দেহঘড়ি পর্ব-০৫২
2024-01-07 18:15:37

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

ঘাড় ব্যথার টিসিএম চিকিৎসা

ঘাড় ব্যথা একটি খুব সাধারণ সমস্যা। পৃথিবীজুড়ে এ সমস্যা বিরাজমান। এক জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ১৪ শতাংশ মানুষ এ সমস্যায় ভোগে। ঘাড় ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা হলে চিকিৎসকদের জন্য এর নির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা প্রায়ই বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। এমনকি অত্যাধুনিক ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাও সব সময় এর সঠিক কারণ বের করতে পারে না। তবে ঘাড় ব্যথার সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অনুপযুক্ত শারীরিক ভঙ্গি, ঘুমানোর অবস্থান, ঘাড়ের অতিরিক্ত ব্যবহার, ইনজুরি থেকে ট্রমা, সার্ভিকাল ডিজেনারেটিভ ডিস্ক রোগ, সার্ভিকাল হার্নিয়েটেড ডিস্কে সমস্যা, স্পন্ডাইলোলিস্থেসিস, সার্ভিকাল অস্টিওআর্থারাইটিস, সার্ভিকাল রেডিকুলোপ্যাথি, মানসিক চাপ, মায়োফেসিয়াল ব্যথা বা ফাইব্রোমায়ালজিয়া।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ঘাড় বা ঘাড়ের আশেপাশের নরম টিস্যু ও লিগামেন্টে টান বা ঘাড়ের ওপর চাপের কারণে ঘাড়ে ব্যথা হয়। এই ধরনের পেশীর ব্যথা কাজ করার সময় বা ঘুমানোর সময় ঘাড়ের অবস্থান থেকে বা টিস্যুতে হঠাৎ আঘাতের কারণে হতে পারে। টিস্যুতে উত্তেজনা তৈরি করে এমন দীর্ঘস্থায়ী চাপও ঘাড়ের ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।

ঘাড় ব্যথার জন্য টিসিএম ও আকুপাংচার

ঘাড়ের ব্যথা নিয়ে কোনও রোগী একজন আকুপাংচার চিকিৎসকের কাছে গেলে, তিনি সমস্যার বিশদ ইতিহাস জানবেন এবং উপসর্গ ও অন্তর্নিহিত কারণগুলো বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয় করবেন। ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা বা টিসিএমের মূল বিশ্বাস হলো শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন দেহের মূল জীবনীশক্তি বা ‘ছি’র ভারসাম্য। টিসিএমে মনে করা হয়, ‘বাই সিন্ড্রোম’ বা ‘দ্বি-লক্ষণ’ সারা শরীরে ‘ছি’ ও রক্তের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় ‘বাই সিন্ড্রোম’ হলো  রিউমাটোলজিকাল ডিসঅর্ডার। রিউম্যাটিজম, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিওআর্থারাইটিস এবং ফাইব্রোসাইটিস এই ক্যাটাগরির আওতায় পড়ে এবং এর সবগুলোই ঘাড়ে ব্যথা বা ঘাড় শক্ত হওয়া এবং সার্ভিকাল জয়েন্ট ফোলার মূল কারণ হতে পারে। ধারণা করা হয়, তাপ, বায়ু, ক্লেদ ও তাপজনিত রোগজীবাণু থেকে ‘বাই সিনড্রোম’ হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্যাথোজেনিক ফ্যাক্টর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসে আবার কখনও কখনও বহিরাগত উত্স থেকে আসে। বাই সিনড্রোম দেহের মধ্যকার পথে বাধা তৈরি করে, যার ফলে শক্তিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয় এবং ব্যথা হয়। বাই সিনড্রোমের প্রকাশ ঘটে ব্যথা, ফোলা, অসাড়তা বা জ্বালা-পোড়ার মাধ্যমে। কখনও কখনও এই লক্ষণগুলো বিশেষ করে ঘাড় এলাকায় দেখা দেয়। টিসিএম রক্ত সঞ্চালন ও ‘ছি’র মধ্যে ভারসাম্য আনা এবং বায়ু ও ক্লেদ দূর করার মধ্য দিয়ে বি সিন্ড্রোমের চিকিত্সা করে।

উইপল্যাশ নেক ইনজুরির জন্য আকুপাংচার

কোনও ব্যক্তি যখন গাড়ি দুর্ঘটনার মতো কোনও দুর্ঘটনায় পড়ে, তখন প্রচণ্ড শক্তি ও গতির সঙ্গে তার দেহের সংঘর্ষ হয়। তেমন ক্ষেত্রে মাথা ও ঘাড় দ্রুত গতিতে প্রথমে সামনের দিকে তারপর পিছনের দিকে যায়। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে যেটাকে সামান্য পড়ে যাওয়া বলে মনে হয়, সেটাও দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি ডেকে আনতে পারে। নরম টিস্যুতে আঘাত, যাকে ‘উইপল্যাশ’ বলা হয়, সেটি আসলে অনেকগুলো সমস্যা যেমন কশেরুকা বা মেরুদণ্ডের ডিস্কের ক্ষতি, লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া, রগ ও পেশীতে টান ইত্যাদির একটি বেদনার মিশ্রণ। স্নায়ুতে ক্ষতির অন্য উপসর্গগুলো প্রকাশিত হয় শারীরিক অসাড়তা, মাথাব্যথা, কানে ঝনঝন আওয়াজ হওয়া এবং মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে।

