চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘চলতি বাণিজ্য’
2024-01-05 20:46:45



চলতি বাণিজ্যের ৫১তম পর্বে থাকছে:

১. অসীম আকাশে উড়ছে চীনের ঘুড়িশিল্প

২. বিশ্বব্যাপী কৃষি ফলন বৃদ্ধি ও ব্যয় খরচ কমাতে কাজ করছে চীনের বিজিআই

৩. উজবেকদের পছন্দের শীর্ষে চীনা পণ্য

 

অসীম আকাশে উড়ছে চীনের ঘুড়িশিল্প

শুভ আনোয়ার, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: ‘ঘুড়ির রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত পূর্ব চীনের শানতোং প্রদেশ। এই প্রদেশের ওয়েইফাং শহরের ঘুড়ি চমৎকার কারুকাজের জন্য বিখ্যাত। বিশ্বের ৭০ শতাংশের বেশি ঘুড়ি এই শহরেই তৈরি হয়। এ শহরকে কেন্দ্র করে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে দেশটির ঘুড়িশিল্প। ২০২৩ সালে ২ বিলিয়ন ইউয়ানের ঘুড়ি বিক্রি হয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল রাজস্ব আসছে এ খাত থেকে।

২০২৩ সালটি ছিল চীনের ঘুড়িশিল্পের জন্য দুর্দান্ত একটি বছর। সদ্য শেষ হওয়া বছরটিতে ৬০০টিরও বেশি ঘুড়ির কারখানা ২০০ কোটি ইউয়ানের ঘুড়ি বিক্রি করেছে। একই সময়ে এসব ঘুড়ি তৈরির জন্য কাজ করেছেন ৮০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক।

এর মধ্যে ওয়েইফাং শহরের শুধুমাত্র সানলি ঘুড়ি কারখানা গত বছর দেশটির ১০টি প্রদেশে প্রায় ৬০ লাখ ইউয়ান বা ৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪৮৭ মার্কিন ডলার মূল্যের ঘুড়ি বিক্রি করেছে।

কারখানাটির ব্যবস্থাপক ওয়াং লিছাই জানান, ২০২৩ সালে চীনের বাজারে তাদের ঘুড়ি বিক্রির পরিমাণ ছিল ২০২২ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। বর্তমানে এ কারখানাটিতে ৩০ জনেরও বেশি শ্রমিক রঙিন ঘুড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে প্রজাপতি, সেন্টিপিডসহ বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন রয়েছে।

রং-বেরঙের ঘুড়ির জন্য বিখ্যাত ওয়াংচিয়াচুয়াংচি গ্রাম। এই গ্রামটিতে সানলি কোম্পানি অবস্থিত। চমৎকার কারুকাজ এবং বৈচিত্র্যময় নকশার কারণে ওয়েইফাং শহরের ঘুড়ি শিল্পে প্রথমেই আসে এই গ্রামের নাম।

ওয়াংচিয়াচুয়াংচি গ্রামে ২০০টিরও বেশি ঘুড়ির কারখানা রয়েছে। গ্রামটির প্রায় ২ হাজার ৩০০ মানুষ সরাসরি এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ ঘুড়ির কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ঘুড়িশিল্পের কারণে গ্রামটি হয়ে উঠেছে উন্নত। বর্তমানে এ গ্রামে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ২০২৩ সালে গ্রামবাসীদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল ৩৫ হাজার ইউয়ান।

পূর্বপুরুষদের এ পেশায় নিজ দক্ষতা আর ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছরে এসব কারখানায় বংশ পরম্পরায় কাজ করে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। ক্রমবর্ধমান এ ঘুড়িশিল্পের কারণে স্থানীয় তরুণরাও তাদের নিজ গ্রামে ফিরে আসছেন। ফলে গ্রামীণ পুর্ণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় গ্রামবাসী ওয়াং ফেংলিং বলেন, “ঘুড়ি তৈরি করা আমাদের বিশেষত্ব। আমি ২০ বছর ধরে কারখানায় কাজ করছি। আমি গড়ে প্রতিদিন ৩০০টি ঘুড়ি তৈরি করতে পারি। সে হিসেবে মাসিক বেতন ৪ হাজার ইউয়ান পাই।”

সাম্প্রতিক বছরগুলো চীনে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে ঘুড়ি তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়ার কারণে দেশটির ঘুড়ির কারখানাগুলো ই-কমার্স ব্যবসার দিকে মনোযোগী হয়ে উঠছে। ওয়াংচিয়াচুয়াংচি গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ ঘুড়ি কারখানা অনলাইন শপ স্থাপন করেছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ২০২৩ সালে ই-কমার্স লাইভস্ট্রিমিং থেকে বিক্রির পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ইউয়ানে দাঁড়ায়।

শানতোং প্রদেশের এসব ঘুড়ি চীনের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে, বিশেষ করে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে।

 

 

কোম্পানি প্রোফাইল:

বিশ্বব্যাপী কৃষি ফলন বৃদ্ধি ও ব্যয় খরচ কমাতে কাজ করছে চীনের বিজিআই

শুভ আনোয়ার, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৮শ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর আহারের জন্য ফসল উৎপাদনের পর্যাপ্ত কৃষিজমি কমে আসছে প্রতিনিয়ত। আর এ সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তির সাহায্যে বিশ্বব্যাপী কৃষিফলন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় কমাতে সাহায্য করছে চীনা জিনোমিক্স ফার্ম বিজিআই গ্রুপ।

চীনের কুয়াংতোং প্রদেশভিত্তিক জীব বিজ্ঞান ও জিনোমিক্স কোম্পানি বিজিআই গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিজিআই বায়োভার্স। এ প্রতিষ্ঠানটি চীনের ইয়ুন নান ইউনিভার্সিটির সঙ্গে জিনোমিক্স প্রযুক্তি উদ্ভাবিত ১২ মাসী ধান চাষের প্রসারে কাজ করছে। এই জাতের ধান কৃষকদের উৎপাদন খরচ এবং গতানুগতিক শ্রম-নিবিড় কাজগুলো কমিয়ে দেবে।

২০২২ সালে এ কোম্পানি-উদ্ভাবিত ১২ মাসী ধান উগান্ডার ভিক্টোরিয়া হ্রদের নিকটবর্তী মাসাকা সিটিতে চাষ করা হয়। চাষের প্রথম বছর প্রতি শূন্য দশমিক ০৬ হেক্টর জমিতে ৫০০ কেজি ধান উৎপাদিত হয়েছে।

দেশটির জলবায়ু ও তাপমাত্রায় এটি একটি আদর্শ ফসলে পরিণত হয়েছে। এর ফলে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে দেশটি।

নর্থইষ্ট এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ওয়াং গাঙ্গি জানান, ১২ মাসী এ ধানের অর্থনৈতিক সুবিধা বেশ সুস্পষ্ট। ঐতিহ্যবাহী ধানের বিপরীতে এটি ভালো বিকল্প।

নেতৃস্থানীয় জিনোমিক্স প্রযুক্তি রপ্তানিকারণ কোম্পানি হিসেবে বিজিআই গ্রুপ মানবকল্যাণে প্রযুক্তির এ অগ্রগতি সকল দেশে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনীয় তুলে ধরেছে।

বিজিআই গ্রুপের প্রধান নির্বাহী এবং চেয়ারম্যান ইয়িন ইয়ে বলেন, “আমাদের অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তিগুলোকে সাশ্রয়ী ও সহজগম্য করতে হবে এবং সাধ্যের মধ্যে রাখতে হবে। প্রযুক্তি কেবল কিছু বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত লোকের জন্য নয়। এটি পৃথিবীর প্রত্যেকেরই উপভোগ করা উচিত।”

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির কৃষি উদ্ভাবনের অধ্যাপক রবার্ট হেনরি এবং তার দল বিজিআই গ্রুপের জিন সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ম্যাকাডামিয়া বাদাম বা ‘অস্ট্রেলিয়ান বাদামের’ ফলন বৃদ্ধি এবং ফসলের বেড়ে ওঠার সময় কমাতে নতুন প্রজাতির উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করছে।

বর্তমানে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে মারাত্মক ভারসাম্যহীনতার কারণে বিশ্ব বাজারে ম্যাকাডামিয়া বাদামের দাম চড়া। এ বাদাম গাছ লাগানো থেকে ফল ধরা পর্যন্ত ৭ থেকে ১০ বছর সময় লাগে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুসারে, বিশ্ববাজারে ম্যাকাডামিয়া বাদামের চাহিদা বছরে ৪ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। কিন্তু বর্তমান সরবরাহ হয় ৫০ হাজার মেট্রিক টনেরও কম।

বিপুল এ চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই চীনা প্রতিষ্ঠান বিজিআই গ্রুপের সঙ্গে কাজ করছে অস্ট্রেলিয়ার এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।

চীনা কোম্পানি জিনোমিক্সের সম্ভাবনাকে আরও সমৃদ্ধ করছে। এর মাধ্যমে চীনা বিজ্ঞানীরা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছেন।

অধ্যাপক রবার্ট হেনরির গবেষণা দলটি বিজিআই গ্রুপের জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিরল জাতগুলো সংরক্ষণেও কাজ করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্ভিদকে আরও টেকসই ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করতেও কাজ করছেন তারা।

বিজিআই গ্রুপ এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আধুনিক কৃষি, মানব স্বাস্থ্য ও জীব বৈচিত্র্যের বিষয়ে সহযোগিতা করেছে। পাশাপাশি বিশ্বের আরও বেশি মানুষকে সেবা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

 

ভিনদেশে চীন:

উজবেকদের পছন্দের শীর্ষে চীনা পণ্য

শুভ আনোয়ার, চীন আন্তর্জাতিক বেতার:

চীন ও উজবেকিস্তান বন্ধুপ্রতিম ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে উজবেকিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চীনা পণ্য। বিশেষ করে নববর্ষের উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে উজবেকিস্তানের নাগরিকদের পছন্দের শীর্ষে ছিল চীনে তৈরি হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ইলেকট্রনিক্স, চা পাতা ও অন্যান্য পণ্য।

 

উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দের বাসিন্দা কামিলা আবদুল্লায়েভা। সদ্যসমাপ্ত বছরে তার দুই সন্তান স্কুলে অসাধারণ পারফরম্যান্স করায় তাদের বিশেষ উপহার দিয়েছেন। যার সবগুলোই ছিল চীনা পণ্য।

শুধু কামিলা আবদুল্লায়েভাই নয় সাম্প্রতিক সময়ে উজবেকিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে চীনের তৈরি হোম অ্যাপ্লায়েন্স থেকে শুরু করে নানা পণ্য।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উজবেকিস্তানে চীনের তৈরি খেলনা, শখের জিনিসপত্র, গৃহস্থালির যন্ত্রপাতি, ঘড়ি ও গহনার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ক্রেতারা বিগত বছরগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হারে এসব পণ্য কিনছেন।

কামিলা আবদুল্লায়েভা জানান, ছেলেরা পড়াশোনায় ভালো ফলাফল অর্জন করায় তিনি সন্তানদেরকে একটি চীনা ফোন ও একটি শিক্ষামূলক খেলনা উপহার দিয়েছেন।

তাসখন্দের বাসিন্দা কামিলা আবদুল্লায়েভা বলেন, “কোনও উপহার দেওয়া বা পারিবারিক প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটার প্রয়োজন পড়লে প্রথম পছন্দ হিসেবে থাকে চীনা পণ্য। আমাদের বাড়িতে প্রচুর চাইনিজ ব্র্যান্ডের অ্যাপ্লায়েন্স রয়েছে। চীনা পণ্যগুলোর দাম ও গুণগত মান নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।”

দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ২০২৩ সালে চীন ও উজবেকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৯৫০ কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করে।

একটি হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস স্টোরের ব্যবস্থাপক তৈমুর মুহাম্মেদভ জানান, ২০২৩ সালে চীনা হোম অ্যাপ্লায়েন্সের ক্রেতা বেড়েছে অন্তত ৫০ শতাংশ। তবে চাহিদার শীর্ষে ছিল চাইনিজ ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন। মানুষ চীনা পণ্যগুলোর দাম ও গুণমানের অনুপাত নিয়ে খুবই খুশি।

মধ্য এশিয়ার এ দেশটিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিভিন্ন ধরনের চীনা চা পাতাও।

চীনা চা ক্রেতা মাখমুদ জুফারভ বলেন, “আমি এখানে আমার মা-বাবার জন্য চীনা চা কিনতে এসেছি। তারা এটি খুব পছন্দ করেন, বিশেষ করে গ্রিন টি।”

উজবেকিস্তানের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিচালক সের্গেই ইভাশচেঙ্কো জানান, উজবেকরা চীন থেকে আমদানি করা সুগন্ধি পণ্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

উজবেকিস্তানে সামনের দিনগুলোতে চীন থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবাগুলো আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সহযোগিতা কীভাবে আরও বৃদ্ধি করা যায় সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছেন।

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা- শুভ আনোয়ার

 

অডিও সম্পাদনা- নাজমুল হক রাইয়ান

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা- শিয়াবুর রহমান

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী