চীনে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাসনদের গুরুত্ব
2024-01-10 11:00:34

চীন একটি জনবহুল দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে উচ্চশিক্ষার্থী সংখ্যাও অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। দেশের বিভিন্ন মহানগর, প্রদেশ ও এলাকায় শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষার মানের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষাসনদের মানও ভিন্ন। বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান যখন নিয়োগ দেয়, তখন চাকরিপ্রার্থী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পেয়েছে, সেদিকে বিশেষ নজর দেয়। যারা সাধারণ বা অপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন, তাদের চাকরি পাওয়া তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করবো।

 

শুরুতে একটি ছেলের কর্মসংস্থানের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই। তার নাম লিন ছি। উচ্চবিদ্যালয়ে তার পরীক্ষার ফলাফল বেশ ভালো ছিল না। ফলে শুধু জন্মস্থানের একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পায় সে। পরে যদিও সে অনেক চেষ্টা করে, অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রী পেয়েছেন, তবে কর্মসংস্থানের বাজারে সিভি দেওয়ার সময় তার স্নাতক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান তেমন উচ্চ না হওয়ায় তিনি ভালো চাকরি পাচ্ছিলেন না। এ সম্পর্কে ছেলে লিন ছি বলেন, একজন শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে উন্নতি করতে পারে, এটা কোনো স্থির বিষয় নয়। যদি শুধু স্নাতক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয়, তবে সেটা হবে অন্যায়। অনার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আরও ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

তার মতো আরো অনেক ছাত্রছাত্রী একই সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এ প্রেক্ষাপটে, ২০২০ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ ‘নতুন যুগে শিক্ষার পর্যালোচনা ব্যবস্থার সংস্কার প্রস্তাব’ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, সঠিক পদ্ধতিতে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগের কোম্পানি যখন কর্মী নিয়োগ করবে, তখন কেবল স্নাতকপত্র বা স্নাতক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাঙ্কিং ও মর্যাদা বিবেচনা করলে চলবে না; সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য উপযোগী ও দক্ষ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ করাও জরুরি। তাদের চরিত্র, কর্মদক্ষতা, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় রাখতে হবে, শুধু শিক্ষাসনদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া চলবে না।

সম্প্রতি চায়না ইউথ পত্রিকা সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮০ শতাংশেরও বেশি মনে করেন, কর্মসংস্থান বাজারে এইচআর বিভাগ অনার্স স্নাতকপত্রের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়। উচ্চবিদ্যালয়ে বা কাওখাও পরীক্ষায় ভালো স্কোর না পাওয়ার কারণে, অনেকে শুধু প্রাদেশিক পর্যায়ের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। তারা যদি ভালো চাকরি পেতে চান, তাহলে আরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। ফলে, তাদের মধ্যে অনেকে অনার্স স্নাতক হওয়ার পর ভালো রাঙ্কিং বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ার জন্য প্রচেষ্টা চালান।

লিন ছি প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র। তার কলেজের অনেক ছাত্রছাত্রী স্নাতক হওয়ার পর কারখানায় প্রযুক্তিকর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তবে সেটি সাধারণ কর্মকর্তাদের কাজের চেয়ে বেশি ক্লান্তিকর। তাই সে অন্য একটি ভালো রাঙ্কিংয়ের বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিয়ে, মাস্টার্স পড়তে শুরু করে। তার দৃষ্টিতে এখান থেকে স্নাতক হওয়ার পর যদি ভালো স্কোর থাকে, তাহলে গবেষণাগারে চাকরি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

কোনো কোনো চীনা পণ্ডিত মনে করেন, যারা শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স কোর্স করেছে, তারা চমত্কার শিক্ষক ও বিজ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়েছে। আর এ কারণেই তারা সমাজের প্রয়োজনীয় দক্ষ ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে।

ছেলে লিন ছি নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলে, অনার্সে পড়ার সময় একটি ভালো কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ পাওয়াও কঠিন। প্রত্যেকবার এইচআর বিভাগের কর্মীরা তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার বিশ্ববিদ্যালয় অন্য শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে দুর্বল। কেন আমরা তোমাকে বেছে নিবো?

