প্রিয় বন্ধুরা, আজকের অনুষ্ঠানে একসঙ্গে ‘বেল্ড অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের আওতায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতার ওপর দৃষ্টি দেবো।
২০১৩ সালের শরত্কালে কাজাখস্তান ও ইন্দোনেশিয়া সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যথাক্রমে যৌথভাবে ‘সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বেল্ট’ এবং ‘একবিংশ শতকের সামুদ্রিক সিল্ক রোড’ নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের প্রস্তাব করেছিলেন। গত ১০ বছরে এ উদ্যোগে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো একসাথে এই মহাকর্মপরিকল্পনা থেকে দুর্দান্ত, রঙিন ও জমকালো ‘সিল্ক রোড পিকচার স্ক্রলে’ এঁকেছে; আন্তঃসংযোগ ও সবার জন্য লাভজনক সহযোগিতার মহান পরিকল্পনা বিশ্বজুড়ে এক বাস্তবতা হয়ে উঠছে।
চলতি বছর ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ’ উত্থাপনের ১০তম বার্ষিকী,‘বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে’ বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সপ্তম বছর এবং চীন ও বাংলাদেশের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ’ নির্মাণের একটি ফলপ্রসু বছর।
সাত বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা থেকে চীন ও বাংলাদেশ উভয়ে সুবিধা ও সুফল অর্জন করেছে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশ সফর করেন এবং দুই সরকারের প্রতিনিধিরা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে’র অধীনে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে সই করেন। তারপর থেকে ‘চীনা স্বপ্ন’ এবং ‘সোনার বাংলার স্বপ্ন’ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত ও একীভূত হয়েছে এবং দুদেশের সহযোগিতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর পূর্ব বঙ্গোপসাগরে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় একটি ১ লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন তেল ট্যাঙ্কার থেকে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরো-নির্মিত একটি সিঙ্গল-পয়েন্ট মুরিংয়ের মাধ্যমে তেল খালাস করা হয়। এর অর্থ হলো বাংলাদেশের প্রথম সমুদ্র ও ভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী অতি-বৃহৎ তেল সংরক্ষণ ও পরিবহন প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পটি ২০৪১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন রূপকল্প বাস্তবায়নের একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প। এটি একটি এনার্জি চ্যানেল, যা ‘সোনার বাংলা’কে আলোকিত করতে সাহায্য করছে। বাংলাদেশ সবসময়ই প্রায় সম্পূর্ণভাবে আমদানিকৃত তেল ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমদানিকৃত পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য ট্যাংকারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে আনা হয়। তবে বন্দরের গভীরতা কম হওয়ার কারণে এক লাখ টন ধারণক্ষমাসম্পন্ন তেলের ট্যাঙ্কারগুলো বন্দরের বাইরে রাখতে এবং ছোট ট্যাঙ্কার দিয়ে বন্দরে আনতে হতো। জাহাজ থেকে তেল খালাস করার এই পদ্ধতিটি কম কার্যকর, ব্যয়বহুল ও পরিবেশগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য জ্বালানি পরিবহনের একটি ‘ধমনী’ উন্মুক্ত করেছে, যা একটি এক লাখ টন বা তারচেয়ে বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাঙ্কার থেকে অপরিশোধিত তেল খালাস ও পরিবহনের সময় আগের ১১ দিন থেকে প্রায় ৪৮ ঘন্টায় কমিয়ে এনেছে। এটি অপরিশোধিত তেল পরিবহন খাতে প্রতি বছর ১২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি চীনা পুঁজি, চীনা প্রযুক্তি, চীনা সরঞ্জাম ও চীনের নির্মাণের ‘পুরো শিল্প চেইনের’ অনুশীলনকে বাস্তবায়ন করেছে।
বাংলাদেশের আধুনিকীকরণের যাত্রায় ‘বেল্ড অ্যান্ড রোড উদ্যোগ’ হলো ‘রূপকল্প ২০৪১’ এবং ‘সোনার বাংলা’ স্বপ্নের সাথে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং উপযুক্ত সহযোগিতার উদ্যোগ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে চাইলে বিদ্যুৎকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিদ্যুৎলাইন নির্মাণ হলো বাংলাদেশের জনগণের ‘সোনার বাংলা’ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত এবং বিদ্যুৎ খাত হলো ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ প্রধান ভরসাস্থল।
বাংলাদেশে গুলাশাও ৩৬৫ মেগাওয়াট গ্যাস-চালিত কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার স্টেশন, যেটি একটি চীনা এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, বেশ কয়েকটি চীনা কেন্দ্রীয় উদ্যোগের অংশগ্রহণে নির্মিত এবং হুয়াতিয়েন অপারেশন ওভারসিজ টেকনোলজি কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ২০১৮ সালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম শুরু করার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং দেশের পরিবেশের উন্নতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে। এটি কেবল বাংলাদেশের গ্যাস সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রযুক্তিগত মানদণ্ডই নয়, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের’ বিদ্যুৎ খাতের তারকায় পরিণত হয়েছে। গুলাশাও পাওয়ার স্টেশন বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে। প্রকল্পটি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগে চীন-বাংলাদেশ জ্বালানি সহযোগিতার একটি মডেল প্রকল্পও হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে কয়লা ও তেলসহ প্রাথমিক জ্বালানির উত্সগুলো মূলত আমদানির উপর নির্ভরশীল এবং সেকারণে বিদ্যুতের ভিত্তি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। বাংলাদেশের জ্বালানি সরবরাহ তুলনামূলকভাবে কঠিন পরিস্থিতির মুখে রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে এখনও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিদ্যুৎ উৎপাদনের আধিপত্য রয়েছে। জলবিদ্যুৎ ও সৌরশক্তির অনুপাত ২ শতাংশেরও কম এবং বায়ু ও সৌরসহ নবায়নযোগ্য শক্তি সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি। বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুৎ ক্ষেত্রে অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে, যেমন বাতাসের কম গতি, দুর্বল ভূতাত্ত্বিক ভিত্তি ও কঠিন নির্মাণ। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বর্তমানে প্রথাগত শক্তি থেকে নতুন শক্তিতে প্রবেশ করছে।
বাংলাদেশের প্রথম কেন্দ্রীভূত বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে চীনা নির্মাণদল কক্সবাজার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পে ধারাবাহিক প্রযুক্তিগত সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে। স্থানীয় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে শূন্য থেকে সাফল্য অর্জনে সহায়তা করেছে চীনের পরিকল্পনা। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কক্সবাজার শহরে অবস্থিত। এর নির্মাণ কাজ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় এবং বিদ্যুৎ উত্পাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবরে। কক্সবাজার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের একটি সবুজ বিদ্যুৎ প্রকল্প, যেখানে চীনের বিনিয়োগ, নির্মাণ ও অপারেশন একীভূত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পও। এ প্রকল্প বায়ুশক্তি খাতে দেশটির ‘শূন্যতা’কে ভেঙ্গে দিয়েছে এবং প্রতি বছর ১৪৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘন্টা পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।
চীন সরকারের সাথে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরকারী দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশ নিচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো। এ সহযোগিতার আওতায় ১২টি সড়ক,২১টি সেতু ও ৭টি রেলপথ নির্মিত হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ২০২২ সালে একটি চীনা কোম্পানির অংশগ্রহণে পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হয়ে উঠেছে,যেখানে শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন জ্বালানি প্রকল্পে চীনা কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ কার্যকরভাবে বাংলাদেশের জ্বালানি কাঠামোকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে, বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহনে উন্নতি ঘটিয়েছে এবং জনগণের চলাচল ও স্থানীয় কর্মসংস্থান বেগবান করেছে।
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের আওতায় যৌথ নির্মাণের অগ্রগতির সাথে সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, অর্থনীতির গতি দ্রুত হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষের জীবন আশায় পূর্ণ হয়েছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বিশ্বের প্রতিটি আত্মাকে সুখের সন্ধানে আলোকিত করেছে।
লিলি/রহমান