কুইচৌ প্রদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণে কাঁকড়া লালনে ব্যস্ত শাংহাইয়ের শিক্ষার্থীরা
2024-01-15 16:00:19

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নে আধুনিক সমাজের মানুষের জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন আমাদের জীবনের অনেক কাজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে জড়িত। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব চীনের গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় গঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এমন উদ্যোগের মাধ্যমে চীনের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের কৃষিকাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, যা স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে ইতিবাচক ভুমিকা রাখছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের কুইচৌ প্রদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণে শাংহাইয়ের শিক্ষার্থীদের কাঁকড়া লালনের গল্প তুলে ধরবো, চীনের সুন্দর গ্রাম উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবনে অর্জিত সাফল্যের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো।

 

শীত এসেছে অনেকদিন হলো। চীনের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে শীতের লম্বা ছুটিও কিছুদিন পর শুরু হবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শীতের ছুটি কাটাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে, চীনের কুইচৌ প্রদেশের ছিয়ানতুংনান মিয়াও আর তং জাতির অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্যের চিয়ানহ্য জেলার উলিউ গ্রামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণে কয়েকজন শাংহাইয়ের শিক্ষার্থী ব্যস্ততার মধ্যে গবেষণাকাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা শাংহাই সমুদ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জলজ পালন ও জীবন একাডেমির ৩ জন মাস্টার্স শিক্ষার্থী ওয়াং হং ওয়ে, চাং চি লি, এবং লিন হাই লেই। তাঁরা কাঁকড়া চাষের ওপর বিভিন্ন গবেষণা চালাচ্ছেন।

 

উলিউ গ্রাম পাহাড়াঞ্চলে অবস্থিত। স্থানীয় সিঁড়িক্ষেত উঁচু ও নিচু স্থানে দেখা যায়। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দর। এ পাহাড়াঞ্চলে নির্মিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণ মাত্র কয়েকটি বাড়িঘর ও ৩ হেক্টর পরীক্ষামূলক কৃষিক্ষেত নিয়ে গঠিত। এটি যদিও বেশ বড় একটি জায়গা নয়, তবে সেটি ৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাগারের মতো।

 

ভিডিও-ফোনে অধ্যাপক ছেং ইয়ং স্যুর কাছে গত কয়েক মাসের কাজের অগ্রগতি নিয়ে শিক্ষার্থী ওয়াং হং ওয়ে বলেন, সংশ্লিষ্ট জরিপের ফল অনুসারে, এ ৩ হেক্টর ক্ষেতে কাঁকড়া লালনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখন স্থানীয় আবহাওয়ার অবস্থা বিবেচনা করে, কাঁকড়ার নিরাপদ শীতকাল কাটানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

 

২০২৩ সালের জুন মাসে শাংহাই সমুদ্র বিশ্ববিদ্যালয় ও চিয়ানহ্য জেলার সাথে উলিউ গ্রামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণ স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে এ প্রাঙ্গণ দেখাশোনা করেন এবং বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপকদের সমর্থনে ধানক্ষেতে কাঁকড়া ও চিংড়ি মাছ লালনের প্রযুক্তি গবেষণা ও উন্নত করেন। এর উদ্দেশ্য স্থানীয় কৃষকদের জলজ পণ্যের লালনপালন সহজতর করা।

 

এ প্রাঙ্গণের প্রধান দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে ২০২৩ সালের বসন্তকালে, অধ্যাপক ছেং ইয়ং স্যু তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থী ওয়াং হং ওয়েকে বেছে নিয়ে, উলিউ গ্রামের প্রাঙ্গণে সংশ্লিষ্ট গবেষণা কাজের দেখাশোনার জন্য পাঠান। অন্যদিকে, ওয়াং হং ওয়ে’র সহপাঠী চাও ইয়ু স্যুয়ান চিয়াংসু প্রদেশের সুছিয়ান শহরের আরেকটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণে কাঁকড়া পালনের গবেষণার কাজ করেন। ওয়াং উইচ্যাটে ভিডিও কলের মাধ্যমে তার সাথে সুছিয়ানের কাঁকড়া লালনের অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেন। গত কয়েক মাস ধরে তারা নিয়মিত ভিডিওতে কথাবার্তা বলে সংশ্লিষ্ট  তথ্য বিনিময় করে আসছেন।

 

চীনের চিয়াংসু প্রদেশের সুছিয়ান জলের শহর হিসেবে সুপরিচিত। স্থানীয় ছোট নদীর শাখা-প্রশাখা এখানে চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বয়ে চলেছে। আবহাওয়াও মোটামুটি ভালো। তাই জায়গাটি চীনের নদীতে কাঁকড়া লালনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মাস্টার্স শিক্ষার্থী ওয়াং মনে করেন, কাঁকড়া লালনের সাথে আবহাওয়া ও তাপমাত্রার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নদীর কাঁকড়া দ্রুত বড় হয়ে যায়। ইয়াংসি নদীর মধ্য ও নিম্ন অঞ্চলের তুলনায় কুইচৌ প্রদেশে শীতকালে ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সময় কম, যা কাঁকড়ার বড় হওয়ার জন্য সহায়ক এবং কুইচৌতে সূর্যালোকের সময়ও বেশি।

 

এখানে মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের গবেষণা থিসিস কুইচৌতে নদী কাঁকড়ার লালনপালনের সাথে সম্পর্কিত। মূলত নদীর কাঁকড়ার বড় হওয়ায় কিভাবে জল, পরিবেশ ও সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার প্রশাসনসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়।

 

এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণে আসার পর ৩ জন শিক্ষার্থী প্রায় সারাদিন ধানক্ষেতে থাকেন। ধানক্ষেতের মাটি সংগ্রহ করেন।  নদীর জল পরিমাপ করেন। কাঁকড়ার বড় হওয়ার তথ্য রেকর্ড করাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। সারা দিন নদীতে কাঁকড়া ও চিংড়ি মাছের দেখাশোনা করে তারা ঠিক যেন স্থানীয় গ্রামবাসীদের মতো অনেক কৃষিকাজের দক্ষতা শিখতে পেরেছেন।

 

এ প্রাঙ্গণের একদিকে শাংহাইয়ের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরেকদিকে কুইচৌ গ্রামাঞ্চলের ধানক্ষেত। মাস্টার্স শিক্ষার্থীরা গ্রামবাসীদের জন্য উন্নত কাঁকড়া লালনের প্রযুক্তি বয়ে এনেছেন এবং গ্রামবাসীদের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তাও দিয়েছেন। এ সম্পর্কে উলিউ গ্রামের সিপিসি’র সম্পাদক উ ছাং চ্য বলেন, গ্রামের এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণ সবার জন্য খোলা। গ্রামবাসীরা যে-কোনো কৃষিপ্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারেন এখানে এসে।

 

কুইচৌতে নদীতে কাঁকড়া লালনপালন শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ প্রকল্প তাদের স্নাতক থিসিসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রাঙ্গণে এমন অনেক সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ দেখা যায়, যা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে পাওয়া সম্ভব নয়। বাস্তব সমস্যার মোকাবিলায় মাটি ও কৃষকের সাথে আন্তরিক যোগাযোগের পর শিক্ষার্থীরা আরো ভালো করে কৃষিকাজ বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন এবং গ্রামীণ জীবনযাপনের বিস্তারিত ধারণা পাচ্ছেন।  

 

এআই যুগে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষার উন্নয়ন

এআই প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন সাধারণ শিক্ষাদান পদ্ধতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক, শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও বিষয়সহ বিভিন্ন খাতে সুগভীর প্রভাব রয়েছে এআই প্রযুক্তির, যা শিক্ষাদানের লক্ষ্য ও শিক্ষার উন্নয়নের রূপান্তরে প্রভাব ফেলবে। এ সম্পর্কে চীনের শিক্ষা ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাগারের সিপিসি’র সম্পাদক লি ইয়ং চি মনে করেন, এআই প্রযুক্তির সঠিক চেতনা সম্পর্কিত শিক্ষা চালু করা জরুরি।

 

কারণ, বর্তমানে এআই প্রযুক্তি অতি দ্রুত উন্নত হচ্ছে। এদিকে শিল্পযুগের শিক্ষাদান পদ্ধতি সামাজিক উন্নয়নের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এআই প্রযুক্তির যুগে ছাত্রছাত্রীদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো ও চরিত্রগঠন শিক্ষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি ব্যাপার। এ সম্পর্কে লি মনে করেন, উত্পন্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবজাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন। এটি বাষ্প ইঞ্জিন, বিদ্যুত্ ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ, যা সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ও প্রভাব বয়ে এনেছে। তাই কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত এআই প্রযুক্তির ব্যবহার, স্মার্ট যুগে নতুন ধরনের শিক্ষকদল গড়ে তোলা, এবং এআই প্রযুক্তি পরীক্ষা করতে উত্সাহ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

 

এ সম্পর্কে শাংহাই শিক্ষা ও পরীক্ষা একাডেমির উপ-প্রধান এবং চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাধ্যতামূলক শিক্ষার মান পর্যালোচনা বিশেষ কমিটির সদস্য ছাং শেং লং বলেন, শিক্ষার মানের পর্যালোচনায় পরিষেবা ও বুদ্ধিমত্তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। ছাত্রছাত্রীদের ভর্তিব্যবস্থা মোটামুটি সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন শিক্ষাদানের পর্যালোচনায় গভীর সংস্কার চালু করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে শিক্ষাদানের পর্যালোচনা ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা থেকে আলাদা হবে না, বরং তাদের পড়াশোনার বাস্তব পরিবেশের সাথে এর সংমিশ্রণ ঘটবে। তাই পর্যালোচনার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত উন্নয়নে পরামর্শ দেওয়া হবে বাস্তব পদক্ষেপ।

 

শিক্ষাদানের লক্ষ্য কেবল জ্ঞান দেওয়া নয়, বরং মানুষের মন ও আত্মার উন্নয়ন ঘটানো। গুণগত মানের শিক্ষার উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে, শিক্ষকদের নতুন যুগের সঠিক চেতনা গড়ে তোলা দরকার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন শিক্ষাদানের অগ্রগতিতে নতুন সুযোগ সুবিধা দেয়। তাই ৫জি, এআই প্রযুক্তি আর মেটাভার্সসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাদানের কার্যকারিতা বাড়ানো দরকার, যাতে শিক্ষাসম্পদের শ্রেষ্ঠ ও ভারসাম্য উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা যায়।

 

বেইজিং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় উচ্চশিক্ষা তদন্তকেন্দ্রের পরিচালক চাং চি ইয়ং বলেন, সঠিক শিক্ষাদানের চেতনায় শিক্ষা কাঠামো পুনর্গঠন করা জরুরি। তাঁর দৃষ্টিতে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার ও উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় কেউ কেউ শুধু স্কুলে ভর্তি করার ওপর গুরুত্ব দেয়, তবে শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেয় না। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বহুমুখী দক্ষতা ও নৈতিকতার চর্চায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 

তিনি মনে করেন, শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা চর্চায় যথেষ্ঠ গুরুত্ব না দিয়ে, কেবল মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া চলবে না। সঠিক শিক্ষাদানের চেতনা গড়ে তোলা এবং শিক্ষার ভালো পরিবেশ গঠন করা আরও জরুরি ব্যাপার।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)