বিজ্ঞানবিশ্ব পর্ব ৫২
2024-01-08 15:28:50

 

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব পর্ব ৫২

৫২তম পর্বে যা থাকছে:

 

* অঙ্গ হারানো মানুষদের জীবন বদলে দেবে বায়োনিক হাত

* চীনে শুরু হলো সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম কম্পিউটার কার্যক্রম

* ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার

 

অঙ্গ হারানো মানুষদের জীবন বদলে দেবে বায়োনিক হাত

বিভিন্ন দুর্ঘটনায় হাত-পা হারানো মানুদের জন্য সুখবর দিয়েছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি তারা একটি বায়োনিক হাত তৈরি করেছেন। এই হাতের মাধ্যমে অঙ্গহীন মানুষদের জীবনযাপন আরও সহজ ও গতিময় হবে। বিশেষ করে এই হাত দিয়ে তারা কোনও বস্তু ছুঁয়ে দেখা কিংবা কোনও বস্তু আঁকড়ে ধরতে পারবেন।

 

ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) প্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞ একটি চীনা স্টার্ট-আপ স্মার্ট বায়োনিক হাত তৈরি করেছে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চেচিংয়া ব্রেইনকো প্রযুক্তির সহযোগিতায় চীনের টেক হাব হিসেবে পরিচিত হাংচৌ ও শেনচেন এবং বোস্টন গবেষণাগারে সাশ্রয়ী মূল্যে বায়োনিক ডিভাইসগুলো তৈরি করা হয়।

২০১৮ সালে কারখানায় কাজ করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন কু ইউ নামের এক তরুণ। পরে চিকিৎসকরা তার বাম হাত কেটে ফেলেন। স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করার দুই মাস পর এ ঘটনা ঘটে।

দুঃসহ সেই দিনগুলোর কথা মনে করে কু ইউ জানান, দুর্ঘটনার পর এক বছর বাড়িতে ছিলেন। তিনি শঙ্কায় ছিলেন কেউ তাকে চাকরি দেবেন কি-না বা কেউ তাকে বিয়ে করবে কি-না।

গবেষকরা অসংখ্য অঙ্গ হারানো মানুষের ‘ফ্যান্টম লিম্বস’ ঘটনার ওপর ভিত্তি করেই মূলত সেন্সরসহ বায়োনিক হাতটি তৈরি করেছেন, যাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্পর্শের অনুভূতি পেতে সহায়তা করে। ফ্যান্টম লিম্বস হলো অঙ্গহীন ব্যক্তিদের অনুপস্থিত আঙ্গুল, হাত বা অঙ্গগুলোর উপস্থিতি অনুধাবন করার একটি ঘটনা।

তিনি বলেন, “আমার চাচাতো ভাই একটি প্রদর্শনীতে বায়োনিক হাতটি দেখে আমাকে এটি সম্পর্কে বলেন। আমি প্রথমে এই ডিভাইসটির বিরোধিতা করেছিলাম। পরে আমি কোম্পানির একজনের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকের বায়োনিক হাত সম্পর্কে বুঝিয়ে বলেন। এটি কীভাবে কাজ করে তা বোঝা অনেকের পক্ষে কঠিন হতে পারে। আমরা এখনও অনুপস্থিত হাতের উপস্থিতি টের পাই এবং এই পণ্যটি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে বা চলাফেরা করতে সক্ষম করবে।”

মস্তিষ্ক ও মস্তিষ্কের বাইরের পরিবেশের একটি ডিভাইসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করার যে প্রযুক্তি, তার নামই ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস বা বিসিআই। এটি ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস (বিএমআই) বা নিউরাল ইন্টারফেস নামেও পরিচিত। মানুষের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্ভব। ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তির সাহায্যে পৃথিবীকে পরিবর্তনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

