। এখন মহামারি নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত যত দ্রুত সম্ভব ক্যাম্পাস আবারও সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া।

কুয়াংচৌয়ের বাসিন্দা জনাব হুয়াং ছুটির দিনে বাচ্চাকে নিয়ে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন এবং ভ্রমণকালে সংশ্লিষ্ট শহরের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শন করা তাঁর শখ। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের পাবলিক আকাউন্ট চালু করেছে। ভাগ্য ভালো থাকলে, যাওয়ার একদিন আগে পরিদর্শনের জন্য বুকিং করাও সম্ভব। তবে, কোনো কোনো শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবসময় ভীড় থাকে। পরিদর্শকদের জন্য নির্দিষ্ট তারিখে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।

চীনের পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় উন্নয়ন ও কৌশল গবেষণাগারের গবেষক অধ্যাপক মা লিয়াং বলেন, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ‘সীমিত’ আকারে খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের জন্য পরিদর্শনকাজ চালু করা নতুন ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিদর্শকদের অনুমতি দিতে হয়। ফলে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাজ বেড়েছে।

এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের আগ্রহও একটি আলোচ্য বিষয়। তাই, পরস্পরের শিক্ষার্থীদের পরিদর্শনের সুযোগ দেওয়া এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন পদ্ধতি হয়ে উঠেছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রস্তাব করেছেন যে, শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত নয় পরিদর্শকদের জন্য বাধা সৃষ্টি করা। ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও সহপাঠীর ছাড়া অন্যদের দেখতে শিক্ষার্থীদের ভালোই লাগে; ক্যাম্পাস এতে আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

২০২৩ সালের গ্রীষ্মকালীন ছুটি থেকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় ও ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় দর্শকদের জন্য খোলা হয়েছে। পরিদর্শনের ৭ দিন আগে উইচ্যাট আকাউন্ট থেকে দর্শকরা আসার সময় ও তারিখ বুকিং করতে পারেন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১১টা এবং বিকেল ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পরিদর্শনের বুকিং করা যায়। গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় প্রতি সপ্তাহের সোমবার ক্যাম্পাস পরিদর্শন বন্ধ থাকে। এদিন ক্যাম্পাসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলে। তা ছাড়া, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান থাকে বা চরম আবহাওয়া থাকে, তাহলেও ক্যাম্পাস পরিদর্শন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাপে আইডি কার্ডের তথ্য ইনপুট দিয়ে বুকিং করা যায়। প্রতিদিন সকাল ৮টায় বুকিং শুরু হয়। পরের ৭ দিনের মধ্যে পরিদর্শনের সময় বেছে নেওয়া যায়। প্রত্যেকের জন্য গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ক্যাম্পাস খোলার সময় বুকিংয়ের সুযোগ মাত্র একবার, আসার দিন বুকিং আর বাতিল করা যাবে না। এক আইডি কার্ডে আরও ৩ জনের জন্য বুকিং করা যায়। সেক্ষেত্রে সবাইকে একসাথে পশ্চিম দরজা দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে হবে। যদি পরিদর্শনের গ্রুপ বা দল থাকে, তাহলে গ্রুপ বুকিং ব্যবস্থা অনুসারে পূর্ব দরজা দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে হবে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে আসার ব্যাপার ঠিক করা প্রয়োজন। পরিদর্শন শেষ করে পশ্চিম দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে হবে।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)