জাতীয় পার্ক: হোম ও স্বপ্ন
2024-01-10 10:23:04

গত ২২ ডিসেম্বর চীনের ছিংহাই প্রাদেশিক সরকার সান চিয়াং ইউয়ান বা তিনটি নদীর উত্স জাতীয় পার্ক সম্পর্কিত একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চীনের প্রথম জাতীয় পার্ক পরীক্ষামূলক সাইট ও প্রথম চলান জাতীয় পার্কের অন্যতম সান চিয়াং ইউয়ান জাতীয় পার্কে পাহাড়, পানি, বন, ক্ষেত, খাস, বালি ও বরফসহ সব প্রাকৃতিক সম্পদের সমন্বয় সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়িত হয়েছে। দু বছরের কাজের মাধ্যমে ইয়াংজি নদী, হুয়াং হ্য নদী ও লাছাং নদীর উত্সের সার্বিক সংরক্ষণ বাস্তবায়িত করে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সান চিয়াং ইউয়ান জাতীয় পার্ক চালু হবার পর থেকে মোট ৬৬২ কোটি ১০ লাখ ইউয়ান বিনিয়োগ করা হয়েছে। পানিসম্পদের পরিমাণ, বনাঞ্চলের আয়তন ও বৈচিত্র্য দিন দিন বাড়ছে। পার্কে তিব্বতি অ্যান্টিলোপের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজারটিতে। পার্কে বাস করা ২০ হাজার পশুপালককে প্রাকৃতিক সংরক্ষণকর্মী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি পরিবর্তন হবার পাশাপাশি আয়ও আগের চেয়ে বেড়েছে।

বিশ্বের প্রথম জাতীয় পার্ক ও বৃহত্তম জাতীয় পার্ক ব্যবস্থা

বিশ্বের প্রথম জাতীয় পার্ক প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে আর বিশ্বের বৃহত্তম জাতীয় পার্ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় চীনে। মানুষ জাতীয় পার্ক পদ্ধতির মাধ্যমে সংস্কৃতিকে রক্ষা করে এবং মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান নিশ্চিত করে।

একশ’ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি কর্নেলিয়াস হেঙ্গেস ইয়েলোস্টোন এলাকার সংরক্ষণে প্রথম বারের মতো জাতীয় পার্কের ধারণা উত্থাপন করে। ১৮৭২ সালের ১ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট একটি আদেশ সই করেন এবং এর আওতায় ৮ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ইয়েলোস্টোন জাতীয় পার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় পার্ক ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকার ধারণা বিশ্বের ২০০টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে। বিশ্ব ঐহিত্য, প্রাকৃতিক সংরক্ষণ ব্যবস্থাসহ নানা নতুন ধারণা জন্ম হয়েছে। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে চীনের সিপিসির অষ্টাদশ জাতীয় কংগ্রেসে প্রথম বারের মতো জাতীয় পার্ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয় এবং তখন থেকে ১০ বছর কেটে গেছে।

২০২১ সালের ১২ অক্টোবর জীববৈচিত্র কনভেনশনে স্বাক্ষরকারীদের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলনে চীন প্রথম চলান জাতীয় পার্ক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। প্রথম চলান জাতীয় পার্ক হলো সান চিয়াং ইউয়ান, জায়ান্ট পান্ডা, সাইবেরিয়ান টাইগার ও চিতাবাঘ, হাইনান ক্রান্তীয় রেইনফরেস্ট এবং উই পাহাড় জাতীয় পার্ক।

২০২২ সালের নভেম্বর মাসে চীন জাতীয় পার্ক বিন্যাস পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এতে রয়েছে ৪৯টি জাতীয় পার্কের এলাকা যার মোট আয়তন ১১ লাখ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ জাতীয় পর্যায়ের বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণ এলাকা।

বর্তমানে প্রথম ৫টি জাতীয় পার্ক সুষ্ঠুভাবে চলছে এবং নতুন দফার ১৭টি জাতীয় পার্কের প্রস্তুতি কাজও চলছে।

জাতীয় পার্ক কী? কেন জাতীয় পার্ক নির্মাণ করতে হয়?