একটি ‘ছোট’ আকস্মিক আঘাতের ট্রমা থেকেও রক্ত ও ‘ছি’ চলাচলে স্থবিরতা তৈরি হতে পারে। এক্স-রে বা এমআরআইয়ে এটি দেখা নাও যেতে পারে, তবে একজন রোগী এর প্রভাব ঠিকই অনুভব করতে পারেন। এর প্রভাবগুলোর মধ্যে থাকে ক্লান্তি, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্নতা ইত্যাদি।

আকুপাংচার হলো সব ধরনের আঘাতের চিকিৎসার একটি প্রাকৃতিক ও অত্যন্ত কার্যকর উপায়। আকুপাংচার টিস্যুর ফোলাভাব ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, ‘ছি’ ও রক্তের স্থবিরতা দূর করে এবং শক্তি পুনরুত্পাদন করে, যার কারণে শরীর সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।

আকুপাংচার তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী উভয় আঘাত উপশমে সাহায্য করে। দুর্ঘটনার পর যত তাড়াতাড়ি আকুপাংচার চিকিৎসা শুরু করা যায়, সুস্থতাও তত তাড়াতাড়ি আসে। যারা পুরানো আঘাতের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব মোকাবিলা করছেন তারাও এ চিকিৎসা থেকে উপকৃত হতে পারেন। আকুপাংচার কেবল ব্যথা কমায় না, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং নিরাময়ের ক্ষমতা বাড়ায়।

আকুপাংচার চিকিৎসকরা আকুপাংচারের পাশাপাশি নির্দিষ্ট ভেষজ গ্রহণ, খাবার পরিবর্তন এবং ব্যায়ামের পরামর্শও দেন। এগুলো একজন রোগীকে সুস্থ হতে এবং ভবিষ্যত সমস্যাগুলো প্রতিরোধে সহায়তা করে।

 

#ভেষজের গুণ

নানা রোগের যম রসুন

বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে রসুনের ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রায় সব প্রাচীন সভ্যতায় ওষুধ হিসেবে রসুনের ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও এটা প্রমাণ করেছে যে, রসুনের রয়েছে নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা বা ঔষধি গুণ। রসুনে পাওয়া যায় ক্যালসিয়াম‚ কপার, পটাশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ভিটামিন বি১, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি৬ ও ম্যাঙ্গানিজ। এছাড়া এতে থাকে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান, যা আমাদের শরীরের জন্য খুব দরকারী। চলুন জেনে নেই ওষুধের গুণাগুণ সম্পর্কে:

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: রসুন খেলে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। এর ফলে রসুনের সাপ্লিমেন্ট বা কাঁচা রসুন খেলে ফ্লু ও কমন কোল্ড বা সর্দি তাড়াতাড়ি সেরে যায়। বারো সপ্তাহ ধরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন রসুনের সাপ্লিমেন্ট খেলে প্লাসিবো সাপ্লিমেন্টের তুলনায় সর্দিতে আক্রান্ত হওয়ার হার কমে ৬৩ শতাংশ। আর সর্দিতে আক্রান্ত হলেও এর লক্ষণ ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৫ দিন থেকে মাত্র দেড় দিনে কমে আসে।

শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে: উচ্চমাত্রায় রসুন গ্রহণ করলে এতে থাকা সালফার যৌগ সীসা ও অন্যান্য ভারী ধাতুর বিষক্রিয়া থেকে শরীরকে রক্ষা করে। গাড়ির ব্যাটারি তৈরির কারখানায় কাজ করে এমন একদল কর্মীর ওপর ৪ সপ্তাহ ধরে চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, রসুন শরীরের সীসার উপস্থিতি কমায় ১৯ শতাংশ পর্যন্ত। মাথাব্যাথা ও উচ্চ রক্তচাপের মতো বিষক্রিয়ার লক্ষণও কমতে দেখা যায় ওই কর্মীদের মধ্যে।

কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখে: নিয়মিত রসুন খেলে শরীরে এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরোল হ্রাস পায় আবার অন্যদিকে এইচডিএল বা ভালো কোলেস্টেরোল বৃদ্ধি পায়। এবং এর মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, নিয়মিত রসুন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে খারাপ কোলেস্টেরোল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হ্রাস পায়।

রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে: হৃদরোগ যেমন হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের কারণে সারা পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হৃদরোগের প্রধান কারণ। কিন্তু দেখা গেছে, রোজ চার কোয়া করে রসুন খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

বয়সের প্রভাব রোধ করে: রসুনে এমন কতগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যেগুলো মানবদেহের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায় এবং বয়সের প্রভাব রোধ করে। এর ফলে অ্যালঝাইমার ও ডিমেনশিয়ার মতো রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

দীর্ঘজীবী হতে সাহায্য করে: রসুন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং অনেক সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। তাই নিয়মিত রসুন খেলে দীর্ঘজীবী হওয়ার সম্ভবনা অনেকেটা বেড়ে যায়।

হাড়ের শক্ত করে: ইঁদুরের ওপর পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে, নারীদেহে ইস্ট্রোজেন বাড়ানোর মাধ্যমে হাড়ের ক্ষয় রোধ করে রসুন। মাসিক ঋতুচক্ত বন্ধ হয়ে গেছে এমন নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ২ গ্রাম কাঁচা রসুনের সমপরিমাণ রসুনের নির্যাস গ্রহণ করলে শরীরে ইস্ট্রোজেন-স্বল্পতা কমে।

ত্বকের সংক্রমণ সারিয়ে তোলে: রসুনে থাকা অ্যান্টি ভাইরাল ও অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল প্রপার্টি ত্বকের সংক্রমণের চিকিৎসায় ভালো কাজে লাগে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।