গত বছরের মে মাসে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং শ্যানসি প্রদেশের সি’আন শহরে প্রথম চীন-মধ্য এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। তারপর তিনি ও মধ্য এশিয়ার শীর্ষ নেতাদের সাথে ছয়টি ডালিম গাছ রোপন করেন। ডালিম বিদেশ থেকে রেশম পথের মাধ্যমে চীনে আসা একধরনের কৃষি পণ্য এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড সংশ্লিষ্ট দেশের কৃষি সহযোগিতার প্রতিফলন।
আগে ডালিম, আঙ্গুর ও শণ প্রাচীন রেশম পথের মাধ্যমে চীনা আসত। আর এখন বেল্ট অ্যান্ড রোড সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কৃষিপণ্য সাগর ও পাহাড় অতিক্রম করে চীনা পরিবারে আসে। বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ চালু হওয়ার ১০ বছরে চীন কৃষি উন্মুক্তকরণ প্রসারিত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে অভিন্ন সমৃদ্ধ অর্জন করেছে।
সি’আন শহরের আই চু কোম্পানির একটি ‘অভিজ্ঞতা-দোকানের’ একটি নুডলস স্থলে খাদ্যপ্রেমীরা স্থানীয় খাবার পিয়াং পিয়াং নুডলস তৈরির প্রক্রিয়া দেখছেন। তবে অনেকে জানেন না, এ নুডলসের কাঁচামাল ৩ হাজার কিলোমিটার দূরে কাজাখস্তান থেকে আসে। ২০১৫ সালে সি আন আই চু খাদ্য ও তেল কোম্পানির কর্মকর্তারা কাজাখস্তান পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় খামার মালিকের সঙ্গে গম চাষের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২০১৫ সালে কাজাখস্তানে প্রতি হেক্টর জমিতে গমের উত্পাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৫০ কেজি থেকে দেড় হাজার কেজি। এখন আই চু কোম্পানির সহযোগিতা-এলাকায় গমের উত্পাদনের পরিমাণ ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আই চু কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চা হ্য ই বলেন, “আমরা সংশ্লিষ্ট দেশের আইন অনুসরণ করে কৃষি সহযোগিতা করি এবং স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে চাষ করি। প্রযুক্তি আপগ্রেড ও নির্ভুল চাষের মাধ্যমে উত্পাদনের পরিমাণ বাড়াই।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সম্পদ-সুবিধা অনুযায়ী কৃষিবাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহযোগিতা করছে। চীন বেল্ট অ্যান্ড রোডসংশ্লিষ্ট প্রায় ৯০টি দেশের সঙ্গে ১০০টির বেশি কৃষি ও মৎস্য সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং তাদের মধ্যে কৃষি পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
চীনের নর্থ-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধন মা লি লি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনও খাদ্য ঘাটতির মুখে রয়েছে। দরিদ্র ও ক্ষুধার সমস্যা এখনও সমাধান হয়নি। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কৃষিপণ্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকার জন্য অর্থবহ।
বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ চালু হবার পর চীন ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কৃষি শিল্প চেইন, সবররাহ চেইন ও মূল্য চেইন নিয়ে সহযোগিতা গভীর করে আসছে। সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে মধ্য এশিয়ায় খাদ্য গুদামজাতকরণ এবং লজিস্টিকস ব্যবস্থা নির্মাণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধান, রাবার ও ফল শিল্প চেইন, আফ্রিকা থেকে আনারস, চিনাবাদাম ও তুলো আমাদানি বৃদ্ধি এবং লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর কফি ও চিনি বিশ্ব বাজারে আনা।
ভালো বীজ, কার্যকর প্রযুক্তি, বিক্রি চ্যানেল এবং চীনা বিশেষজ্ঞ ও কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা - এ সবের কারণে কাজাখস্তানের খামার মালিক রহিমজানভের খাদ্য চাষ ও বিক্রি নিয়ে আর কোনও চিন্তা নেই। তিনি চাষ এলাকা ৬০০ হেক্টর থেকে ২০ হাজার হেক্টরে উন্নীত করেছেন।