চৌদ্দতম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২১-২০২৫) অন্তর্ভুক্ত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে চীন মস্তিষ্কবিজ্ঞানে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। দেশটি প্রথমবারের মতো মস্তিষ্ক-মেশিন ইন্টারফেসসহ সাতটি প্রযুক্তির বিকাশে অগ্রাধিকার দিয়েছে। মস্তিষ্কবিজ্ঞান এবং মস্তিষ্কের মতো বুদ্ধিমত্তার গবেষণাকে এগিয়ে নিতে চীন ৩০০ কোটি ইউয়ান ব্যয় করেছে।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

চীনে শুরু হলো সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম কম্পিউটার কার্যক্রম

বর্তমানে আমরা যে ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করি তার ভবিষ্যৎ বা ‘নেক্সট বিগ থিং’ হতে যাচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। কোয়ান্টাম কম্পিউটার খুবই শক্তিশালী, যা আজকের দিনের কম্পিউটারের তুলনায় কয়েক হাজার গুণ দ্রুত গতিতে কাজ করতে পারবে। অর্থাৎ এটি অনেক দ্রুত অনেক বেশি তথ্য প্রসেস করতে পারবে। এর এলগরিদম, কাঠামো সবকিছুই সাধারণ কম্পিউটার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিজ্ঞানীরা এখন এই নতুন প্রজন্মের কম্পিউটার উদ্ভাবনের জন্য পাল্লা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। চীন এ ধরনের সুপার-ফাস্ট কম্পিউটার তৈরির পেছনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে। দেশটির বিজ্ঞানীরা সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছেন, যা ইতোমধ্যেই কার্যক্রম শুরু করেছে।

সম্প্রতি পূর্ব চীনের আনহুই প্রদেশের অরিজিন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং টেকনোলজি কোম্পানিতে চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি তৃতীয় প্রজন্মের সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম কম্পিউটার কার্যক্রম শুরু করেছে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারে নির্দিষ্ট কিছু কাজ গতানুগতিক কম্পিউটারে করা সম্ভব নয়। এসব জটিল গাণিতিক কাজ করার জন্য দরকার অবিশ্বাস্য গতি। গতানুগতিক সুপার কম্পিউটারে এই গতি অর্জন সম্ভব নয়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাহায্যে এসব জটিল কাজ সহজেই করে ফেলা সম্ভব।

সাধারণ কম্পিউটার চলে বাইনারি বিট পদ্ধতিতে, শুধু ০ আর ১ ব্যবহার করে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারও বিশেষ ধরনের বিট ব্যবহার করে ক্যালকুলেশন করা হয়। এই বিশেষ ধরনের বিটকে বলা হয় কিউবিট। কিউবিট তৈরি করার একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। কিছু পরিচিত পদ্ধতি হলো সুপারকন্ডাক্টিং সার্কিট ব্যবহার করা অথবা বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের মাধ্যমে শূন্যে ভেসে থাকা ক্ষুদ্র কণা বা অ্যাটম ব্যবহার করা।

এ পদ্ধতিতে কম্পিউটার একটি সমস্যার একই সঙ্গে বহু সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করতে সক্ষম। সেখান থেকে সঠিক হিসাবটা দিতে তাই দেরি হয় না।

আনহুই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টারের উপপরিচালক খং ওয়েইছেং জানান, তৃতীয় প্রজন্মের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালুর পর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সামগ্রিক অপারেটিং দক্ষতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কোম্পানিটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বর্তমানে চীনের সবচেয়ে উন্নত কোয়ান্টাম কম্পিউটার এটি। এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারটি ৭২টি কিউবিট সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম চিপ দিয়ে সজ্জিত, যাকে ‘উখং চিপ’ বলা হয়। চিপটিতে মোট ১৯৮টি কিউবিট রয়েছে, যার মধ্যে ৭২টি কিউবিট এবং ১২৬টি কাপলার রয়েছে।

তৃতীয় প্রজন্মের সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম কম্পিউটারের গবেষণা দলের প্রধান কুও কুওপিং জানান, যদিও চীন এই ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে এটি স্পষ্ট যে বিশ্বের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রস্তুতকারকদের তুলনায় এখনও যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে।

সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্ম ইতোমধ্যেই চীনের ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ গ্লোবাল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং টেকনোলজি পেটেন্ট র‍্যাঙ্কিং তালিকা অনুসারে, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে যেসব উদ্ভাবন পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছে তার সংখ্যা অনুসারে ‘অরিজিন কোয়ান্টাম’ চীনে প্রথম ও বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে কম্পিউটিংয়ের নতুন এক যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। এটি উন্নত মহাকাশযান গবেষণা ও মিশন পরিচালনা থেকে শুরু করে খাদ্য ও পণ্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

 

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

 

ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার

বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ক্যান্সার। ক্যান্সারের অনেকগুলো ধরন আছে। প্রত্যেকটি ধরনই মারাত্মক। তবে এর চিকিৎসাও আছে। এসব ধরনের মধ্যে অন্যতম ব্রেস্ট ক্যান্সার।

ক্যান্সারজনিত কারণে সারাবিশ্বে যত নারীর মৃত্যু হয়, তার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মারা যায় ব্রেস্ট ক্যান্সারে। মারাত্মক এ রোগের চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন চীনের গবেষকরা।

ব্রেস্টের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়। সেটি রক্তনালীর লসিকা (কোষ-রস) ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যান্সার। স্তন ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। তবে এর জন্য প্রয়োজন সময়মত ও যথাযথ চিকিৎসা। 

পরিসংখ্যান দেখা যায়, বছরে বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় আর প্রায় ছয় লাখের অধিক নারী এ কারণে মৃত্যুবরণ করে।

চিকিৎসা-প্রতিরোধী টিউমারগুলোকে আরও চিকিৎসাযোগ্য করে মরণঘাতী ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায় একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন চীনা গবেষকরা। সম্প্রতি সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, মারাত্মক ট্রিপল-নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা আরও ফলপ্রসূ করতে নতুন এ পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিদ্যমান চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে মিলিয়ে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হবে।

ফুতান ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ৪০১ জন রোগীর হোমোলোগাস রিকম্বিনেশন ডেফিসিয়েন্সি স্কোরসহ (এইচআরডি) টিউমার নমুনার মেটাবোলিজম বিশ্লেষণ করেন। এই স্কোরগুলোর মাধ্যমে গবেষকরা দেখতে পান, রোগীদের শরীরে ডিএনএ’র জন্য ক্ষতিকারক ওষুধে টিউমার প্রতিক্রিয়া দেখায় তবে কম স্কোরধারী রোগীদের শরীরের প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

গবেষকরা ‘জিডিপি-এম’ নামক একটি অণু চিহ্নিত করেছেন, যা টিউমার কোষের ডিএনএর সুস্থ হওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এবং প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার-যুক্ত প্রোটিনের ক্ষয়কে আরও বাড়িয়ে দেয়।

গবেষকরা বলছেন, নতুন এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডিএনএ রিপেয়ার-টার্গেটেড থেরাপির সঙ্গে জিডিপি-এমকে একত্রিত করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। দুই পদ্ধতির এ মিশ্রণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে।

ক্যান্সার ধনী- দরিদ্র, নারী-পুরুষ ও শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কাউকে আক্রান্ত করতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে অধিকাংশ ক্যান্সার রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

আমাদের দেশে ক্যান্সারের প্রতিরোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি, যদিও বিগত কয়েক দশকে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় না হওয়ায় চিকিৎসা বিলম্বিত হয়। কিন্তু রোগী যখন বিশেষজ্ঞদের কাছে যান, তখন সুচিকিৎসার জন্য আর তাদের পর্যাপ্ত সময় থাকে না।

|| প্রতিবেদন: শুভ আনোয়ার

|| সম্পাদনা: শিয়াবুর রহমান

 

নতুন আরও তথ্যবহুল ও অজানা বিষয় নিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোমবার হাজির হবো আপনাদের সামনে। আগামী সপ্তাহে আবারো কথা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- রফিক বিপুল

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী