চলতি বাণিজ্য-পর্ব ৫২
2024-01-12 14:28:32

চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান

চলতি বাণিজ্য-পর্ব ৫২

চলতি বাণিজ্যের ৫২তম পর্বে থাকছে:

১. বিশ্বজুড়ে বেড়েছে চীনা কিচেনওয়্যারের চাহিদা

২. বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘হেইটি’

৩. চীন বাংলাদেশ বাণিজ্য বেড়েছে প্রায় তিনগুণ

 

বিশ্বজুড়ে বেড়েছে চীনা কিচেনওয়্যারের চাহিদা

শুভ আনোয়ার, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: গুণগত মান ভালো হওয়ায় এবং তুলনামূলকভাবে দাম কম হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাহিদার শীর্ষে পৌঁছেছে চীনের তৈরি কিচেনওয়্যার। প্রায় প্রতিদিনই দেশটির কারখানাগুলোতে বিপুল পরিমাণ অর্ডার আসছে।

২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহেই বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন পূর্ব চীনের শানতোং প্রদেশের একটি ছোট শহরের কিচেনওয়্যার শ্রমিকরা। কেননা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অর্ডারগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে।

ছোট্ট এ শহরটির নাম বিনচৌ। এ শহরের বক্সিং কাউন্টিতে ২ হাজার ৮০০টিরও বেশি কিচেনওয়্যার কারখানা রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে কারখানাগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিলে ২ হাজারেরও বেশি কাস্টমাইজড কমার্শিয়াল কিচেনওয়্যার তৈরির অর্ডার পেয়েছে। এসব কারখানায় বার্ষিক ৩ হাজার কোটি ইউয়ান মূল্যের কিচেনওয়্যার উৎপাদিত হয়।

পশ্চিমা কিচেনওয়্যার সরবরাহকারী এসকোফিয়ারের বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ব্যবস্থাপক চাও ফেই জানান, ইংরেজি নববর্ষের দিন থেকে কারখানায় কোনও বিরতি নেই; ক্রমাগত নতুন নতুন অর্ডার আসছে।বিশ্বব্যাপী বিপুল চাহিদার কারণে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত হয়েছে এবং কারখানাগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে শহরটি কাস্টমাইজড কমার্শিয়াল কিচেনওয়্যার উৎপাদনের সমৃদ্ধ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে; সীমিত সম্পদ এবং ভৌগলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেও বছরে ২ কোটি সেট কিচেনওয়্যার উৎপাদন করছে। বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে এবং বাজারের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে এ শহরটিতে কিচেনওয়্যার গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমও পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানান শহরের প্রধান ওয়াং চাওচিয়ান। গোটা চীনে যে রান্নাঘরের জিনিসপত্র বিক্রি হয়, তার ৪০ শতাংশের বেশি উৎপাদিত হয় বিনচৌ শহরে।

গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর জন্য চলতি বছর শহরটি ডিজিটালাইজেশন, তথ্যপ্রযুক্তি, সবুজ ও স্বল্প-কার্বন নিঃসরণের ফলে বিভিন্ন দেশ এসব পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে। শানতোং ইউনিভার্সিটি এবং শানতোং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে একটি কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কিচেনওয়্যার গবেষণা ইন্সটিটিউটও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চীনের এই শহরটিতে ১০০টিরও বেশি কিচেনওয়্যার সম্পর্কিত পেটেন্ট রয়েছে।

 

কোম্পানি প্রোফাইল:

বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘হেইটি’

শুভ আনোয়ার, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চীনের পানীয় প্রস্তুতকারক ও পরিবেশকদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘হেইটি’। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বজুড়েই বেশ জনপ্রিয়। প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে এর আউটলেটের সংখ্যা। বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে ‘হেইটি’র আউটলেটের সংখ্যা ৩ হাজার ২০০ ছাড়িয়ে গেছে।

সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩ সালে নতুন ধরনের চা পানীয়ের চীনা ব্র্যান্ড ‘হেইটি’র ব্যবসায়িক পরিধি পুরো পৃথিবীতে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যেই বৃহৎ এই প্রতিষ্ঠানটি ২১০টিরও বেশি নতুন শহরে তাদের আউটলেট খুলেছে। পাশাপাশি একই বছর ১০ কোটির বেশি গ্রাহক সংগ্রহ করেছে।

এটি বিশ্বের প্রথম কোনও চা পানীয় ব্র্যান্ড, যার ডোমেন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

২০২২ সালের নভেম্বরে হেইটির ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল চালু হওয়ার পর থেকে ২ হাজার ৩০০টি ফ্র্যাঞ্চাইজি আউটলেট খুলেছে তারা। সামগ্রিকভাবে এর আউটলেটের সংখ্যা বছরে ২৮০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২৩ সালেই মূলত হেইটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তাদের ব্যবসার সম্প্রসারণের গতি ত্বরান্বিত করে। আগস্ট থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে তারা আউটলেট খোলে। লন্ডনের সোহো অঞ্চলে হেইটি আউটলেট একদিনে ২ হাজার বোতল বিক্রির রেকর্ড করেছে, যার বাজার মূল্য ১২ হাজার পাউন্ড বা ১৫ হাজার ১৪৫ ডলার। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের সোয়ানস্টন স্ট্রিটের আউটলেটগুলোতেও একদিনে ৩ হাজার বোতল বিক্রির রেকর্ড তৈরি করেছে।

এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতে গত ৪ ডিসেম্বর একটি আউটলেটের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের প্রথমদিনেই এ আউটলেটে ২ হাজার ৫০০ বোতল বিক্রি হয়। নিউইয়র্ক সিটির টাইমস স্কয়ারে ওই সময় বড় পর্দায় কোম্পানিটির চীনা নতুন-স্টাইলের চা পানীয়ের বিজ্ঞান প্রদর্শিত হয়।

কোম্পানিটির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাদের ৯০ শতাংশ ফ্র্যাঞ্চাইজি আউটলেট বিভিন্ন দেশের উচ্চমানের বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত। ৫০ থেকে ৮৯ বর্গমিটার আকারের প্রতিটি আউটলেট বেশ জনপ্রিয়। এসব আউটলেট খোলার প্রথম মাসে ১০ লাখ ইউয়ানেরও বেশি মূল্যের পণ্য বিক্রি হয়।

কোম্পানির একজন মুখপাত্র জানান, নতুন বছরে ভোক্তাদের আরও ভাল পণ্য এবং পরিষেবা সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।

বেইজিংভিত্তিক বাজার পরামর্শদাতা ১৬৮-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, চীনের নতুন ধরনের চা পানীয়ের বাজার ২০২৫ সাল নাগাদ ৩৩ হাজার ৩৪০ কোটি ইউয়ান থেকে বেড়ে ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি ইউয়ানে পৌঁছাবে।

 

ভিনদেশে চীন:

চীন বাংলাদেশ বাণিজ্য বেড়েছে প্রায় তিনগুণ

শুভ আনোয়ার, চীন আন্তর্জাতিক বেতার:

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। ক্রমশ সম্প্রসারণ হচ্ছে দুই দেশের বাণিজ্য। দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশই চীন থেকে আসে। গেল বছর চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক জোরদারে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ। গত এক দশকেরও বেশি সময়ে প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ওদ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য।

চীন বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও বন্ধু রাষ্ট্র। দেশটি বেল্ট অ্যান্ট রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে আসছে। বন্ধু হিসেবে চীনের অবস্থান দৃঢ় হয়েছে, যার প্রতিফলন সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। ফলে গত এক দশক পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্য প্রায় তিন গুণ বেড়ে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যত বড় হবে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চীনের সঙ্গেও বাণিজ্য বাড়বে।

সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৪ শতাংশই হয় পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ এ দেশটির সঙ্গে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য হয়েছিল ৬৭৭ কোটি ডলারের। এর ১৩ বছর পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণেরও বেশি বেড়ে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক চুল্লি, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, তুলা, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, সাউন্ড রেকর্ডার ও রিপ্রডিউসার, কাপড়, কৃত্রিম তন্তু ইত্যাদি। দেশটিতে রপ্তানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওভেন পোশাক, নিটওয়্যার, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতো ইত্যাদি।

বাংলাদেশকে ঘিরে আঞ্চলিক যোগাযোগ সৃষ্টিতে চীন প্রচেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি রুটের পাশাপাশি একটি শিল্পাঞ্চল তৈরির উদ্যোগও রয়েছে দেশটির। এর অংশ হিসেবে আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন কয়েক শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। চীন থেকে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে স্থানান্তর হতে পারে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাই কেবল চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে রাজনৈতিক লক্ষ্য বিচারে বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে এখনো চীনকে বড় উৎস হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও রয়েছে চীনের ব্যাপক অবদান। বেল্ট অ্যান্ট রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় এরই মধ্যে প্রায় ৫০০ কোটি ওডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এক হাজার ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কাজ চলমান। ২০২৬ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোয় বিনিয়োগ আসতে পারে আরও ৫৫০ কোটি ডলারের মতো।

চাইনিজ কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২ হাজার ৮শ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের কাঁচা চামড়া ও চামড়া রপ্তানি করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬০০-এরও বেশি চীনা কম্পানি বিনিয়োগ করেছে।

বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুল অর্থের পণ্য চীন থেকে আমদানি করলেও দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয় খুব কম। তার পরও দেশটির সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্য বাড়বে। কেননা বাংলাদেশ যেসব রপ্তানি করছে বা নতুন করে রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরির বিষয়ে ভাবছে সেগুলোর যন্ত্রাংশ, কেমিক্যাল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির প্রধান উৎস চীন। ফলে বাংলাদেশের প্রধান খাতগুলোকে তাদের প্রয়োজনেই দেশটি থেকে এসব কাঁচামাল আমদানি করতে হয়।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- নাজমুল হক রাইয়ান

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী