দেহঘড়ি পর্ব-০৫১
2023-12-31 21:29:25

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

স্নায়ুরোগের চিকিৎসায় টিসিএম

নিউরোপ্যাথি বা স্নায়ুরোগ বলতে সাধারণভাবে এক বা একাধিক স্নায়ুর অকার্যকরতা বা রোগকে বোঝায়, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা, সংবেদনশীলতা ও ক্ষয় ঘটায়। নিউরোপ্যাথির সবচেয়ে সাধারণ রূপ হলো পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, যেটি মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের কর্ড এবং শরীরের বাকি অংশের মধ্যে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটায়।

বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথিতে আক্রান্ত। এর মধ্যে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ৩ কোটি মানুষ কোনও না কোনও মাত্রায় এ রোগে ভুগছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিউরোপ্যাথি গুরুতর ব্যথা সৃষ্টি করে এবং শরীরকে অক্ষম হতে পারে৷

নিউরোপ্যাথির লক্ষণগুলো ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়। সেকারণে এটি নির্ণয় করা খানিকটা চ্যালেঞ্জিং৷ কোনও কোনও ধরনের স্নায়ুরোগ, যেমন দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুরোগ অনেক বছর ধরে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে আবার কোনও কোনওটি, যেমন তীব্র স্নায়ুরোগ হঠাৎ করে হতে পারে৷ এখনও পর্যন্ত নিউরোপ্যাথির কোনও নিরাময় আবিস্কৃত হয়নি এবং প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় নিউরোপ্যাথির অন্তর্নিহিত কারণগুলো দূর করার উপায় খুব সীমিত। এ চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যথার উপসর্গগুলো থেকে মুক্তি দেওয়ার উপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়।

তবে গবেষণায় দেখা গেছে, আকুপাংচার ও ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা (টিসিএম) পরিপূরক বা বিকল্প চিকিৎসার একটি কার্যকর উপায়। এ চিকিৎসা স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করে।

লক্ষণ: নিউরোপ্যাথির লক্ষণগুলো সূক্ষ্ম বা গুরুতর হতে পারে এবং এক রোগী থেকে আরেক রোগীর মধ্যে এ লক্ষণের ব্যাপক তারতম্য থাকতে পারে। তবে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলোর হলো হাত ও পায়ে অসাড়তা; অঙ্গে জ্বালাপোড়া বা তীক্ষ্ণ ব্যথা; স্পর্শ ও তাপের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি অথবা হ্রাস; শারীরিক ভারসাম্যহীতা হ্রাস এবং পড়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়া; পেশীতে কম্পন বা খিঁচুনি; বসা অবস্থা থেকে দাঁড়ালে মাথা ঘোরা; মূত্রাশয় ও অন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমস্যা; যৌন অক্ষমতা; এবং ওজন হ্রাস।

নিউরোপ্যাথির কারণ: দীর্ঘস্থায়ী নিউরোপ্যাথি সাধারণত অন্য কোনও রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। ডায়াবেটিস হলো নিউরোপ্যাথির সবচেয়ে সাধারণ কারণ। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের স্নায়ুর ক্ষতি হয়। রক্তে শর্করা বাড়লে রক্তনালীগুলো দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে স্নায়ুর প্রান্তে পর্যাপ্ত পুষ্টি পৌঁছায় না। নিউরোপ্যাথির অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আঘাতজনিত কারণে স্নায়ু টিস্যুর ক্ষতি; ওষুধ বা কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া; অটোইমিউন ও প্রদাহজনিত রোগ; হৃদরোগ; কিডনির সমস্যা; অস্বাস্থ্যকর ডায়েট; অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ; এবং বিষাক্ত পদার্থের সংশ্রব।

চিকিৎসা: ডায়াবেটিস, কেমোথেরাপি, প্রদাহ ও অন্যান্য রোগ থেকে উদ্ভূত নিউরোপ্যাথির চিকিৎসার জন্য একটি নিরাপদ বিকল্প আকুপাংচার ও টিসিএম।

টিসিএম তত্ত্বে মনে করা হয়, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি শরীরের ক্লেদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ক্লেদ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে দেহের মূল শক্তি বা ‘ছি’ ও রক্তের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই আকুপাংচারে শরীরের ক্লেদের কারণ দূর করা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ‘ছি’ ও রক্তের প্রবাহ মসৃণ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

পুষ্টি টিসিএমের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন টিসিএম চিকিৎসক নিউরোপ্যাথি মোকাবিলায় অবদান রাখতে পারে এমন খাদ্যের তালিকা প্রণয়ন করে দিতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, সবার জন্য তালিকা এক হবে না; রোগীভেদে ভিন্ন হবে। সেকারণেই এক্ষেত্রে টিসিএম বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

টাইপ-টু ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়ে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কেবল প্রচলিত ওষুধ ব্যবহার করেছেন এমন রোগীরা নিউরোপ্যাথির ক্ষেত্রে যে ফল পেয়েছেন টিসিএম চিকিৎসা গ্রহণকারীরা তার চেয়ে অনেক ভাল ফল পেয়েছেন।

 

#ভেষজের গুণ

অন্তহীন গুণ অশ্বগন্ধার

ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ অশ্বগন্ধা। অশ্বগন্ধার নামটি এসেছে এ গাছের শিকড় থেকে। অশ্বগন্ধা গাছের মূল থেকে ঘোড়ার গন্ধ আসে। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে অশ্বগন্ধা। এর বৈজ্ঞানিক নাম উইথানিয়া সমনিফেরা।

অশ্বগন্ধা অত্যাশ্চর্য ভেষজ নামেও পরিচিত। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অশ্বগন্ধার উপকারিতা অপরিসীম। একে অ্যাডাপ্টোজে অর্থাৎ মানসিক চাপ মুক্তির এজেন্টও বলা হয়। জানিয়ে দিচ্ছি এ ভেষজের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে:

[U1] রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অশ্বগন্ধার জুড়ি নেই। অশ্বগন্ধায় থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এ কাজে সাহায্য করে। এ ভেষজে আছে প্রদাহবিরোধী উপাদান যা মানুষের দেহে সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

ক্যান্সার প্রতিরোধ করে: ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা শাস্ত্রমতে, অশ্বগন্ধা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। যাদের কেমোথেরাপি দিতে হয় তাদের শারীরিক অবস্থার উন্নতিতে কাজ করে এ ভেষজ।

রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে: মানুষের দেহের রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা বেশ কার্যকর। এর মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডকে রোগ থেকে রক্ষা করে এ ভেষজ। ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা শাস্ত্রমতে, অশ্বগন্ধা মানুষের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং পেশির শক্তি বৃদ্ধি করে। আর্থাইটিসে ব্যথায় অশ্বগন্ধার গুঁড়া খুবই উপকারী।

ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে: অশ্বগন্ধার মূল ও পাতার রসে থাকা অ্যান্টি-ডায়বেটিক উপাদান রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর মূল ও পাতার কোষে ফ্ল্যাভোনয়েডস নামক উপাদান থাকে যা ডায়বেটিস রোগীর দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।

অনিদ্রা ও মানসিক চাপ কমায়: অশ্বগন্ধা খুব সহজে মানুষের ক্লান্তি দূর করতে পারে। এর ফলে অনিদ্রা দূর হয় এবং দ্রত ঘুম আসে। অশ্বগন্ধার অ্যানজাইলটিক উপাদান মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে মানসিক চাপ কমাতে সক্ষম। স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও এটা বেশ কার্যকর।

যৌনক্ষমতা বাড়ায়: মানুষের দেহে টেস্টোস্টেরন ও প্রোজেস্টেরনের পরিমাণ বাড়াতে অশ্বগন্ধা গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এই হরমোন বৃদ্ধির ফলে মানুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা ও যৌনক্ষমতা দুটিই বৃদ্ধি পায়।

থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করে: থাইরয়েডের সমস্যায় অশ্বগন্ধা একটি কার্যকর প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। যাদের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কম তাদের ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা হতে পারে খুবই উপকারী।

চুল ও ত্বকের জন্য উপকারী: চুলের ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা বেশ উপকারী বলে মনে করা হয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে। এ শাস্ত্রমতে, চুল পড়া কমাতে ও চুলকে মজবুত করতে অশ্বগন্ধা একটি কার্যকর ভেষজ। এছাড়া অশ্বগন্ধা ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। ত্বকের ভাজ পড়া কিংবা দ্রুত বার্ধক্য থেকে মুক্তি দেয় এ ভেষজ।

সাপের কামড়ের চিকিৎসায় কার্যকরী: সাপে কামড় দিলে অশ্বগন্ধার ব্যবহারের প্রচলন বেশ পুরনো এবং সাপের কামড়ের চিকিৎসায় এটি বেশ কার্যকরও। তবে অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোমতেই ব্যবহার করা উচিৎ নয়।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।

 [U1]