উত্তর-পশ্চিম কৃষি ও বনবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চাং চেং মাওয়ের অফিসে লাগানো আছে মধ্য এশিয়ার ৫টি দেশের ম্যাপ। ম্যাপে লেখা আছে নানান নোট, যা ৬০ বছর বয়সী এ চীনা কৃষি বিশেষজ্ঞের বেল্ট অ্যান্ড রোড সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আসা যাবার প্রমাণ। চাং চেং মাও বলেন, তার উদ্যোগে কাজাখস্তানে একটি কৃষি দৃষ্টান্ত উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা স্থানীয়দের জন্য বড় একটি ঘটনা। স্থানীয় জমি যদিও উর্বর তবে গমের রোগ প্রতিরোধ দক্ষতা দুর্বল। তাই উত্পাদিত পণের মান কম। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে আদান-প্রদান সবসময় বেল্ট অ্যান্ড রোড আন্তর্জাতিক কৃষি সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। চীন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কৃষি উন্নয়নের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি শেয়ার করতে চায়। ২০১৬ সাল থেকে উত্তর-পশ্চিম কৃষি ও বনবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কাজাখস্তানসহ নানা দেশে কৃষি দৃষ্টান্ত উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বীজ প্রজনন, জল-সঞ্চয় সেচ ও মাটির উন্নতিসহ নানা বিষয় নিয়ে সহযোগিতা করে।
উত্তর-পশ্চিম কৃষি ও বনবিদ্যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চু ত্য লান বলেন, “উজবেকস্তানে রোদ প্রচুর এবং এ বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে আমরা সোলার স্প্রিঙ্কলার ও স্মার্ট সমন্বিত পানি ও সার সেচ সরঞ্জাম আবিষ্কার করি। তার সাহায্যে স্থানীয় তুলার উত্পাদনের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়েছে, পানি ব্যবহার ও বিনিয়োগ যথাক্রমে ৫০ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ কমেছে।”
বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ চালু হবার পর থেকে চীন বিশ্বের ৭০টি দেশ ও অঞ্চলে ২ হাজারের বেশি কৃষি বিশেষজ্ঞ ও প্রযুক্তি কর্মী পাঠিয়েছে; হাইব্রিড ধানসহ দেড় হাজার কৃষি প্রযুক্তি নানা দেশে জনপ্রিয় করিয়ে তুলেছে। এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলসহ নানা অঞ্চলে দারিদ্র বিমোচনে চীন দেয় এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আধুনিক কৃষি ও কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
চীনে আফ্রিকান ইউনিয়ানের স্থানীয় প্রতিনিধি রহমন্তলা অটোমান বলেন, আফ্রিকান কৃষির আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চীন। চীনের প্রযুক্তিগত সুবিধা ও নীতি আফ্রিকান দেশগুলো সহজে বুঝতে পারে।
চেচিয়াং প্রদেশের লি সুইতে বাস করেন উগান্ডা নারী রোস। তিনি খুব ভাল চীনা খাবার রান্না করতে পারেন। চলতি বছর তিনি আফ্রিকায় পরিবারের কাছে ফিরে যান এবং তার পরিবারের জন্য চীনের বিখ্যাত খাবার চাও চি তৈরি করেন।
অন্যদিকে, ইথিওপিয়ান কফি, চিলির অ্যাভোকাডো, কলম্বিয়ান কুইনোয়া চীনের স্থানীয় কফি ও দইয়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন ধরনের স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালে চীনে কফি ব্যবসার আকার ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে যাবে। চীনের বিভিন্ন শহরে স্থানীয় খাবারের সঙ্গে সমন্বয়ে নতুন স্বাদের কফি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেল্ট অ্যান্ড রোড-সংশিষ্ট দেশগুলোর কৃষিপণ্য চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলাসহ নানা মেলার মাধ্যমে চীনে সহযোগিতার সুযোগ পাচ্ছে।
পাশাপাশি চীনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন খাবার, চাও চি, চুং চি ও চীনের থালাবাসন দ্রুত বিদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। শ্যান সি প্রদেশের রো চিয়া মো হলো চীনা স্টাইলের হ্যামবার্গার আর এখন শুধু চীনে নয়, অন্য ১০-১২ দেশেও তা বিক্রি হচ্ছে। ফু চিয়ান প্রদেশের হুয়াং কেং জেলা চীনে বড় পেইন্টের বাঁশের চপস্টিক উত্পাদন কেন্দ্র এবং প্রতিবছর এখানে ৫০ কোটি জোড়া চপস্টিক উৎপাদিত হয়। তার মধ্যে ৩০ শতাংশ বিদেশে বিক্রি হয়।
উত্তর-পশ্চিম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেশম পথ গবেষণালয়ের পরিচালক লু শান পিং বলেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড-সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে কৃষিভিত্তিক দেশের সংখ্যা বেশি ও সেখানে কৃষির বড় বাজার আছে। জিডিপিতে কৃষির অনুপাত বেশি বলে কৃষি-উন্নয়ন তাদের অর্থনিতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষির উচ্চ মানের বৈদেশিক উন্মুক্তকরণ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এখন নানা দেশের কৃষি ও গ্রামীণ আধূনিকায়ন বাস্তবায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। (শিশির/রহমান/রুবি)