চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব ৫৪তম পর্ব
2024-01-22 14:54:53

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৫৪তম পর্বে যা থাকছে:

 

* হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এমন জিনগত পরিবর্তন পেলেন চীনের বিজ্ঞানীরা

* চীনের বিজ্ঞানীদের নতুন খনিজ আবিষ্কার

* চীনা বিজ্ঞানীদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনাক্ত করছে ওভারিয়ান ক্যান্সার

 

হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এমন জিনগত পরিবর্তন পেলেন চীনের বিজ্ঞানীরা

হৃদরোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন করছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। মানবদেহে এক গুচ্ছ জিনগত পরিবর্তন চিহ্নিত করেছেন তারা। এই গ্রুপটির কার্যকারিতা বন্ধ করতে পারলেই হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা কমানো যাবে ৪২ শতাংশ। এ ছাড়া এ গবেষণার হাত ধরে ভবিষ্যতে হৃদযন্ত্রের যত্নে নেওয়া যাবে কার্যকর পদ্ধতি।

মেডিকেল জার্নাল ‘জামা কার্ডিওলজিতে’ এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। গবেষণাটি চালানো হয়েছে ৬ হাজার ১৮১ জন চীনা নাগরিকের ওপর।

এতে বলা হয়, করোনারি হৃদরোগের (সিএইচডি) ঝুঁকি বাড়ায়, জিনগত পরিবর্তনের এমন একটি গ্রুপ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। এই মিউটেশন গ্রুপগুলোর কারণে মানুষের মধ্যে গুরুতর হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি হয়।

এ গবেষণায় করোনারি হৃদরোগের পূর্বাভাস, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা নিয়ে আরও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

চীনের একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সের অধীভুক্ত ফুওয়াই হাসপাতালের গবেষকরা জানিয়েছেন, জিনগত পরিবর্তনের ফলে মানবদেহে এক ধরনের স্টেম সেল তৈরি হয়, যা ক্লোনাল হেমাটোপয়েসিস অব ইনডিটারমিনেট পটেনশিয়াল (সিএইচআইপি) নামে পরিচিত। এটি লিউকেমিয়াও সৃষ্টি করে। পাশাপাশি জিন মিউটেশনের ফলে সৃষ্ট এই স্টেম সেলের কারণে করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে ৪২ শতাংশ।

চীনে এথেরোস্ক্লেরোটিক হৃদরোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন ব্যক্তিদের তিনটি দলে ভাগ করে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় সুস্থ মানুষদেরও নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়। এরপর তাদের ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত ফলো-আপে রাখা হয়।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

 

চীনের বিজ্ঞানীদের নতুন খনিজ আবিষ্কার

পৃথিবীতে যেসব সিলিকেট খনিজ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় কোয়ার্টজ, ফেল্ডস্পার, অ্যাম্ফিবোল, মাইকা, পাইরক্সিন এবং অলিভাইন। এবার চীনের একদল বিজ্ঞানী সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি সিলিকেট খনিজ আবিষ্কার করেছেন, যা আধুনিক শিল্পকারখানাগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যাবে।

বিরল খনিজ রয়েছে এমন একটি খনি থেকে নতুন সিলিকেট খনিজটি আবিষ্কার করেছেন চীনের একদল বিজ্ঞানী। সেরিয়াম নামের দুষ্প্রাপ্য একটি উপাদানে সমৃদ্ধ এ খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে মধ্য চীনের হ্যনান প্রদেশে। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত চায়না ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানাল এ তথ্য।

এরইমধ্যে চীনের আবিষ্কৃত নতুন খনিজটির অনুমোদন দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মিনারোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন। চীনের বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক নি পেইয়ের সম্মানে খনিজটির নাম রাখা হয়েছে ‘নি পেই স্টোন।’

 

এখন পর্যন্ত প্রকৃতিতে আবিষ্কৃত সিলিকেট খনিজগুলোর মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ সেরিয়াম সমৃদ্ধ। যে কারণে এর বৈজ্ঞানিক মূল্য অনেক। নি পেই স্টোনের রঙ হালকা লাল থেকে লালচে-বাদামী।

চীন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার থিয়ানচিন কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী রেন চুনপিং জানান, মাঠে কাজ করার সময় তারা বিভিন্ন রঙের কঠিন শিলার কিছু নমুনা নিয়েছিলেন। নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করে একটি অস্বাভাবিক খনিজ খুঁজে পান, যার কথা তাদের ডাটাবেসে ছিল না। পরে তারা এটাকে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং স্ফটিক কাঠামোর দিক থেকে গবেষণা করেন। এরপর তারা নিশ্চিত হয়েছেন, এটি নতুন একটি খনিজ।

বিশেষ রাসায়নিক উপাদান এবং ক্রিস্টাল কাঠামোর কারণে আগের আবিষ্কৃত খনিজগুলোর চেয়ে নতুন খনিজটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

চীন ভূতাত্ত্বিক জরিপের থিয়ানচিন সেন্টারের উপ-পরিচালক চাং ছিচুয়ান বলেন, ”নতুন খনিজ আবিষ্কার শুধু ভূতত্ত্বের বিষয়গুলোকে সমৃদ্ধ করছে তা নয়, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নকেও সমৃদ্ধ করছে। সাম্প্রতিক এ আবিষ্কার ভূ-বিজ্ঞানের প্রতিও আগ্রহ বাড়াবে। সেরিয়াম একটি বিরল-খনিজ। এটি বিভিন্ন উদীয়মান শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এর অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে।”

বিরল খনিজকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গোল্ড’ তথা ‘শিল্পের সোনা‘ বলা হয়। আবার এগুলোকে ‘আধুনিক শিল্পের ভিটামিন’ নামেও ডাকা হয়।

নতুন আবিষ্কৃত খনিজটি ব্যবহৃত হতে পারে আধুনিক উড়োজাহাজ, উন্নত শিল্প ও নতুন জ্বালানি তৈরিতে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

 

চীনা বিজ্ঞানীদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনাক্ত করছে ওভারিয়ান ক্যান্সার

সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ নারীরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে। এই রোগে উদ্বেগের একটি বড় কারণ হলো এই ক্যান্সার ডিম্বাশয়কে সংক্রমিত করে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত পেলভিক জোনে (শ্রোণি এলাকা) এবং পেটে না ছড়ায় ততক্ষণ পর্যন্ত এর অস্তিত্ব বোঝা যায় না। সম্প্রতি এ রোগ নির্ণয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক একটি মডেল তৈরি করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা।

 

বিশ্বব্যাপী নারীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ ওভারিয়ান ক্যান্সার। বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী মারা যান এ ক্যান্সারে। বছরে আক্রান্ত হন প্রায় ৫০ লক্ষাধিক নারী।

ওয়ার্ল্ড ওভারিয়ান ক্যানসার কোয়ালিশন বলছে, এখন যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সেই গতি অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৪০ লাখ নারী শুধু ওভারিয়ান ক্যানসারেই প্রাণ হারাবে।

এ ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো একেবারে গুরুতর পর্যায়ে না পৌঁছালে এটি বোঝা কঠিন।

এই সমস্যার সমাধানে সম্প্রতি চীনের বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক মডেল। এটা দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়েই কম খরচে, সহজে ও সঠিকভাবে ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার শনাক্ত করা যাবে।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট ডিজিটাল হেলথে’ এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

যৌথভাবে এ গবেষণা করেছে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাসপাতাল। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সুন ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্সার সেন্টারের অধ্যাপক লিউ চিহং।

গবেষকরা বিভিন্ন রোগীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করেন। এরপর রোগ নির্ণয়ের জন্য তারা ব্যবহার করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা এআই মডেল।

গবেষণার জন্য ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীনের তিনটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রায় ১১ হাজার নারীর ল্যাব পরীক্ষার ফল এবং ক্লিনিকাল কিছু বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করেন গবেষকরা। এদের মধ্যে অনেকে আক্রান্ত ছিলেন ওভারিয়ান ক্যান্সার রয়েছে আবার অনেকের ছিল।

৫১টি ল্যাব টেস্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য ২০টি পৃথক এআই দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর হুয়াচং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির তংচি হাসপাতালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নমুনা পরীক্ষা করে পাওয়া যায় নির্ভুল ফলাফল। আবার একই ফলাফল পাওয়া যায় চেচিয়াং ইউনিভার্সিটি এবং লিউয়ের সেন্টারেও।

লিউ জানান, এআই মডেলটি প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক ও নির্ভুলভাবে ওভারিয়ান ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারে। ভবিষ্যতে এটি অন্যান্য রোগ নির্ণয়েও সহায়তা করবে। বিশেষ করে রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় বা গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজিসহ বিভিন্ন প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা দেবে।

এ ছাড়া এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের ব্যয় আগের চেয়ে ১ হাজার ইউয়ান কম হবে বলেও জানান তিনি।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় প্রাথমিক পরিচর্যা একজন রোগীর জীবন মৃত্যুর মধ্যে ফারাক গড়ে দিতে পারে। কিন্তু এ ভয়াবহ রোগের ক্ষেত্রে স্পষ্ট লক্ষণের অনুপস্থিতির কারণে প্রাথমিক পর্যায়ের রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন চিকিৎসকরা।

চীনে ৪৮ শতাংশেরও কম রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ শনাক্ত করতে সক্ষম হন এবং শনাক্ত হওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত রোগীদের বেঁচে থাকার হার ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এ মডেলের ফলে ওভারিয়ান ক্যান্সারের চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে, কমে আসবে মৃত্যুহার।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী