এ বছরের শীতকালে উত্তর চীনের তুষার ও বরফ সম্পর্কিত পর্যটন ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বরফ দিয়ে তৈরি স্লাইড, তুষার ড্রিফ্টসহ নানা শব্দ ইন্টারনেটে অনুসন্ধানে উপরের দিকে রয়েছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের কুই চৌ প্রদেশের গ্রাম পর্যায়ের ফুটবল লিগও শুরু হয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে চীনা মানুষের ক্রীড়া কার্যক্রমে দেখা যায় নতুন পরিবর্তন ও প্রবাহ। তুষারও স্বর্ণ ও রূপা হতে পারে এবং সাধারণ মানুষের ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও নানা পর্যটক আকর্ষণ করতে পারে।
ফান চাও ই হলেন চীনের হেই লোং চিয়াং প্রদেশের শুয়াং ফেং বন খামারের একজন কর্মী। বিশ বছর আগে, তুষারপাত হলে তার কাজ কঠিন হয়ে যেত। তাই তিনি তুষার পছন্দ করতেন না, কারণ তুষার পড়লে কাঠ বাইরে পাঠাতে হতে পারতেন না। তবে এখন বাইরে তুষার দেখলে তার বেশ ভাল লাগে। যেখানে তিনি বাস করেন, সে জায়গার নতুন একটি নাম আছে - সুয়ে সিয়াং অর্থাৎ তুষার গ্রাম। ফান চাও ই একটি পারিবারিক হোটেল খুলেছেন এবং সম্প্রতি তার হোটেলের সবগুলো কক্ষের বুকিং পূর্ণ হয়ে গেছে। তুষার এখন তার আয়ের মূল উত্স। তুষার দেখতে আসা পর্যটক বেশি হলে ফান চাও ইর ব্যবসাও ভাল হয়।
গত নববর্ষের ছুটিতে সুয়ে সিয়াংয়ে আসা পর্যটকের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, হোটেলের সব কক্ষের বুকিং শেষ হয়ে যায়। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৫ লাখ পর্যটক সুয়ে সিয়াংয়ে ভ্রমণ করতে আসেন। সুয়ে সিয়াংয়ের অদূরে অবস্থিত ইয়াবুলি স্কি রিসোর্ট। ২০০৩ সালের নভেম্বর চালু হয় এ রিসোর্ট। গত ডিসেম্বর মাসে এখানে অনুষ্ঠিত হয় স্কি উত্সব। নববর্ষের ছুটিতে রিসোর্টের আয় ছিল ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ইউয়ান। এ অঙ্ক ২০১৯ সালের তুলনায় ১৪০ শতাংশ বেশি।
হারবিন এ শীতকালে চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি শহর। হারবিন তুষার ও বরফ পার্ক চালুর প্রথম দিন পর্যটক বেশি হবার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়। পার্কে ৫০০ মিটার লম্বা বরফ দিয়ে তৈরি স্লাইড আছে, যেখানে প্রত্যেক পর্যটক কমপক্ষে একবার খেলেন। ফু চিয়ানের পর্যটক সুন চ্য চেং বলেন, তিনি শুরুতে থাইল্যান্ড ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন, তবে শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্মে হারবিনের শর্ট ভিডিও দেখে তিনি ও স্ত্রী পরিকল্পনা পরিবর্তন করে হারবিনে এসেছেন।
হেই লোং চিয়াং প্রদেশের সং হুয়া নদী বরফে পুরো জমে গেছে। এর উপরে নানা বিনোদন স্থাপনা তৈরি হয়েছে। এমনকি হট এয়ার বেলুনও আছে। নববর্ষের ছুটিতে হারবিনে ভ্রমণ করতে আসেন ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ৯০০ পর্যটক এবং পর্যটন থেকে আয় হয় ৫৯১ কোটি ৪ লাখ ইউয়ান। পর্যটকের সংখ্যা ও আয় উভয় ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
গ্রামেও ফুটবল লিগ হতে পারে? এবার আমরা চীনের কুই চৌ প্রদেশে যাবো। কুই চৌ প্রদেশের তুং জাতির স্বায়ত্তশাসিত এলাকার রং চিয়াং জেলায় শুরু হয়েছে ২০২৪ সালের ফুটবল লিগ। এ বছর ফুটবল দলের সংখ্যা ৬২টিতে দাঁড়িয়েছে যেখানে ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ২০টি। দলগুলো ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথম দফার প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে এবং তাদের মধ্যে ২০টি দল পরবর্তী পর্যায়ে প্রবেশ করবে। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ফাইনাল পর্যায়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। দলের সংখ্যা বেশি হলেও ফুবটল খেলোয়াড়রা আগের মতোই সাধারণ মানুষ। তাদের নিজ নিজ চাকরি আছে। কেউ নির্মাণ কর্মী, কেউ শিক্ষক, কেঊ ব্যবসায়ী।