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, চরম আবহাওয়া আগের চেয়ে আরও বেশি দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জীবনযাপনের উপর প্রভাব ফেলছে। চীন জাতীয় পার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে। বিশ্বের প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন) ধারণা অনুযায়ী, জাতীয় পার্ক মানে বড় আকারের প্রকৃতি বা প্রকৃতির মতো জায়গা, যা ব্যাপকভাবে ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ব্যবস্থা, জীববৈচিত্র ও প্রকৃতির বৈচিত্র রক্ষা করে।পাশাপাশি পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মানসিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষা ও বিনোদনের সুযোগ প্রদান করে। 

পৃথিবী সংরক্ষণ প্রতিবেদন ২০১৪ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকার মধ্যে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ হলো জাতীয় পার্ক। জাতীয় পার্কের মোট আয়তন ৫৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার। অন্য দিকে ২০১৪ সালে জাতিসংঘের প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা নামতালিকা অনুযায়ী বিশ্বে মোট ২ লাখ ৯৪২৯টি প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে বৃহত্তম স্থল প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা ডেনমার্কের উত্তর-পূর্বে গ্রীনল্যান্ডে অবস্থিত। সেটির আয়তন ৭ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার। বিশ্বব্যাপী এত বেশি জাতীয় পার্ক ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা প্রতিষ্ঠা থেকে বোঝা যায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান একটি কাজ।

বিশ্বের প্রথম জাতীয় পার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এক শতাব্দী সময়ে জাতীয় পার্কের ধারণাও পরিবর্তন হচ্ছে। তার বিষয়বস্তু নানা দেশে সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে। জাতীয় পার্ক এখন বিশ্ববিখ্যাত, প্রভাব বিস্তারকারী ও আকর্ষণীয় একটি প্রাকৃতিক সংরক্ষণের পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে কার্যকরভাবে প্রকৃতি রক্ষা করে চলেছে।

চীনা সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের এবং এটা এখন প্রাণবন্ত। এর অন্যতম কারণ হলো চীনা সভ্যতার উন্মুক্তকরণ ও সহনশীলতা। যদিও জাতীর্য় পার্ক বিদেশ থেকে আসা একটি ধারণা, তবে ৩ হাজার বছর আগে চীন প্রকৃতি সংরক্ষণের ধারণার জন্ম হয় এবং অনুশীলন শুরু হয়।বলা যায়, চীনের নানা পাহাড়ী দর্শনীয় স্থান প্রথম প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা। ১৯৫৬ সালে কুয়াং তুং প্রদেশের তিন শান হ্রদে প্রতিষ্ঠিত হয় চীনের প্রথম প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা। ১৯৭৮ সালে চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হবার পর এমন এলাকার সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। প্রাকৃতিক সংরক্ষণ ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কনভেনশনে যোগ দেয় চীন। 

২০১৩ সালে চীনে প্রতিষ্ঠিত হয় ১০ ধরনের প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা। যেমন পাহাড়ী দর্শনী স্থান, বন পার্ক, বিশ্ব ঐতিহ্য, জিওপার্ক এবং জল সংরক্ষণের দর্শনীয় এলাকা, জলাভূমি পার্ক, শহর জলাভূমি পার্ক, সুমদ্র বিশেষ সংরক্ষণ এলাকা, ওশান পার্ক ইত্যাদি। চীনে মোট ৭ হাজার ৪০৩টি প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা রয়েছে, যা ভূখণ্ডের ১৭ শতাংশ।   

প্রকৃতিতে জাতীয় পার্কের সীমানা নির্ধারণ সহজ, তবে জাতীয় পার্কের ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা নির্ধারণ কঠিন ব্যাপার। এটিও চীনের জন্য বর্তমান বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। চীন বিশ্বের প্রথম দেশ যেটি ‘প্রকৃতি সভ্যতা’র ধারণা উত্থাপন করে এবং একমাত্র দেশ যেটি ‘প্রকৃতি সভ্যতা’কে জাতীয় কৌশল হিসেবে অন্তর্ভূক্ত ও বাস্তবায়ন করছে। পাশাপাশি চীনের তথ্যায়ন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিতে উন্নয়ন হচ্ছে, চীন বিশ্বে বৃহত্তম আকারে ও নানাভাবে প্রাকৃতিক সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার কাজ করে। এমন প্রেক্ষাপটে চীনের জাতীয় পার্ক নির্মাণ জাতীয় কৌশলের দিক থেকে বিশ্বের অন্য ১০০টি দেশ থেকে জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং তথ্য প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নিজের জাতীয় পার্ক ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি খুঁজে পাবে। 

জাতীয় পার্ক থেকে কী লাভ হয়?  

সান চিয়াং ইউয়ান চীনের প্রথম জাতীয় পার্ক। ইউন থা এখানে বাস করা একজন পশুপালক ছিলেন। আগে তার পরিবারের জীবিকা ছিল পশু পালনের ওপর নির্ভরশীল। সান চিয়াং ইউয়ান জাতীয় পার্ক প্রতিষ্ঠার পর তিনি একজন প্রাকৃতিক সংরক্ষণ কর্মীতে পরিণত হন এবং পারিবারিক হোটেল ব্যবসা করেন। তার বার্ষিক আয় ৩০ হাজার ইউয়ান বৃদ্ধি পেয়েছে। ছিংহাই প্রদেশে ইউন থার মতো অনেক পশুপালক ফ্র্যাঞ্চাইজ অর্জন করেছেন এবং এর মধ্যমে জাতীয় পার্ক-সংশ্লিষ্ট প্রকৃতি পর্যটন ব্যবসা করেন।

ছিলিয়ান শান জাতীয় পার্কে ২০১৮ সালে  পর্যবেক্ষণ ক্যামেরার মাধ্যমে তুষার চিতা চিত্র তোলা হয়। তুষার চিতার মা তার ৪টি বাচ্চা নিয়ে বনে খেলে। প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পর্যবেক্ষণ ক্যামেরায় তুষার চিতার সংখ্যাও বেশি হয়। একটি তুষার চিতার খাবার হিসেবে ৩০০-৪০০টি নীল ভেড়া দরকার। আর ৩০০-৪০০টি নীলভেড়ার জন্য ১০০ বর্গকিলোমিটার তৃণভূমি লাগে।  

আগে যারা ছিহাং প্রদেশে বিনিয়োগ করতে আসতেন, তারা মূলত স্থানীয় খনিজ সম্পদের ব্যবসা করতে চাইতেন আর এখন ছিংহাইতে বিনিয়োগকারীরা প্রাকৃতিক সম্পদে বিনিয়োগ করেন এবং সবুজ উন্নয়নের সুযোগ খুঁজে পান। স্থানীয় সরকারও জাতীয় পার্ক নির্মাণকে নিজের মূল কাজ হিসেবে গ্রহণ করেছে। সরকার থেকে বিনিয়োগকারী পর্যন্ত জাতীয় পার্ক সম্পর্কে সবার ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে।

পশুপালক ইউন থার নিজ জেলা আং সাই হচ্ছে সানচিয়াং ইউয়ান জাতীয় পার্কের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজ। পর্যটকরা স্থানীয় মানুষের বাড়িতে বাস করেন এবং প্রকৃতির সঙ্গে স্থানীয়দের মনোভব, আচরণ দেখতে পারেন। এই পারিবারিক হোটেল একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৪জনকে সেবা দিতে পারে এবং প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৫০০ জনকে সেবা প্রদান করতে পারে। এ পর্যন্ত পাহাড়ী এ গ্রামের মানুষ এ ব্যবসার মধ্যে ২০ লাখ ইউয়ান উপার্জন করেছে।

অভিন্ন হোম, অভিন্ন স্বপ্ন

জলবায়ু পরিবর্তন বয়ে আনা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা মানবজাতির অভিন্ন কাজ। অন্য জাতীয় পার্কের তুলনায় চীনের জাতীয় পার্কের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। সেটা হলো সংরক্ষণকে প্রথম স্থানে রাখা। বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ জাতীয় পার্ক সংরক্ষণ ও উপভোগকে প্রথম স্থানে রাখে। জাতীয় পার্ক শহরের পার্কের চেয়ে ভিন্ন। শহরের পার্ক শুরুতে স্থানীয় বাসিন্দারকে সেবা প্রদান করে তবে জাতীয় পার্কের প্রধান কর্তব্য হলো প্রকৃতি সংরক্ষণ।

চীনা জাতীয় পার্ক চীনা প্রাকৃতিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ একটি জায়গা। সেখানে সব প্রাণী সহাবস্থান করে। পাশাপাশি জাতীয় পার্কও চীনে সবচেয়ে কঠোরভাবে সংরক্ষণের একটি প্রাকৃতিক এলাকা, যেখানে কোন শিল্প গড়া নিষিদ্ধ। বলা যায়, জাতীয় পার্কে প্রকৃতি হলো মালিক এবং মানুষকে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে হয়।

জাতীয় পার্ক সাধারণ মানুষের জীবনের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে মহান কবি, শিল্পী ও দার্শনিকরা প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েঠে। আর আধুনিক সমাজে জাতীয় পার্ক আরও বেশি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। (শিশির/রহমান/রুবি)