যদিও ছেলে লিন ছি মনে করে যে, তার পেশাদার দক্ষতা মোটামুটি ভালো, তবে আরও ভালো চাকরি পেতে চাইলে তাকে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী হতে হবে। একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, যারা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স স্নাতক হয়েছেন, তাদের উচ্চশিক্ষা তথা মাস্টার্সে পড়ার সময় এক থেকে দেড় বছর বেড়ে যায়। তবে শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স মেজরে ভর্তি হওয়াও সহজ ব্যাপার নয়।

ছেলে লিন ছি মনে করে, মাস্টার্স পরীক্ষার প্রস্তুতির প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার ক্যাম্পাসে শিথিল পরিবেশ। কারণ তাদের ক্লাসরুম অনেক বড় এবং একটি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বেশি। তাই শিক্ষকরা শুধু ক্লাসের বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেন, ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে ক্লাস শুনে কি না, তা জনে জনে জানার সুযোগ পান না। কিছু ছাত্রছাত্রী শুধু ক্লাসে মোবাইল ফোনে গেমস খেলে। তাই তাদের জন্য ভালো স্কোর করা কঠিন হয়ে যায়।

মাস্টার্সে পড়ার সময় ছেলে লিন ছি অন্য সহপাঠীদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছে। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জন চেষ্টা করেছে এবং ক্লাসের পর গ্রন্থাগারে সময় কাটিয়েছে। অধিক মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনার সুবিধার্থে সে মাস্টার্স পরীক্ষার শিক্ষার্থীদের হোস্টেলে থাকে এবং নিজের জন্য বিস্তারিত পড়াশোনার সময়সূচি তৈরি করে। তার হিসাবে গত কয়েক বছরে মাস্টার্সে ভর্তি জন্য যোগ্যতা অনেকে বেড়েছে। তাই, তার জন্য মাস্টার্সে ভর্তিপরীক্ষা ‘কাওখাও’-য়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ। যখন ক্লান্ত লাগে, তখন ওয়েবসাইট থেকে অন্যদের মাস্টার্স পরীক্ষার প্রস্তুতির ভিডিও আর অভিজ্ঞতা দেখে সে। এভাবে নিজেকে অনুপ্রেরণা দেয় এবং মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে।

অন্যদের দৃষ্টিতে কেবল মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করা সাফল্যের প্রতীক নয়। ডিগ্রী থাকলেও ভালো চাকরি খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। শিক্ষার্থী চাং ওয়ে সিন মনে করে, চলমান পরিস্থিতিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে একটি চাকরি খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে জরুরি। কারণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা, অন্যান্য কোম্পানি বা বিশ্বের ৫০০টি শক্তিশালী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো নয়। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি, অবসর সময়ে শিক্ষক-সনদপত্র, ম্যান্ডারিন ভাষার সনদপত্রসহ বিভিন্ন পেশাদার সনদপত্র অর্জন করা জরুরি। সেক্ষেত্রে ভালো চাকরি খুঁজে পাওয়া সহজতর হবে।

 

পিতামাতাদের সাথে দূরত্ব দূর করার উপায়

চীনের নগরায়নের প্রক্রিয়ায়, গ্রামাঞ্চলের অনেক পিতামাতা চাকরির জন্য বড় প্রদেশ বা শহরে কাজ করতে আসেন। ফলে তাদের ছোট বাচ্চারা জন্মস্থানে থাকে, নানা-নানী বা দাদা-দাদীর কাছে। দীর্ঘকাল ধরে এসব বাচ্চা পিতামাতার সাথে না থাকায় তাদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে না; এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যখন তারা একটু বড় হয়, তখন তাদের কেউ কেউ মানসিক সমস্যায়ও ভুগতে থাকে। এ সমস্যা মোকাবিলায় কুইচৌ প্রদেশে একটি বিশেষ হটলাইন চালু হয়েছে। এটি হচ্ছে ১২৩৫৫। ছাত্রছাত্রীরা এ ফোন নম্বরে ফোন করে পেশাদার মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শকের কাছ থেকে সাহায্য ও পরামর্শ পেতে পারে। ১৮ বছর বয়সের মেয়ে লিনলিন তার বাবা-মার সাথে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে না। নিজের ছোটবেলার গল্প স্মরণ করে লিনলিন বলে, “আমার বাবা-মা কখনও আমার সাথে থাকতেন না। এক বছরের মধ্যে কেবল একবার তাদের সাথে আমার দেখা হতো। অপরিচিত কেউ হলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু তারা যেহেতু আমার পিতামাতা, তাই আমার তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা কষ্টকর হতো। আমার মনের সাথে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল।”

মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শক চাং হেং রং ফোন থেকে লিনলিনের উদ্বেগ ও বিরক্ত অনুভব করেন। তিনি মনে করেন, বস্তুত লিনলিন বাবা-মাকে গুরুত্ব দেয়, তবে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া তার জন্য সহজ ব্যাপার নয়। তিনি লিনলিনকে সান্ত্বনা দেন এবং পরামর্শ দেন যে, নিয়মিত বাবা-মায়ের সাথে আড্ডা দিতে হবে এবং মনের কথা তাদের সাথে শেয়ার করতে হবে। এভাবে দূরত্ব কমে আসতে পারে। তিনি বলেন, যখন বাবা-মার সাথে ভালো করে আড্ডা দেবে, তখন তা একটি নোটবুকে টুকে রাখবে।

পরামর্শক চাংয়ের সহায়তায় লিন লিনের সাথে বাবা-মার সাথে সম্পর্ক খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয় এবং তাদের সাথে কথাবার্তার মাত্রাও বাড়তে থাকে।

বস্তুত চীনের কুইচৌ প্রদেশসহ আরও অনেক জায়গায় অনেক গ্রামাঞ্চলের বাচ্চারা একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। তাদের বাবা-মা অনেক দূরের শহর বা জেলায় চাকরি করে, তাই সন্তানের সাথে পিতামাতার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দাদা-দাদীরা বাচ্চাদের খাওয়া-থাকার যত্ন নিতে পারেন, তবে তাদের মানসিক চাহিদা মেটানো বা মেজাজ মোকাবিলা করা মুশকিল। ফলে অনেক বাচ্চার মানসিক অবস্থা দুর্বল হয়, চরিত্র হয় অন্তর্মুখী। এটা শুরুর দিকে কেবল বাবা-মার সাথে আড্ডার সময় দেখা যায়, তবে বড় হওয়ার পর অন্যদের সাথেও সহাবস্থান বা যোগাযোগ করা তাদের জন্য কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই বাবা-মার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে অন্যদের সাথে যোগাযোগের সমস্যাও দূর হয়ে যায়।

বাবা-মা যদি বাচ্চার এমন সমস্যা বোঝেন, তখন তাদের মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করা উচিত। কেবল দু’পক্ষের যৌথ প্রয়াসে সম্পর্ক উন্নতি করা সম্ভব। এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অনেক পিতামাতা বাচ্চার বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় খুবই কম সময় থাকেন, তাই তারাও বাচ্চার সাথে আড্ডা করতে পারেন না। শুধু তাদের পড়াশোনা বা পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন। তবে এ সব কথা বাচ্চাদের জন্য আকর্ষণীয় ব্যাপার নয়। তাই বাচ্চাদের জীবনের ক্ষুদ্র কাজ বা তাদের প্রিয় কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলা জরুরি। বাবা-মার উচিত বেশিভাগ সময় বাচ্চাকে প্রশংসা করা এবং তাদের সাথে ছোট কাজ নিয়ে নিয়মিত কথা বলা। এটি বাচ্চাদের মানসিক সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)