বিজ্ঞানবিশ্ব ৫৩তম পর্ব
2024-01-15 18:47:29

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

৫৩তম পর্বে যা থাকছে:

 

* টেলিঅপারেটেড রোবট তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

* ব্লাড ক্যানসারের জন্য দায়ী জিন খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা

* চীনে শতবছর পর দেখা মিললো মিঠা পানির শামুকের

 

 

টেলিঅপারেটেড রোবট তৈরি করলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

২০১১ সালে হলিউডে মুক্তি পাওয়া হিউ জ্যাকম্যান অভিনীত রিয়েল স্টিল মুভির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? টেলিঅপারেটেড একটি রোবটকে নিয়ে ছিল সিনেমাটির গল্প। এবার চীনের একদল বিজ্ঞানী তৈরি করেছেন তেমনই এক বাইম্যানুয়াল টেলিঅপারেটেড রোবট।

দুই হাতে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সম্প্রতি এমন একটি বাইম্যানুয়াল টেলিঅপারেটেড রোবট তৈরি করেছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত কয়েকজন চীনা বিজ্ঞানী। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ওপেন সোর্স সিস্টেম।

 

মানুষের দেওয়া নির্দেশনায় রান্না থেকে শুরু করে ঘর পরিষ্কার এবং কাপড় ধুতে পারবে রোবটটি। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন মোবাইল আলোহা।

আলোহা ডাটাসেট ব্যবহার করে রোবটটিকে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। এরপর ওটা নিজে থেকেই অনেকগুলো কাজ করতে পারে। আবার চাইলে একজন ব্যবহারকারী রোবটটিকে পরিচালনা করতে পারবেন পাপেটের মতো।

মোবাইল আলোহা নিয়ে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, রোবটটির মধ্যে রয়েছে দক্ষ বাইম্যানুয়াল সেটআপ। এটি চাকাযুক্ত কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে এবং এর হাঁটার গতি মানুষের মতো। সেকেন্ড এক দশমিক ছয় মিটার পর্যন্ত যেতে পারে মোবাইল আলোহা।

রোবটটির জন্য আলাদা করে একটি রিমোট অপারেশন সিস্টেমও তৈরি করা হয়েছে। এতে করে রোবটটিকে একইসঙ্গে একটি বেইজ ও দুই হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ব্যবহারকারীরা।

৭৫ কেজি ওজনের মোবাইল আলোহা দেড় মিটার পর্যন্ত ১০০ নিউটন শক্তি প্রয়োগে সক্ষম।

সম্প্রতি এক ভিডিওতে গবেষকরা দেখিয়েছেন, রোবটটি নিজে থেকে চিংড়ি রান্না করতে পারে। একটি লিফট কল করে তাতে উঠতে পারে।

এছাড়া ডেস্কে ছড়িয়ে পড়া ওয়াইন মোছা, কোনো পাত্র কিচেন ক্যাবিনেটে তোলা, রান্নার পাত্র ধোয়া এবং চেয়ার এগিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে মানুষের ইশারা-ইঙ্গিতও বুঝতে পারে এটি।

অন্যদিকে রিমোট-কন্ট্রোলারের সাহায্যে রোবটটিকে দিয়ে কাপড় ইস্ত্রি, কফি মেশিন ব্যবহার, নিজেকে চার্জ দেওয়া, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার, ডিশওয়াশার লোড-আনলোড, ফ্রিজ থেকে পানীয় বের করা, বিয়ারের বোতল খোলা, নির্ধারিত স্থানে আবর্জনা ফেলা, পোষা প্রাণীর সঙ্গে খেলাসহ আরও কিছু কাজ করানো যাবে।

মোবাইল আলোহা নিয়ে যে তিনজন গবেষণা করেছেন, তাদের একজন থনি চাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাও জানিয়েছেন, রোবটটি এখনও বিশ্ব বাজারে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছায়নি।

আমেরিকান প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট ভেনচারবিটের তথ্যানুসারে, মোবাইল আলোহার পুরো সিস্টেমের জন্য ব্যয় হবে ৩২ হাজার মার্কিন ডলার। যেখানে আগের বাইম্যানুয়াল রোবট প্রযুক্তির পেছনে খরচ হতো ২ লাখ মার্কিন ডলার পর্যন্ত।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে একজন ব্যবহারকারী জানান, ‘অবশেষে গুরুত্বপূর্ণ ও কাজের কিছু উদ্ভাবন হলো।’

আরেক ব্যবহারকারী জানতে চেয়েছেন রোবটটি কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে। তিনি তার রান্নাঘরে ব্যবহারের জন্য এটি কিনতে আগ্রহী।

যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন রোবটটি এখনও পুরোপুরি নিখুঁত হয়নি। এর হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়্যারগুলোর মধ্যে আরও সামঞ্জস্য আনতে হবে। পাশাপাশি এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আব্দুল্লাহ

 

ব্লাড ক্যানসারের জন্য দায়ী জিন খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা

অস্থিমজ্জার ক্যান্সার লিউকেমিয়া। রোগটির প্রকৃত কারণ এখনও অজানা। তবে পারিবারিক ইতিহাস, জিনগত পরিবর্তন, পরিবেশগত, চিকিৎসা কিংবা ভাইরাল ইনফেকশন এর জন্য দায়ী হতে পারে। সম্প্রতি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে মানবদেহের এমন এক জিন খুঁজে পেয়েছেন, যা লিউকেমিয়ার ঝুঁকি মারাত্মক বাড়ায়।

রক্তে তিন ধরনের কণিকা থাকে—রেড ব্লাড সেল (আরবিসি) বা লোহিত রক্ত কণিকা, হোয়াইট ব্লাড সেল (ডব্লিউ বি সি) বা শ্বেত রক্ত কণিকা এবং প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা)।

অস্থিমজ্জার ভেতর এ রক্ত কণিকাগুলো তৈরি হয়ে শিরা উপশিরার মাধ্যমে শরীরের নানান অঙ্গে পৌঁছায়। ব্লাড ক্যানসার হলো অস্থিমজ্জার ভেতর শ্বেত রক্ত কণিকার (হোয়াইট ব্লাড সেল/ডব্লিউ বি সি) অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।

আবার অস্থিমজ্জা পর্যাপ্ত রক্তকণিকা তৈরিতে অক্ষম হলে দেখা দেয় লিউকেমিয়ার মতো মায়েলয়েড ম্যালিগন্যান্সি রোগ।

এ ধরনের রোগে স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট একটি কার্যকর পদ্ধতি হলেও দাতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তাই দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের রোগের কারণ জানার চেষ্টা করছেন এবং প্রাথমিক অবস্থায় রোগ শনাক্তের পদ্ধতিও খুঁজে আসছেন।

এবার মানুষের শরীরে লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে ভূমিকা রাখে এমন একটি জিন খুঁজে পেয়েছেন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা।

সেল জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা ইউকে বায়োব্যাঙ্ক থেকে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত ৪ লাখ ৬০ হাজার রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাটি করেছেন। এটি একটি বৃহৎ বায়োমেডিকাল ডাটাবেস।

 

এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে আগে কখনই এই জিনটিকে বিবেচনায় নেননি বিজ্ঞানীরা। তারা জিনটির নাম দিয়েছেন সিটিআর-৯। সিটিআর-৯ জিনের কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হলেই অস্থিমজ্জার ভেতর হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। যার ফলে মায়েলয়েড ম্যালিগন্যান্সির আশঙ্কা দশগুণ বেড়ে যায় বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।

গবেষণা নিবন্ধের প্রধান লেখক চাও চিয়াওয়েই জানান, ভবিষ্যতে একজন ব্যক্তি সম্ভাব্য ব্লাড ক্যানসারের রোগী হবে কি-না, তা এই জিনটির স্ক্রিনিং থেকেই বোঝা যাবে।

গবেষণাটি মূলত ইউরোপীয়দের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। তাই এ গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি এশিয়া ও আফ্রিকার মতো অঞ্চলের লোকদের জন্য প্রযোজ্য হবে কি-না সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নন গবেষকরা।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আব্দুল্লাহ

 

চীনে শতবছর পর দেখা মিললো মিঠা পানির শামুকের

বলা হয় প্রকৃতির বন্ধু শামুক। শামুকের শরীরে রয়েছে প্রাকৃতিক পানি শোধনের ব্যবস্থা। শামুক পান করে ময়লা পানি। কিন্তু এর মধ্যে কিছু উপাদান তারা খাবার হিসেবে শরীরে রেখে বিশুদ্ধ পানি ছেড়ে দেয় বাইরে। আর যে ক্ষেতে শামুক থাকে, সেই ক্ষেতের উর্বরতা শক্তিও বাড়ে। ফসলও ফলে বেশি। আর এভাবেই অগোচরে প্রকৃতি ও কৃষকের বন্ধুর ভূমিকা পালন করছে শামুক । পৃথিবীতে প্রায় ৪৩ হাজার প্রজাতির শামুক আছে। এর মধ্যে ডোরাকাটা মিঠা পানির শামুক খুবই বিরল। ১২০ বছর পর চীনে দেখা মিলেছে ওই প্রজাতির শামুকের।

 

বলতে গেলে প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গিয়েছিল ডোরাকাটা খোলসযুক্ত মিঠা পানির শামুক। ১২০ বছর পর সেটাকে পুনরায় আবিষ্কার করেছেন একদল গবেষক।

দক্ষিণ চীনের কুয়াংসি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কয়েকটি নদীতে পাওয়া গেছে এ শামুক।

চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি এবং জার্মানির বার্লিনের ফার নাতুরকুন্দ জাদুঘরের গবেষকরা যৌথভাবে আবিষ্কারটি করেছেন। জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা জার্নাল ‘প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি’তে এসব তথ্য জানানো হয়।

শামুক মলাস্কা পর্বের প্রাণী। এ পর্বে আছে ঝিনুক, স্কুইড এবং অক্টোপাসের মতো প্রাণীরাও। এদের আছে আবার নানান শ্রেণি। শামুকের অবস্থান গ্যাসট্রোপড শ্রেণিতে। এরা মরুভূমি, পাহাড়, জলাভূমি, বনভূমি, সাগর, মহাসাগরসহ প্রায় সব জায়গাতেই থাকতে পারে।

পুনরায় আবিষ্কৃত বিরল প্রজাতির শামুকটি ‘হেলিকোস্টোয়া’ নামে পরিচিত।

ফার নাতুরকুন্দ জাদুঘরের গবেষক চাং লেচিয়া জানান, হেলিকোস্টোয়া মিঠাপানির বিরল শামুক। এটি ঝিনুকের মতো শিলা পৃষ্ঠের সঙ্গে লেগে থাকতে পারে।

ফরাসি বিজ্ঞানীরা প্রথম এই প্রজাতির শামুকের সন্ধান পান। এরপর আর কখনও এর দেখা পাওয়া যায়নি।

শামুকগুলো শহরাঞ্চল এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে বলে এরা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় আছে।

নতুন আবিষ্কৃত হেলিকোস্টোয়া শামুকটির সঙ্গে একই প্রজাতির আগের শামুকগুলোর নমুনার সঙ্গে তুলনা করেছেন গবেষকরা। এরপর তারা নতুন প্রজাতির নাম দিয়েছেন ‘হেলিকোস্টোয়া লিউয়াই’। এটি ১০০ বছর আগের হেলিকোস্টোয়া থেকে কিছুটা ভিন্ন।

তবে এখনও বিবর্তন সংক্রান্ত পড়াশোনার গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসেবে আছে হেলিকোস্টোয়া শামুক।

শক্ত খোলসের প্রাকৃতিক সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও নিরীহ এই ছোট্ট প্রাণীটি প্রায়ই অন্য প্রাণীর শিকারে পরিণত হয়।

এদিকে আকারে ছোট হলেও বাস্তুসংস্থানে শামুকের আছে দারুণ ভূমিকা। বিভিন্ন বীজ ও আগাছা খেয়ে এরা আশপাশের গাছপালার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। আবার বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহ খেয়েও এরা মাটির উর্বরতার চক্র নিশ্চিত করে।

মোটকথা, জলাভূমি বা বনাঞ্চলে গাছপালার বৃদ্ধিতে শামুকের ভূমিকা মোটেও অস্বীকার করার মতো নয়।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: ফয়সল আব্দুল্লাহ

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- ফয়সল আব্দুল্লাহ

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী