দেহঘড়ি পর্ব-০৫৪
2024-01-21 14:49:47


‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

জনপ্রিয় হচ্ছে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের টিসিএম চিকিৎসা

মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস হলো এমন একটি রোগ, যাতে মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড আক্রান্ত হয় এবং যার ফলে দৃষ্টি, হাত বা পায়ের নড়াচড়া, সংবেদনশীলতা বা ভারসাম্য নষ্ট হয়৷ এটি জীবনভর ভোগানো একটি রোগ। এ রোগের উপসর্গ সাধারণত হালকা হয়, তবে কখনও কখনও এটি গুরুতর অক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে। হালকা উপসর্গ থাকলেও এটি দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করা কঠিন করে তোলে৷

সারা পৃথিবীতে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস বা এমএস রোগের উপস্থিতি দেখা যায়। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত এবং প্রতি সপ্তাহে আরও ২শ জন এ তালিকায় যুক্ত হয়৷

এমএসের সঠিক কারণগুলো সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিত্সা-ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হলেও এখনও পর্যন্ত এর কোনও প্রতিকারও নেই৷ পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থায় এমএসকে একটি অটোইমিউন রোগ অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার বিভ্রাটজনিত রোগ বলে মনে করা হয়। এ রোগ হয়, যখন রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের স্নায়ুতন্তুকে ঘিরে রাখা মায়েলিন নামক এক ধরনের পদার্থকে আক্রমণ করতে এবং ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করে।

মায়েলিন যখন ভেঙ্গে বা ধ্বংস হয়ে যায়, তখন স্নায়ুবেগ ধীর হয়ে যায়। কারণ মায়েলিনই স্নায়ু সংকেত প্রেরণের গতি বাড়ায়। স্নায়ুতন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে, সেগুলো হলো: ঝাপসা দৃষ্টি, শারীরিক ভারসাম্যহীনতা, অঙ্গগুলোর মধ্যে দুর্বল সমন্বয়, কথা বলায় জড়তা, ক্লান্তি, স্মৃতি সমস্যা এবং অসাড়তা বা দুর্বলতা। এমএসের উপসর্গ ব্যক্তিভেদে আলাদা হয় এবং এটা হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। আবার কিছু সময়ের জন্য একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

চিকিৎসা

এমএসের চিকিৎসায় বর্তমানে অধিক হারে মানুষ প্রচলিত পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থার পাশাপাশি পরিপূরক হিসাবে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি বা টিসিএম গ্রহণ করছেন। কারণ এমএস রোগীদের জন্য টিসিএম ভেষজ ও আকুপাংচার একটি নিরাপদ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি। পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থার ডাক্তারেরা যেমনভাবে এমএসকে দেখেন, টিসিএম চিকিৎসকরা তেমনি করে দেখেন না। চিকিৎসার বেলায় তারা প্রত্যেক রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য, জীবনধারা এবং মানসিক সুস্থতাকে বিবেচনায় নেন। একারণে রোগীভেদে এমএসের টিসিএম চিকিৎসাও ভিন্ন হয়।

টিসিএমে যে নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সেটি হলো ‘ছি’ বা মূল প্রাণশক্তি মেরিডিয়ান নামক পথ দিয়ে শরীরে প্রবাহিত হয়। যদি সেই ‘ছি’য়ে ভারসাম্যহীনতা বা ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে সেই ভারসাম্যহীনতা বা ঘাটতির স্থানভেদে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এমএসের ক্ষেত্রেও এ নীতি সমানভাবে প্রযোজ্য। এছাড়া জন্মসূত্রে পাওয়া ভারসাম্যহীনতা বা অসুস্থতা, মানসিক চাপ বা বাহ্যিক রোগসৃষ্টিকারী উপাদান যেমন বাতাস বা ক্লেদও এ রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

রোগের কারণ নির্ণয়ের পর টিসিএম চিকিৎসকরা চিকিৎসা প্রটোকল ঠিক করে দেন। এর জন্য বাছাই করা হতে পারে টিসিএম ভেষজ বা আকুপাংচার কিংবা দুটোর সংমিশ্রণ। আকুপাংচার চিকিৎসায় চুলের মতো চিকন সূঁই দিয়ে শরীরের নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে নাড়াচাড়া করা হয়। এর লক্ষ্য থাকে ‘ছি’য়ে ভারসাম্য আনা।

এমএম উপসর্গ উপশমে জীবনধারা

এমএস জীবনের প্রতিটি অংশে প্রভাব ফেলতে পারে৷ তাই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য টিসিএম চিকিৎসক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারায় পরিবর্তনের পরামর্শ দিতে পারেন৷ এর মধ্যে থাকতে পারে কিছু খাদ্য গ্রহণ আবার কিছু খাদ্য বর্জন, নিয়মিত ব্যায়াম, বিশেষ করে যোগব্যায়াম ও থাইছি, মানসিক চাপ হ্রাস ইত্যাদি।

 

#চিকিৎসার খোঁজ

টিসিএম ও পশ্চিমা চিকিৎসার অসাধারণ সমন্বয় হয়েছে শাংহাই ইউয়ে ইয়াং হাসপাতালে

শাংহাই ইউয়ে ইয়াং ইন্টিগ্রেটেড ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন মেডিসিন হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৬ সালে। শাংহাই ইউনিভার্সিটি অব ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন-অধিভুক্ত এ হাসপাতালটি সর্বোচ্চ স্তরের এ শ্রেণির একটি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা এবং পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থার অসাধারণ সমন্বয় ঘটেছে। এক হাজার ১৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি ক্লিনিকাল কেয়ার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং চিকিৎসাশিক্ষা প্রদানে নিবেদিত। চীনের রাষ্ট্রীয় টিসিএম প্রশাসন এটিকে সমন্বিত টিসিএম ও পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় হাসপাতাল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

শাংহাই ইউয়ে ইয়াং ইন্টিগ্রেটেড ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন মেডিসিন হাসপাতালটি তিনটি ক্যাম্পাস এবং চারটি শাখা নিয়ে গঠিত। এর প্রধান ক্যাম্পাস অবস্থিত দা বাই-শু কেন্দ্রে এবং বাকি দুটি ছিন হাই সড়কের বিশেষজ্ঞ ক্লিনিক এবং শাংহাই আকুপাংচার মেরিডিয়ান ইনস্টিটিউটে। আর এর শাখাগুলো গড়ে উঠেছে ছংমিং জেলা, মিংহাং জেলা, হাইখৌ জেলা এবং ইয়ু জেলায়। পাশাপাশি হাসপাতালটি পুরো শহরে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। অন্যান্য চিকিৎসা অবকাঠামোর পাশাপাশি এ হাসপাতালে রয়েছে একটি সুসজ্জিত পুনর্বাসন চিকিৎসাকেন্দ্র, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-স্বীকৃত একটি পিসিআর পরীক্ষাগার এবং একটি ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ তৈরির স্থাপনা। এছাড়া এখানে রয়েছে ৩১টি ক্লিনিকাল বিভাগ, ৮টি চিকিৎসা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বিভাগ, এবং ১ হাজার ৬শর বেশি কর্মী।

বর্তমানে হাসপাতালটিতে রয়েছে টিসিএমের ৫টি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিকাল বিভাগ এবং রাষ্ট্রীয় টিসিএম প্রশাসনের ১৩টি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিকাল বিভাগসহ ১১০টিরও বেশি বহিরাগত বিশেষজ্ঞ ক্লিনিক৷ যেসব রোগের চিকিৎসা এ হাসপাতালে দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রক্তরোগ, স্ত্রীরোগ, চর্মরোগ, মেরুদণ্ডের রোগ, স্ট্রোক, গর্ভাবস্থার ব্যাধি, দীর্ঘস্থায়ী অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, গাউট, আলসারেটিভ কোলাইটিস, সার্ভিকাল ভার্টিগো, মেনোপজল সিন্ড্রোম, ধনুষ্টঙ্কার ও বধিরতা ও অর্শ্বরোগ।

শাংহাই ইউয়ে ইয়াং ইন্টিগ্রেটেড ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন মেডিসিন হাসপাতাল চারটি চেতনা ধারণ করে। এগুলো হলো "উৎকর্ষ, নিরাময়, সমবেদনা, সম্মান"। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এই চেতনা বয়ে চলেছে হাসপাতালটি।

 

 #হারবাল হিলিং

কাঠবাদামের হরেক গুণ

কাঠবাদাম বা অ্যামন্ড খুব জনপ্রিয় এক ধরনের বাদাম। তবে এই জনপ্রিয়তা কেবল এর স্বাদের জন্য নয়; এর পুষ্টিগুণের জন্যও। কাঠবাদামে আছে আঁশ বা ফাইবার, উপকারী ফ্যাট, প্রোটিন, খনিজ উপাদান, ভিটামিনসহ বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। জানিয়ে দিচ্ছি কাঠবাদামের উপকারিতা সম্পর্কে:

কোলেস্টেরল কমায়: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কাঠ বাদাম খেলে লোহিত রক্তকণিকায় ভিটামিন ইয়ের মাত্রা বাড়ে এবং কোলেস্টেরল থাকার ঝুঁকি কমায়।

হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী: গবেষকরা দেখেছেন, যারা কাঠবাদাম খান, তাদের রক্তপ্রবাহে বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এতে রক্তচাপ কমে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তপ্রবাহ উন্নত হয়।

রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে: কাঠবাদামে থাকা ম্যাগনেসিয়াম রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোনও ব্যক্তি কাঠবাদাম খেলে তার ইনসুলিন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে।

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে: শরীরে ম্যাগনেসিয়ামের মাত্রা কমে গেলে, তা উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা আছে, তাদের নিয়মিত কাঠবাদাম খাওয়া উচিত। কারণ এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম কার্যকরভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

ওজন কমায়: কাঠবাদামে প্রোটিন ও আঁশের পরিমাণ বেশি তবে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা কম। এজন্য বাদাম খেলে ক্ষুধার বোধ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং খাওয়ার আগ্রহ কমে। এভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে কাঠবাদাম।

বিষাক্ত উপাদান থেকে রক্ষা করে: কাঠ বাদামে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন ই থাকে, যা আসলে একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বা বিষাক্ত পদার্থরোধী উপাদান। ভিটামিন ই কোষকে বিষাক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। রক্তপ্রবাহে ভিটামিন ই-য়ের উচ্চ মাত্রা আলজেইমার রোগ, ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।