২০২৩ সালের চীনা অর্থনীতি প্রসঙ্গে
2023-12-27 14:45:25

২০২৩ সালে চীনের অর্থনীতিতে তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মান। এ বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে চীনের জিডিপি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ে। সিপিআই গত বছরের একই সময়ের তুলনায় শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। প্রথম তিন প্রান্তিকে বেকারত্বের হার ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা গতবছরের একই সময়ের তুলনায় শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ কম। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল ৩ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার বা তার চেয়ে বেশি।

চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের  সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের গবেষক চাং লি চুন বলেছেন, কঠোর বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ পরিবেশে চীনের অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার হয়েছে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। এটা সহজ একটি ব্যাপার নয়।

 

স্থিতিশীলতা যেমন ২০২৩ চীনের অর্থনীতির একটি বৈশিষ্ট্য তেমন গত ১০ বছর চীনা অর্থনীতির বাস্তবতা। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চীনের ডিজিপি ৫৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন থেকে ১২১ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে উন্নীত হয়। গড়ে প্রতি বছর ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বার্ষিক জিডিপি ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এটা বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। মাথাপিছু জিডিপি ৪৩ হাজার ৪৯৭ ইউয়ান থেকে ৮৫ হাজার ৬৯৮ ইউয়ানে উন্নীত হয়।

 

বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নে চীনা অর্থনীতি এখনও বৃহত্তম চালিকাশক্তি। ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান তিন ভাগের এক ভাগ। দশ বছরে, বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ১২ দশমিক ৩ শতাংশ  থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চীনের পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ টানা ৬ বছর ধরে বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের বার্ষিক অবদান হার ৩০ শতাংশেরও বেশি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, অর্থনীতি সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থাসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা চীনের অর্থনীতি নিয়ে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়ায়। চীনের অর্থনীতির ওপর তারা আস্থা রাখে।

স্থিতিশীল উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চীনের অর্থনীতির মানও উন্নত হচ্ছে। চীনা পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে চীনের উচ্চ-প্রযুক্তির নির্মাণ শিল্প ও পরিসেবা বিনিয়োগ যথাক্রমে ১১ দশমিক ৩ এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।  এর মধ্যে মহাকাশযান, বিমান ও সরঞ্জাম শিল্পের সংযোজন মূল্য গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি। উচ্চ-সরঞ্জাম, নতুন জ্বালানি, নতুন কাঁচামালসহ নানা ক্ষেত্রে ৪৫টি জাতীয় প্রথম শ্রেণীর নির্মাণ শিল্প ক্লাস্টার প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রধান শিল্পের উত্পাদন পরিমাণ ২০ ট্রিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছায়। অনুমান অনুযায়ী, চতুর্থ প্রান্তিকে চীনের জিডিপি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ আর এ বছরের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ৫ শতাংশের প্রত্যাশার তুলনায় বেশি। চীনা ব্যাংক গবেষণালয়ের পরিচালক চেন ওয়ে তুং মনে করেন, ২০২৪ সালে বহির্গত পরিবেশ আগের চেয়ে ভাল হতে পারে এবং দেশ বিদেশের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে পারে। নীতি ও বাজারের সমর্থনে চীনের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখবে।

বেসরকারি অর্থনীতি উচ্চ-মানের উন্নয়নের জন্য ভিত্তি তৈরি করেছে এবং এটা চীনা অর্থনীতির প্রাণশক্তির বহিপ্রকাশ। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বেসরকারি অর্থনীতি বিকাশের একটি প্রস্তাব প্রকাশ করে সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাষ্ট্রীয় পরিষদ। সেপ্টেম্বর মাসে, চীনা উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশান বেসরকারি অর্থনীতি উন্নয়ন ব্যুরো স্থাপন করে। বেসরকারি অর্থনীতির উচ্চ-মানের উন্নয়ন সমর্থন করতে চীন ধারাবাহিক নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে।

চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে নতুন প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি কোম্পানি ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। জরিপে দেখা যায়, সামষ্টিক অর্থনীতি, মুনাফা, বাজার ও বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে আশাবাদী বেসরকারি কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা বাজার ও উন্নয়নের ওপর আস্থা রাখে।

 

শক্তিশালী দেশ হতে চাইলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একমাত্র সূচক হলে হবে না। ২০২৩ সালে দেশ বিদেশের চাপের মুখে চীনের অর্থনীতি উচ্চ মানের উন্নয়ন বাস্তবায়ন হতে পারে, যা প্রমাণ করে চীনের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা দক্ষতা জোরদার হয়েছে। ২০২৩ সালে চীনের অর্থনীতি উন্নয়নে ভোগের অবদান সবচেয়ে বেশি - ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ। সম্পূর্ণ শিল্প ও সরবরাহ চেইনও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০টি কোম্পানির সহযোগিতায় সি৯১৯ বিমানের বাণিজ্যিক অপারেশন শুরু হয়। চীনের হাইস্পিড ট্রেন প্রথম বারের মতো সম্পূর্ণ ব্যবস্থা ও শিল্প চেইন বিদেশে রপ্তানি করে। চীন বিশ্বের একমাত্র দেশ যার ৪১টি বিভাগে ৬৬৬টি শিল্প আছে। সম্পূর্ণ শিল্প ও উত্পাদন ব্যবস্থার সাহায্যে শাক্তিশালী উত্পাদন ও সরবরাহ দক্ষতা আছে চীনের। এটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নবায়নে ব্যাপক সম্ভবনা ও সমর্থন দেয় এবং ভবিষ্যতে চীনা অর্থনীতির দীর্ঘসময়ের স্থিতিশীল উন্নয়নে চালিকাশক্তি যোগায়।

বর্তমান বিশ্বের জন্য বাজার সবচেয়ে দুর্লভ সম্পদ। চীনের ১৪০ কোটি জনসংখ্যা এবং বিশ্বের বৃহত্তম মাঝারি আয়ের জনসংখ্যা হচ্ছে চীনের বৃহত্তম সুবিধা।

২০২৩ সালের প্রথম ১০ মাসে চীনের সামাজিক খুচরা পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি ছিল। প্রথম তিন প্রান্তিকে অর্থনীতিতে ভোগের অবদান ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং জিডিপিকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দিয়েছে। পর্যটন, খাবার ও বিনোদন ক্ষেত্রে ভোগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এবং ২০২৪ সালে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো অর্থনৈতিক কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে চীন।

অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য দক্ষ মানুষও প্রয়োজন। ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত চীনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দক্ষ ব্যক্তি উন্নয়ন প্রতিবিদনে বলা হয়, চীনে গবেষকের সংখ্যা ২০১২ সালের ৩২ দশমিক ৪ লাখ থেকে বেড়ে ২০২২ সালের ৬৩ দশমিক ৫ লাখে দাঁড়ায়। এ সংখ্যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। চীনের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পরিকল্পনার অংশগ্রহণকারী বিজ্ঞানীর মধ্যে ৪৫ বা তার চেয়ে কম বয়সের মানুষের অনুপাত ৮০ শতাংশের বেশি। তারা ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে শক্তিশালী সমর্থন দিবেন।

ভবিষ্যতের মুখে আমরা বিশ্বাস করি, চীনের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে এবং দীর্ঘসময়ের উন্নয়ন বাস্তবায়ন হবে।(শিশির/রহমান/রুবি)