গত মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা তুং ইউং হং বলেন, নতুন দল, নতুন খেলোয়াড় এমনকি বিদেশি খেলোয়াড়ও এতে অংশ নিচ্ছেন। তাই প্রতিযোগিতা নিশ্চয়ই আরও চমত্কার হবে।
২০২৩ সালে রং চিয়াং জেলার গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে ২০টি দল গঠিত হয়। তারা ৯৮ বারের মতো প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় এবং তাদের প্রতিযোগিতা সারা দেশের মানুষকে আকর্ষণ করে। ইন্টারনেটে তাদের প্রতিযোগিতার ভিডিও ৫ হাজার ৮০০ কোটি বারের মতো দেখা হয়েছে। প্রতিযোগিতা দেখতে ও ভ্রমণ করতে আসা পর্যটকের সংখ্যা ৫১ লাখ ৯০ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং এ খাত থেকে মোট আয় হয়েছে ৫৯৮ কোটি ৬০ লাখ ইউয়ান। গ্রাম ফুটবল লিগ এখন স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
গ্রাম লিগ বসন্ত উত্সব পর্যন্ত চলবে। গ্রামের বাসিন্দারা ফুটবল খেলা ছাড়াও প্রতিযোগিতার ফাঁকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন। বসন্ত উৎসবের ছুটি ভ্রমণের শীর্ষ সময়। ফুটবল প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এ পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখবে।
চিয়াং সু প্রদেশের উ সি শহরে একটি স্কি রিসোর্ট আছে, যেটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আশপাশ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। উ সি চীনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি শহর এবং সেখানে তুষারপাত হয় খুব কম। তবে তুষার ও বরফ ক্রীড়ার ব্যপারে স্থানীয়দের উদ্দীপনা কম নয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পর্যটকের সংখ্যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০০ শতাংশ বাড়ে। এখন শীতকালে স্কি করা গ্রীষ্মকালে সাঁতার কাটার মতো নিয়মিত একটি ক্রীড়ায় পরিণত হয়েছে।
চিয়াং সু প্রদেশের থাই চাং শহরের পর্যটন বিভাগের প্রধান ইয়ান হাও মনে করেন, তুষার ও বরফ ক্রীড়া এখন স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও পর্যটন শিল্প উন্নয়নের নতুন চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে থাই চাং শহরে চালু হয় নতুন একটি বরফ ও তুষার বিনোদন পার্ক। পর্যটকের মধ্যে ৯০ শতাংশই অন্য শহর থেকে আসেন। প্রতি শনি ও রোববার আড়াই থেকে ৩ হাজার পর্যটক আসেন। ছুটির সময় পাশের সব হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ভরে যায়।
হাইনান প্রদেশের ওয়েন চাং ভলিবলের কারণে বিখ্যাত। শহর বা গ্রাম যেটাই হোক না কেন, এখানে সব সময় ভলিবল খেলা দেখতে পাওয়া যায়। বসন্তের সময়ে ওয়েন চাংয়ের প্রতিটি গ্রামে ৯ জনের ভলিবল গেমস আয়োজন করা যায়। ১২ জানুয়ারি ওয়েন চাং গ্রাম ভলিবল প্রতিযোগিতা শুরু হয়। গ্রামের ২৮টি দল ৬ সপ্তাহের মতো প্রতিযোগিতা করে।
সিনচিয়াংয়ের আল্যথাই এলাকাকে স্কির উত্স হিসেবে মনে করা হয়। সি ছুয়ান প্রদেশ থেকে আসা পর্যটক চেন খ্য বলেন, এবার শীতকালে তিনি তিন বারের মতো সিনচিয়াংয়ে ভ্রমণ করতে এসেছেন। আল্যথাই অঞ্চলের সব স্কি রিসোর্ট তিনি গিয়েছেন। স্কি ছাড়া পর্যটকদের জন্য এখানে ছবি তোলা, প্যারাগ্লাইডিংসহ নানা পরিষেবা দেওয়া হয়। এবারের নববর্ষ থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬০ হাজার পর্যটক আল্যথাই এলাকায় এসেছেন।
তুষার ও ফুটবল সারা চীনের শীতকালীন পর্যটনকে উষ্ণতায় ভরে দিয়েছে। শীতকালে মানুষ বাসায় থাকার চেয়ে বাইরে যেতে পছন্দ করে এবং ক্রীড়া করতে চায়। পর্যটক ও ক্রীড়া দুটি শিল্পে একসাথে দারুণ উন্নয়ন হয়। (শিশির/রহমান/রুবি)